হাজার বছরের বাংলা গান || পর্ব - ৭
তু ল সী দা স মা ই তি
কথাপ্রধান বাংলাগানের একটি পর্যায়: নাথগীতিকা, শূন্যপুরাণের গান, পল্লীগীতিকা ও অন্যান্য
"আমাদের দেশে স্ত্রী যেমন স্বামীর অধীনতা স্বীকার করিয়াই স্বামীর উপর কর্তৃত্ব করিতে পারে, এ দেশে গানও তেমনি বাক্যের অনুবর্তন করিবার ভার লইয়া বাক্যকে ছাড়াইয়া যায়।" রবীন্দ্রনাথের এই কথাগুলি বাংলা গানের আলোচনার ক্ষেত্রে ভীষণভাবে সহায়ক। পণ্ডিতরা বারবার বলেছেন, বাঙালি সঙ্গীতপ্রবণ জাতি। কিন্তু কথার গুরুত্বকে তারা কমিয়ে দেয়নি। অর্থাৎ তারা কাব্যকেও ভালোবেসেছে। তাই দুটোর অপূর্ব মেলবন্ধনে বাঙালি বাংলাগানকে একটা নিজস্ব মহিমা দিতে পেরেছে।
বাংলা গানের যাত্রাপথে বিবর্তনের অনেক অভিমুখ। দীর্ঘ পথে গানের অনেক পর্যাযের আলোচনা উপেক্ষিতই থেকে গেছে। সংগীতের অনেকগুলি জনপ্রিয় ধারা আজও বেঁচে আছে। কিন্তু এমন কিছু সঙ্গীত ধারা বঙ্গভূমির নানা প্রান্তে গড়ে উঠেছিল তারা আজ পূর্ণরূপে নেই বা রূপান্তরের মধ্যেও তার গুরুত্ব তেমনটা নেই। কথা প্রধান এই সকল গান বাংলা সংগীতের নানা ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করেছে ভীষণভাবে। শুধু তাই নয়, সমকালে এই গীতি ধারাগুলোই গ্রামীন বাংলার মানুষের হৃদয় জয় করে এসেছে। এ প্রসঙ্গেই নাথগীতিকা তথা গোপীচাঁদ বা ময়নামতীর গান, ডাক ও খনার বচন, শূন্যপুরাণের গান ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা নিয়ে আলোচনার অবতারণা।
নাথগীতির দুটো উপাখ্যান। এক.গোপীচাদেঁর গান অর্থাৎ ময়নামতীর গান। দুই. গোরক্ষবিজয়। গ্ৰীয়ারসন সাহেবের জার্নালে 'মানিক চাঁদের গান' নামে যে পল্লীগাথা প্রকাশিত হয়েছিল এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে উনিশ শতকের শেষদিকে বাংলা কাব্যের ইতিহাসে তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, বাংলা গানের ইতিহাসেও তার গুরুত্ব কম নয়। এগুলি মানিকচাঁদের গান, গোপীচাঁদের গান, ময়নামতীর গান নামে পরিচিত। ভবানী দাস, দুর্লভ মল্লিক শুকুর আহমেদ --এই তিনজন রচয়িতার পুঁথি উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বাংলার নানা প্রান্ত থেকে সংগৃহীত হয়েছে। বাংলাভাষা পরিমণ্ডলের প্রথম দিকেই এগুলি লেখা। বাংলার রাজা মানিকচন্দ্র, তাঁর যোগিনী স্ত্রী রানী ময়নমতী, পুত্র গোবিন্দচন্দ্র ও দুই স্ত্রী অদুনা পদুনার সাধারণ জীবন ও যোগীজীবনের অপূর্ব কাহিনি নিয়েই রচিত পালাগান এগুলি। নাথযোগীগণের যোগবলের মহিমা গীত হয়েছে। যোগের শক্তিতে মৃত্যুকেও শাসন করার রহস্যগভীরতা আছে এই সংগীতের অন্তরে। পল্লীর কবিদের হাতে তা মরমী মধুর হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস গ্রহণ বিষয়টি খুব মর্মগ্রাহী। এই কাহিনিমূলক সংগীত শুধু বাংলায় নয়, ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং তার করুণ বিষাদময় সুর বাংলা গানের মহিমাকে প্রতিষ্ঠা দেয়। ভারতবর্ষের সর্বত্র এই সহজিয়া সংগীতগাথা বিভিন্ন ভাষায় চিত্রে নাটকে প্রকাশিত হয়ে বাংলার সম্মানকেই উচ্চতা দিয়েছে।
নাথগীতির দ্বিতীয় পালাগান 'গোরক্ষবিজয়'। সহজিয়া নাথযোগীদের নিবিড় সাধনা জীবনের কাহিনি। বলা বাহুল্য, নাথযোগীদের যোগ ও সাধন কৌশল ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। অনেকে বলেন নাথধর্ম বৌদ্ধ ও শৈব ধর্মের মিশ্রণ। এই ধর্মের উৎপত্তির ইতিহাস কথার রহস্যেই ঢাকা। বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের মতোই নাথযোগীগণ তাঁদের কায় সাধনার কথা গানের রূপকে প্রকাশ করেছে। পণ্ডিতগণ মনে করেন রানী ময়নামতীর দলভুক্ত নাথযোগীগণ গোরক্ষ বিজয় রচনা করেন। নাথ যোগীগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মীননাথ, গোরক্ষনাথ, জালন্ধরী বা হাঁড়িপা ও কানু পা। 'গোরক্ষবিজয়'-এর অনেকগুলো পুঁথি সংগৃহীত হয়েছে। কবীন্দ্র দাস, ফয়জুল্লা, ভীমদাস ও শ্যামদাস সেন-এঁদের নাম ভণিতায় উল্লিখিত। এই সংগীতগাথা বাঙালি মননকে শান্ত সমাহিত করেছে তার প্রসাদগুণেই। সাধনার কথা থাকলেও পল্লীর অপূর্ব ছবিও আছে। অনেকে মনে করেন গোরক্ষের চরিত্র মহিমা বাংলার 'যুগনির্দেশক স্তম্ভ'। চরিত্রবল, রীতিনীতি গুরুভক্তির এমন সরল প্রকাশ বাঙালির চিত্তকে প্রভাবিত করেছে। পরবর্তী সংগীতের মধ্যেও তার প্রভাব পড়েছে অনেকটাই।
বাংলার সংস্কৃতিতে এক ব্যতিক্রমী উল্লেখযোগ্য সংযোজন শূন্যপূরাণের গান। বাংলার বৌদ্ধযুগের অবশেষ পর্যায়ে ধর্মপুজা প্রচলিত হয়। রামাই পন্ডিতের শূন্যপুরাণে ধর্মপূজার কথা রচিত হয়। পরে এই বিষয়কে নিয়ে অনেকেই ধর্মমঙ্গল গান রচনা করেন। দীর্ঘ সময় ধরেই এই ধরনের সংস্কৃতি বঙ্গভূমির নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। রামাই পণ্ডিতের ধর্মপূজা পদ্ধতিরীতি বঙ্গদেশের অন্ত্যজশ্রেণির মানুষের মধ্যে নিবিড়ভাবে প্রভাব তৈরি করে। ডোম, চণ্ডাল, হাড়ি প্রভৃতি তথাকথিত নিম্নজাতের মানুষের মধ্যেই এর ব্যাপকতা আসে। 'শূন্যমূর্তি পূজার এই বিশেষ রীতি বৌদ্ধ সংক্রান্ত 'শূন্য' ও 'মহাশূন্য'কেই আভাসিত করে। ধর্মঠাকুরের পূজায় আজও দ্বাদশ পালা গাওয়ার প্রচলন আছে। শূন্যপুরাণের একান্নটি অধ্যায়ে এই নিজস্ব ধর্ম সংগীতের মহিমা প্রকাশিত। সৃষ্টি পত্তনের কথা সহ অধিবাস, জলপাবন, টীকাপাবন, অধিবাস, ধুনাজ্বালা, ঢেঁকিমঙ্গলা, গাম্ভারী মঙ্গলা, প্রভৃতি বিচিত্র বিষয়ের পালা রয়েছে। এই সমস্ত পালা গাওয়া ও পূজার পুরোহিতের কাজ করার অধিকার থাকতো পণ্ডিত সম্প্রদায়ের ওপর। বাহুতে তাঁরা তামা ধারণ করতেন। ধর্মঠাকুরের গাজন উপলক্ষেও এই সংগীত পরিবেশনের রেওয়াজ আছে। শূন্যপুরাণের গান কাব্যপ্রধান। শস্যশ্যামলা বঙ্গভূমির যেমন অপূর্ব কাহিনি আছে, তেমনই তখনকার বাংলার নানা বৃক্ষ ফল ফুল পাতার মহিমা আছে। আর আছে বিচিত্র ধরনের শস্যের বন্দনা।
ডাক ও খনার বচন সংগীতের ইতিহাসে তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলেও অনেক সময়েই এগুলো পাঁচালি আকারে গাওয়া হয়েছে। ছড়ার ধর্ম এই বচনগুলির কাঠামোতে থাকলেও তৎকালীন গ্রামীন পরিবেশে এগুলির সুর ছড়িয়েছিল নানাভাবেই। ডাক একজন গোপ, খনা তো সভারত্ন মিহিরের স্ত্রী। খনার চেয়ে ডাকের বচন প্রাচীন। তবে খনার বচন প্রচলিত ছিল বেশি। কখনো কখনো এগুলো একসাথে মিশে গেছে। দীঘিখনন, বাঁধনির্মান বৃক্ষরোপণ- মনুষ্যমঙ্গলের এসমস্ত বিষয় এই গুলিতে এসেছে। একরকম বন্দনা গাওয়া হয়েছে। ডাক ও খনার ভাবনার মধ্যে পার্থক্য ছিল। বাংলা গানের অন্তরে তাদের প্রভাব পড়েছিল। জ্যোতিষ, গণিত, প্রকৃতির রূপ, আবহাওয়া বিজ্ঞান, কৃষি ইত্যাদি বিষয় রহস্য জালে লিপিবদ্ধ হয়েছে। নানান সংস্কার কখনো বা কুসংস্কারে মোড়া এগুলি। খুব প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষে ভাবে এই বচনগুলিও বাংলা গানের অন্দরে প্রবেশ করে গেছে।
বাংলা সংগীতের ক্ষেত্রে গীতিকথা, পল্লীগীতিকা ও রূপকথারও স্থান রয়েছে । বাংলা সংস্কৃতির মধ্যকালে বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগৃহীত এই সমস্ত কাহিনি পালাগানের মতো করে পয়ারছন্দে রচিত। গীতিকথা ও রূপকথা থেকেও পল্লীগীতিকা গুলোতে সংগীতধর্ম অনেকটাই বেশি। এই গীতিসংগ্রহ করার আগে থেকেই বঙ্গভূমির নানা প্রান্তে এগুলো গাওয়া হতো বলে জানা যায়। বাংলার নরম মাটিতে গড়ে ওঠা মানুষের অন্তরে ত্যাগ ও প্রেমের যে মহিমা ছিল তা এই সংগ্রহ থেকে পাওয়া যায়। বাঙালি হৃদয় স্বাধীন ভাবে এখানে প্রকাশিত হবার অবসর পেয়ে ভাষা পেয়েছে।
গীতিকথায় অলৌকিক গাথা ও তান্ত্রিকতার উপাদান আছে। মালঞ্চমালা,পুষ্পমালা, শঙ্খমালা, কাঞ্চনমালা,কাজলরেখা প্রভৃতি কাহিনি। অনেকে মনে করেন এগুলোই বাংলার কথা সাহিত্যের পূর্বাভাস। এগুলো উপাখ্যানধর্মী গান। এই গানের মর্ম বাঙালির মননের ভেতরকার কথা। দক্ষিনারঞ্জন মিত্র মজুমদার রূপকথায় এগুলো ধরে রেখেছেন। মানুষের কল্পনার জগতে এই সমস্ত বিষয়ের গুরুত্ব অনেকখানি। পল্লীগীতিকাগুলি এই আলোচনায় খুব গুরুত্বপূর্ণ। নানা সময়ে সংগ্রহ করা গান অনেকগুলি পালায় বিভক্ত। মঞ্জুর মা, কাফেন চোরা, ভেলুয়া, হাতীখেদা, আয়নাবিবি, কমলা সদাগর, গোপিনী কীর্তন, বার তীর্থের গান প্রভৃতি সহ মহুয়া, মলুয়া, চন্দ্রাবতী, দেওয়ান ভাবনা, কমলা, দস্যু কেনারাম, রূপবতী, কঙ্ক ও লীলা, কাজলরেখা, দেওয়ান মদিনা প্রভৃতি গান নানান পালা আকারে পূর্ববঙ্গ সহ নানা স্থানে গাওয়া হতো। এই সমস্ত গানে নারী চরিত্রের প্রেমের আদর্শ স্বমহিমায় প্রকাশিত। তাই জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল খুব। ময়মনসিংহ সহ বাংলার ভিন্ন ভিন্ন প্রান্ত থেকে এই পল্লীসঙ্গীত গাথা যাঁরা সংগ্রহ করেছেন তাঁরা বলেছেন মানুষের মুখে প্রচারিত গানগুলির অনেকটাই সংগ্রহ করা যায়নি। অনেকেই তা ভুলে গেছেন, অনেক গাথাই তখন বিস্মৃতপ্রায়। পণ্ডিত দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন, "এই সকল গান অধিকাংশ চাষাদের রচনা। এইগুলির অনেক পালা কখনোই লিপিবদ্ধ হয় নাই। পূর্বে যেমন বঙ্গপল্লীতে কুন্দ ও গন্ধরাজ ফুটিত, বিল ও পুস্করিণীতে পদ্ম কুমুদের কুঁড়ি বায়ুর সঙ্গে তাল রাখিয়া দুলিত- এইসকল গানও তেমনি লোকের ঘরে ঘরে নিরবধি শোনা যাইত ও তাহাদের তানে সরল কৃষকপ্রাণ তন্ময় হইয়া যাইত। ফুলের বাগানে ভ্রমরের মতো এই গানগুলিরও শ্রোতার অভাব হইত না।"(চলবে)
------
4 Comments
তথ্যনিষ্ঠ রচনা ।ভাল লাগছে ।গদ্যভাষা আকর্ষনীয়।
ReplyDeleteতথ্যনিষ্ঠ রচনা ।ভাল লাগছে ।গদ্যভাষা আকর্ষনীয়।
ReplyDelete
ReplyDeleteবাংলা গানের যে এত বিস্তৃতি তাকে ঠিকমতো ধরে
পরিবেশন খুব কঠিন কাজ। লক্ষ্য সফল হোক।
আকর্ষনীয় রচনা। পড়ছি। অত্যন্ত ভালো লাগছে/ পার্থপ্রতিম আচার্য
ReplyDelete