জ্বলদর্চি

হাজার বছরের বাংলা গান || পর্ব - ৮

হাজার বছরের বাংলা গান ।। পর্ব-৮

তু ল সী দা স  মা ই তি

বাংলা গানে ধর্মসমন্বয়ের প্রভাব :
সূফী ধর্মমত ও সহজিয়া বাউল সংগীতের উদ্ভব।


"এ জিনিস হিন্দুমুসলমান উভয়েরই একত্রে হয়েছে  অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি।" 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাউল সংগীত সম্পর্কে এমন ভাবনা প্রকাশ করে বাউল গানের বিশেষ চরিত্রকেই সামনে নিয়ে এসেছেন। পণ্ডিতগণ মনে করেন বাংলা বাউলগান 'হিন্দু ও মুসলমান সংস্কৃতি সমন্বয়ের একটা পরিণতি"। বাংলা গানের এই জনপ্রিয় ধারার স্বরূপ ও পূর্বসূত্র বুঝতেই এই আলোচনার অবতারণা। শুধুই হিন্দুমুসলমান সমন্বয়ের ফল বাংলার বাউলসংস্কৃতি এইটুকুই বললে কমই বলা হয়। ভারতীয় ধর্মসংস্কৃতির একটা নির্যাসও এগুলির অন্তরে আছে তা অনায়াসে অনুমেয়। বলা হয়ে থাকে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে বাউল সম্প্রদায় দের উদ্ভব হলেও পঞ্চদশ শতাব্দীতেই বাউল গান মানুষের প্রাণের গান হয়ে প্রিয়তা পায়। বাউল সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে আছে মানবপ্রেম। সিদ্ধাও' মুসলমান ফকির থেকে বাউল গান এলেও 'সূফী' ধর্মমতই বাউলভাবনার উৎস। তাই বাউল গানের উঠোনে প্রবেশ করার আগে সূফী সহ অন্যান্য ধর্মমত কিভাবে মানবতাবোধের আবহকে লালন করেছে সেই অভিমুখে আলোকপাত জরুরি।
"মানবসন্তানের যতবার স্বাস প্রশ্বাস বহে, ঈশ্বরের দিকে অগ্রসর হইবার পথ ততগুলি আছে।"
সূফীসূত্রের এই ভাবনা থেকেই স্পষ্ট হয় 'সূফী' ধর্ম 'পরধর্ম্মসহিষ্ণু' ও 'সারসংগ্রহশীল'। জানা যায়, দ্বাদশ  শতাব্দীর আগে থেকেই ভারতবর্ষে 'সূফী'ধর্ম  প্রভাব বিস্তার করছিল। দেশের অনেকগুলি কেন্দ্রেই তারা বিস্তার লাভ করতে থাকে। শাহ সুলতান রূমী, মকদুম সৈয়দ আলি, সৈয়দ নাথর শাহ প্রমুখ সূফীগুরু তাঁদের ভাবনার প্রবর্তন করতে থাকেন। বাংলাভূমিতে ছিলেন শাহ সুলতান রুমী।  চতুর্দশ শতক এই ধর্মেরই কিছু অন্য মত ছড়াতে থাকে। মাদারি, কাদিরি এবং নকসবন্দি মতগুলি গুরুত্বপূর্ণ। তবে একটা কথা বলা খুব  জরুরি এই দেশে সূফীমতের বিস্তারলাভে ভীষণভাবে সহায়তা করেছিল 'উপনিষদের একেশ্বরবাদ, বৈষ্ণব ভক্তিবাদ ও সহজিয়া ধর্মান্দোলন। তাছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে  এই দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক নানান এককগুলি সূফী মতের সাথে মিশতে থাকে। বাংলার ক্ষেত্রে তো বটেই। 

এক ধর্মকলহের যুগেই বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষার উদ্ভব। বৌদ্ধদের অবশেষ কাল, জৈন ইতিহাসের ছায়া, হিন্দুধর্মের প্রাবল্য এই সময়কালের ধর্মচরিত্র। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মধ্যে শাক্ত শৈব দ্বন্দ্ব ও বৈষ্ণব ধর্মের উপস্থিতি। কিছুকাল পরেই তুর্কী আক্রমণের ফলে ইসলাম সংস্কৃতির আগমন। একটা টানাপোড়েনের মধ্যেই সংস্কৃতির মিশ্রণ তৈরি হতে থাকে। উত্তর ভারত থেকে আগত সূফী ধর্মমতও তখন থেকেই ধীরে ধীরে বাঙালির সংস্কৃতিতে মিশে বাউলগানের ধারায় গতি দান করে। সহজিয়া চর্যাপদ, সহজিয়া নাথগীতি, সহজিয়া বৈষ্ণব সংগীত এর প্রবাহেই যুক্ত হয় বাউল সংগীত। আরাকান রাজসভার মানবিক আবেদন- ঋদ্ধ সাহিত্য ক্রিয়াও বহিরঙ্গের বাউলসংগীতে এসে যায়। অর্থাৎ বঙ্গভূমিতে অনেক সূফী আদর্শ ''সমসাময়িক সহজিয়া ধর্ম ও দর্শনের সঙ্গে মিলিত হয়ে বাঙলায় বাউল গানের উদ্ভবের সূচনা করে।' 

পণ্ডিতরা মনে করেন যে পরধর্ম সহিষ্ণুতার মধ্যে অনেক সময় যে বিশ্বাসের দুর্বলতা ও ঔদাসীন্য থাকে তা সূফী ধর্মের মধ্যে নেই এবং তা নিজেকে অন্য ধর্মের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চেষ্টা না করে অন্য সমস্ত ধর্মকে নিজের গ্রহণোপযোগী করে নেয়।  এই মহান ভাবনাই  বাংলা বাউল গানে সঞ্চারিত হয়ে তাকে উজ্জ্বল করেছে। বাউল ধর্ম সাধনার মূল আঙ্গিক তার গানের মাধ্যমে হৃদয়ের আবেগ উছ্বাসের প্রকাশ। গৌড়ীয়বৈষ্ণব ধর্মে যেমন, সুফীর 'সমা' অর্থাৎ নৃত্যগীতে যেমন তেমনি মিল বাউলে। নিজের সাথে পরমাত্মার মিলন এমন নৃত্যগীতের আঙ্গিকের প্রকাশ হয় বলে তাঁরা মনে করেন। বাউলের মানবপ্রেম একমাত্র কোনো বাইরের বস্তুকে আশ্রয় করেই ব্যক্ত নয়, এই প্রেমের আধার তাঁদের 'মনের মানুষ'। দেহের মধ্যেই মনের মানুষ আছে, তাকে খুঁজে পেতেই আকুলতা, ও সাধনা। সেই পরমপ্রিয়ের প্রাপ্তিতে আনন্দ। 

বাউলগানে মনের মানুষ,কোথাও বা সাঁই, কোথাও মুর্শিদ এর জন্য ব্যাকুলতা। এই পরম কিছুর কাছে আত্মনিবেদনের পর্যায়টি বাউল গানের আকর্ষণীয় ক্ষেত্র।
      "উনুর ঝুনুর বাজে নাও আমার নিহাইলা বাতাসে,
      রে মুর্শিদ, রইলাম তোর আশে।
      পশ্চিমে সাজিল মেঘ দেওয়ায় দিল ডাক…
      আমার ছিঁড়িল হালের পানস নৌকায় খাইল পাক।
      মুর্শিদ রইলাম তোর  আশে।"……

অন্যান্য সহজিয়া ধারার সাধনার মতোই বাঙালির বাউল ধর্মে সবরকমের আনুষ্ঠানিকতার বিপক্ষে জেহাদ রয়েছে। দেবালয় নয়, অন্তরের মধ্যেই পরমকে প্রাপ্ত করার অনুভব। হৃদয়দেবতার নিবিড় অনুসন্ধান দেহের মধ্যেই। অন্যান্য দেশের মাবতাবাদী সম্প্রদায় যেমন শাস্ত্রীয় আচার -অনুষ্ঠান ও বহির্মুখ পাণ্ডিত্যের পথে সত্যকে লাভ করা সম্ভব বলে মনে করেন বাঙালি বাউলরা তা করেননি। সহজিয়া বাউলদের সাধনমার্গও সহজস্বরূপ।
        'যদি ভেটিবে সে মানুষ, তবে সাধনে সহজ হবি
         তোর যাইতে হবে সহজ দেশে।'
তারা মনে করেন তাদের প্রিয়তম দেহমন্দিরই সকল তত্ব ও পরমের আধার। বাউলগানে তাই দেহের ভেতর হৃদয়আসনের পবিত্র যে পাত্র আছে তাতে  ভাবের মানুষের মিলনের জন্য 'লাঞ্ছিত ভক্তের অবিরাম গুঞ্জন ধ্বনিত হয়েছে।' বাউলের প্রেম হৃদয়দেবতার সাথে ব্যক্তির প্রেম। ভাবের মানুষের সঙ্গে মিলনের অর্থই সহজ উপলব্ধি আত্মোপলব্ধি। উপনিষদের যুগ থেকেই এই ভাবনা বাহিত হয়ে এসেছে। এই কারণেই সূফীচিন্তা ভারতেও জনপ্রিয়তা পেয়ে বাউল সংগীতের মর্যাদা বেড়েছে। সূফী সাধনা ও  বাউলের যে যোগ তার কেন্দ্রে আছে মানবতাবাদ ও চিত্তশুদ্ধি। 

বাউল স্যাধনা ও সংগীত উভয় ক্ষেত্রেই গুরু ছাড়া অগ্রসর হওয়ার পথ ছিল না। বাংলা গানের প্রথম পর্যায় অর্থাৎ চর্যাপদের ধারাটিও সহজিয়া সাধন সংগীত। গুরুর শেখানো পথেই তার অনুবৃত্তি। কেউ কেউ চর্যাগীতির ভাবনার সাথে সহজিয়া বাউলের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন। যেমন চর্যাগানে সরহপাদ বলছেন, 'কিন্তো মন্তে কিন্ত্তো তন্তে কিন্তোরে ঝাণবখানে'
বাউল গানেই একটু অন্যরকমভাবে আছে।
      মন্ত্রে তন্রে পাতলি যে ফাঁদ
       দেবে কি সে ধরা ।
       উপায় দিয়ে কে পায় ধরা
        শুধু আপন ফাঁদে মরা।
আসলে বাঙালি তাঁর নিজস্ব গানের যে ভুবন বেঁধেছিল তাঁর সরল প্রভাব থেকেই গেছে। বাউল গানেও।
বাউলদের জীবনদেবতা তাঁদের জীবনের মধ্যে আছে বলেই তাঁর বাণী আপামর বাঙালির অন্তরের বাণী। এই আশ্চর্য বোধ মানুষের বিবেককে চিরকাল জাগিয়ে রেখেছে। ধর্ম জাত কুল এসবের ঊর্ধ্বে উঠে মানবকল্যানেই তো প্রকৃত ধর্ম থাকে। মানুষের মধ্যেই মানুষ রতন খুঁজে পাওয়া। পৃথিবীর সব মানব ধর্মেই তো এর প্রতিধ্বনি। বলা বাহুল্য, শুধু বাঙালির মধ্যেই নয়, সমকালে, ঘুরপথে  হলেও ভারতের সর্বত্র এমনকি পৃথিবীর নানান দেশেও এমন মরমিয়া সমাজ তাদের কথা প্রচার করেছিল সঙ্গীত বা অন্য শিল্পের মাধ্যমে। জয়দেবের সমকাল থেকেই ভারতে ধু-ল- মিশবি, অল গাজালি, ইবন-অল-আরবী হাফিজ, জামী প্রমুখ সূফীসাধক গণ পবিত্র ধর্মের বাঁধাধরা পথ ছেড়ে জীবনের মধ্যে মানুষের মধ্যেই জীবনদেবতাকে খুঁজেছেন। এই একই পথে আমরা পেয়েছি সাধু রজ্জব কবীর, দাদূ, নানক, রামানন্দ, হরিদাস প্রমুখ সন্ত নিজের মধ্যেই পরমকে পেতে চেয়েছেন। পাশ্চাত্য দেশেও এই মরমিয়া সমাজ ছড়িয়ে  পড়েছিল দেশে দেশে। বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, জার্মানি, হাঙ্গারি, ডালমাটিয়া প্রভৃতি দেশে সূফী ও বাউল ধর্মের মতো সম্প্রদায় মানবতার অমৃতধারা প্রচার করে গেছে।  'কাথারি'','পুয়োর ক্যাথলিক' 'ফ্রেন্ডস অফ গড' 'ব্রিদরেন অফ কমন লাইফ' প্রভৃতি নামের সম্প্রদায়।
ধর্ম সমন্বয়ের এই নানা সূত্রেই বাঙালির বাউল আজও সমান জনপ্রিয়। লালনফকিরের গান, গগন হরকরার গান পরবর্তী কালে ভীষণভাবে বাংলাগানের জগৎকে সমৃদ্ধ করেছে। কাঙাল হরিনাথ ফিকির চাঁদ সহ অনেকেই এই গানে জগৎ মাতিয়েছেন। এই বিস্তৃত ক্ষেত্র অন্য পর্বে আলোচিত হবে। বাঙালির নিজস্ব বাউল গানে তার সহজিয়া ও মরমিয়া  দিকটুকুই এই আলোচনায় থাকলো। এই মরমিয়া সংগীত তো রবীন্দ্রনাথকেও ছুঁয়েছিলো ভীষণ ভাবে। তাঁর বিশ্বদেবতা তো অখণ্ড প্রাণ, অখণ্ড জীবন ও অখণ্ড মানবতারই প্রকাশ। তাঁর 'মনের মানুষ' অন্তরময় বলেই তিনি বলেন -
  'অন্তর  মিশালে তবে তার অন্তরের পরিচয়।' (চলবে)

Post a Comment

1 Comments

  1. পড়ছি,ভালো লাগছে তথ্য সমৃদ্ধ ও সহজ করে লেখা বলে।

    ReplyDelete