জ্বলদর্চি

সেমিকোলনের আত্মজীবনী ||পর্ব -২


সেমিকোলনের  আত্মজীবনী || পর্ব -২ 

সা য় ন

ঢপের তেলে চপের জীবন

২০১৩ সালে কলেজ পাশ করেছি। আমার মরুদ্যান জীবনের একটা অংশের ইতি টানব, এমন সময় একটা প্রশ্ন করল সময় -  "এরপর কি করবি?" আমি তো মুদি দোকান, থিয়েটার হল কিংবা বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়তে পারব না! মাসকাবারি জুঠবে না কবিতাপাঠ শুনিয়ে । তাহলে ? এমন সময় একদল " দাদার দাদারা বললেন/ ইংরেজি অনার্স ? / খেতে পাস না ইংরেজি বুঝবি?" (এরপর কী?) এই পোড়া বাংলায় ইংরেজি ও ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাঝে যে সোশাল ডিস্ট্যনসিং তাই নিয়ে কেউ কবিতা লিখেছেন ? বইয়ের কভার উল্টে দেখি - 'ঢপের চপ', কবি সুবোধ সরকার । 
সাত বছর ধরে উল্টো ফুটে সত্যকে দাঁড় করিয়ে বইটা আমাকে ঢপের জীবনটা দেখাচ্ছে। কবির চোখের আয়না আজও হাতে নিয়ে ঘুরছি । 
ঢপের চপ : ১ 

রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি কবিদের বৃন্দাবন রবীন্দ্র সদন, নন্দন চত্বরে চলে আসি। বইটা ঘোড়ার ঠুলির মতো আমার দু চোখে বাঁধা । সামনে সুবোধ সরকার । যাওয়ার কথা ছিল বাড়ি , নিয়ে এলো একটা মঞ্চের সামনে। দেখলাম - 
" মঞ্চে কবিতা পড়তে উঠে মাইকে দাঁড়িয়ে আমি যখন 
' ভালো জায়গাটা কোথায়?' বলতে শুরু করলাম
দেখি আমার মুখ দিয়ে কোনো বাংলা বেরুচ্ছে না
তার বদলে বেরিয়ে আসছে : কক ক ককর কক।"
( উপমহাদেশের একটি দেশে আমি কবিতা পড়তে গিয়েছিলাম) 
এসব কি আজে-বাজে কথা বলছেন! কবি বললেন, ওমা কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে তুই জানিস না-  নিজের কবিতা পড়েই সবাই ভ্যানিশ হয় - অন্যরা কবিতা না কোকশাস্ত্র আবৃত্তি করল তাতে আধুনিক বাংলা কবিতা ও কবির কিসসু যায় আসে না। চল তোকে বরং খালাসিটোলা নিয়ে যাই ....... 

ঢপের চপ :২ 

আমি বইটা কাঁধ থেকে, মুখ থেকে, চোখের নিচে রেখে দেখি - এতো একটা 'অটোবাযো়গ্রাফি'। সেমিকোলনের ভাষায় লেখা। কবি হেসে বললেন " এই যে সেমিকোলনের সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক তৈরি হল তা খুব সুখের নয় । এরপর ৩৭ বছর ধরে অজস্র সেমিকোলন আমার জীবনে এল। চলেও গেল। কোথা থেকে যে সেমিকোলন আসে, কোথায় যে চলে যায়, সে এক রহস্য।" ( আমার কবিতা, আমার জীবন)
 মায়াকভস্কি, পাবলো নেরুদা,জীবনানন্দ দাশ, কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মণীন্দ্র গুপ্ত, আরও অনেকে মিলে বলে উঠলো 
" তোকে মদ দিতে হবে না/ তুই একটা সেমিকোলন কুড়িযে় নিয়ে আয়" ( এটাই হল আমার আসল অটোবাযো়গ্রাফি)
তার মানে কবির জীবন শুধু কাব্য নয়, একটা বিকশিত সেমিকোলনে মেরুদণ্ড ঋজু হয় । এখন সত্যিই বলতে ইচ্ছে করছে - "আমার কথা একটাই : একটাই আমার কথা/ আপনারা সবাই আমাদের জ্ঞান দিয়ে গেলেন, স্যর/ রুটি দিয়ে গেলেন না।" (পঁচিশ বছর ধরে)
পঁচিশ বছর ধরে একটা রুটি আর একটা কবিতার মধ্যে যে সংগ্রাম তার আখ্যান কোন সাহিত্যের ইতিহাসে লেখা আছে? কবি হো হো করে হেসে উঠলেন .........

ঢপের চপ : ৩

"আমি কাঁচামাল সংগ্রহ করি এভাবে। সব কাঁচামাল থেকেই যে কবিতা হবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই।" নিকানো পাররা এই অমোঘ উচ্চারণ করতেন। পাররা বেঁচে থাকলে এখন একটা নতুন কাঁচামালের কথা তাঁকে বলতেই হত - অ্যান্ড্রয়েড ফোন। এটাই এখন বাংলা কবিতার সবচেয়ে বড় ঢপ ও বিশ্বাস। এই গোটা বন্দি জীবনটা একটা ঢপ হয়ে ফেসবুক লাইভে চিৎকার করতে থাকে দিন রাত। বাধ্য হয়ে - " আমি এডিটরকে লিখলাম :/ স্যার , সোনাগাছির ভেতরে যে নরক/ তার চাইতে অনেক বড় ভয়ংকর নরক/ সোনাগাছির বাইরে - যেখানে আপনি থাকেন,আমি থাকি/ আপনার চোখ নেই? আপনি কি ঢ্যামনা?" ( নরক সম্পর্কে আমাকে একটি প্রতিবেদন পাঠাতে বলা 
হয়েছিল)
ফেসবুক থেকে সোজা বেরিয়ে আমরা তাজমহলের সামনে দাঁডা়লাম..... 

ঢপের চপ: ৪

ইতালীয় একটি প্রবাদ মাথায় এল "   Pigs and Poets are honoured after Death"। কবিদের ক্ষেত্রে, শুয়োরের ক্ষেত্রে যা বিধান শাজাহানের জন্য তা হয় না। ভারতেশ্বরের কথা নিয়ে তখনও প্রেমের কাব্য লেখা হত এখনও গাওয়া হয় বীরগাথা। ছোটবেলা থেকে আমরা ইতিহাস পড়ে বড় হই , কিন্তু বড়রা শেখাতে ভুলে যান ইতিহাসের আগে একটা 'ঢপ' নামক বিশেষণটি কি , কারণ - " আমরা তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে / শাজাহানের খারাপ বাযো়ডেটা নিয়ে ভাবি না/ .... শাজাহান আসলে নিজেকে ভালোবেসে/ একটা ঢপের চপ রেখে গেছেন মরপৃথিবীতে।" ( ঢপের চপ)
সত্য হল এমন একটা পিঁপড়ে যা অনায়াসেই কামড়ে দিতে পারে অটোক্র্যাটের "গোলাপের মাথায়"।
বইটা কাঁধে নিয়ে আমি ওই পিঁপড়েটাকে এখনও খুঁজে যাচ্ছি । চারপাশে মানুষের এই পাল্টে যাওয়া, ক্ষমতার জুতো চেটে ক্যামেরায় বুদ্ধিজীবী সাজে। শহুরে ভণ্ডামি আর সম্পর্কের মধ্যে গেঁথে রাখা ল্যান্ডমাইনস নিয়ে ঘুমোতে আর ভালো লাগে না। বাড়ির বাইরে এ পাড়া ও পাড়া, আইটি সেক্টর, নন্দন, বিশ্ববিদ্যালয়ে কান পেতে বুঝতে পারি - " আসলে যারা সফল হন তারা জানেন না/ সফলদের সঙ্গে/ হেরে যাওয়াদের একটাই ব্যবধান/ একজন হো হো করে হাসতে পারে/ আর একজন হো হো করে হাসতে পারে না।" ( একটা হেরে যাওয়া লোক)

ঢপের চপ আর অ্যন্টাসিড :

এমন সময় একটা প্রেম করতে পারলে বেশ ভালো হত। কবি মুখ ঘুরিয়ে বললেন -  "লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, বিশ্বাস করুন/ আমি আর প্রেমে পড়তে চাইনি/ আমি ভেবেছিলাম, এবার আমার ছেলে প্রেম করুক/ অত কামু কাফকা পড়তে হবে না" (বুড়ো শালিকের বল ড্যান্স)
কবি এগিয়ে বইটা হাতে তুলে দিলেন, অটোগ্রাফ দিলেন , আর বললেন - ৩৭ বছর ধরে আমি এই বইটা নিয়ে হাঁটছি, আর তুই মাত্র ৭ বছর। এবার আমাকে টেবিলে বসতে হবে, তার তুই হাঁটবি বাকিটা পথ। কবি অদৃশ্য হয়ে গেলেন " কী আশ্চর্য কী সুন্দর কী অপূর্ব - কেউ নেই, একটা বিড়ালও নেই/ এসে জিজ্ঞাসা করবে, আপনি কে কী হয়েছে আপনার?" ( কী হয়েছে আমার?)
ফুটপাথ থেকে উঠে দেখি গোটা দেশ হঠাৎ শূন্য । ওযে়লিংটন স্কোযা়র থেকে ওয়াশিংটন - একটা আঠালো ভাইরাস আমাদের জ্যোৎস্না, গান্ধিজী, আর মায়াবনবিহারিনীকে গ্রাস করতে এগিয়ে আসছে। সুপ্রিম কোর্ট থেকে শান্তিনিকেতন পর্যন্ত, কিংবা আরিস্ততল থেকে নরক পর্যন্ত যে ব্ল্যাকহোল আমরা তৈরি করেছি  - তার ভিতর থেকে ঢপগুলো আসলে ভাইরাস হয়ে গেল!
উপমহাদেশ আর কলোনির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি , একজন পুলিশ বলল, হাতে বই কেন? স্যনিটাইজার কই - মুখে মাস্ক পড়ুন । গণতন্ত্র মুচকি হেসে বলল " আমরা কি আসলে প্রতিদিন কোনও না কোনও/ নোংরা হাত থেকে রুটি নিয়ে সন্তানকে খেতে দিচ্ছি না?/ নিজেও কি খাচ্ছি না?" ( রুটি)

--

Post a Comment

0 Comments