জ্বলদর্চি

পাবলো নেরুদা / সন্দীপ কাঞ্জিলাল


স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল


"কবিতা জল দেবে মাঠে, ক্ষুধার্তকে দেবে রুটি, 
কবিতা এঁকেবেঁকে চলবে পাকা গমের ক্ষেতের মধ্য দিয়ে "।
      - পাবলো নেরুদা 


পাবলো নেরুদা 
(১২/০৭/১৯০৪ ---- ২৩/০৯/১৯৭৩)

সারা দেশ জুড়ে যখন বিভীষিকার অন্ধকার, চারিদিকে শেয়াল শকুনের চীৎকার, এই আলোছায়া পরিবেশে কারা মালা হাতে দাঁড়িয়ে? কার শরীর  শোয়ানো মাটিতে! এইতো, এইতো দেখতে পাচ্ছি, মার্কস-লেনিন, কাফকা-কাম্যু, মার্কেজ, লুই আরাগঁ আরও অসংখ্য উদ্বেলিত জনতা। প্লাবনের মধ্যে অজস্র মানুষ তাদের কান্না আর ফুল নিয়ে এসেছে শ্রদ্ধা জানাতে। ফ্যাসিস্ত সরকারের নির্দেশ, কোনো মিছিল নয়। শ্লোগান নয়। কে শোনে কার কথা। ভিড় দেখে পুলিশ ও ধরেছে সাংবাদিকের ছদ্মবেশ। হঠাৎ ভিড় থেকে শ্লোগান উঠলো - "কমরেড নেরুদা"। আর তৎক্ষনাৎ পুঞ্জিত কোরাস, 'এই  যে এখানে'।    সৈন্যরা বেয়নেট নামিয়ে মাটির দিকে মুখ, তারা এসেছিল মিছিল আটকাতে। একজন গরীব বুড়ো চাষি নিজের স্বরচিত কবিতা পাঠ শোনাচ্ছে, মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে। মারা গেছে "পাবলো নেরুদা"।
 যার প্রকৃত নাম 'নেফতালি  রিকার্দো রেয়েস বাসোয়ালতো'। ১৯০৪ সালের ১২ জুলাই উত্তর চিলির ছোট্ট পারলাল -এ নেরুদার জন্ম। ছোটোবেলা কাটে তেমুকো-তে। বাবা 'হোসেদেল কারমেন রেয়েস মোরালেস'। চাষি পরিবার। বাবা কাজ করতেন এক রেল কোম্পানিতে। দু মাস বয়সে মা মারা যান। বিমাতার কাছে পালিত। পরীক্ষায় অঙ্কে কম নম্বর পেয়েও কবিতা লেখার জন্য পাছে বাবা বকাবকি করে, তাই ছদ্মনাম 'পাবলো নেরুদা'। বাবা চাইতেন ছেলে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করুক। তিনি এই ছদ্মনামটি নিয়েছিলেন চেক কবি 'জেন নেরুদা' থেকে। 
'মার্কেজ' এর ভাষায় বিশ শতকের সবচেয়ে বড় কবি। বিদ্রোহী ও বলা যেতে পারে। এত সাবলীল অবজ্ঞায় প্রথা ভেঙে সাধারণ মানুষের কাছে তিনি পৌঁছে যেতেন। 
নেরুদার কাকা 'ওরলান্ডো মাসসোন' এর কাগজে তার প্রথম কবিতা এবং প্রবন্ধ প্রকাশ পায়। এর আগে কলেজের পত্রিকা 'ক্লারিদাদ' এ লিখে তিনি পুরষ্কার পান। কলেজ জীবন থেকেই তার বামপন্থী রাজনীতির হাতে খড়ি। 
১৯২৩ সালে চিলির প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান 'এদিসিওনেস ক্লারিদাদ' থেকে তার প্রথম বই 'Crepusculario'(গোধূলি) প্রকাশ পায়। 
১৯২৪ সালে সান্তিয়াগোর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান "এডিটোরিয়াল ন্যাসিমেন্টো" থেকে প্রকাশ করে দ্বিতীয় কবিতার বই ''ভিন্তে পোয়েমাস দি আমোর ইউনাক্যানসিওন দেসেস পেরেদা' (কুড়িটি প্রেমের কবিতা ও একটি হতাশার গান)। এই কবিতার বইটি লেখকের বয়সের কথা চিন্তা করে উদ্দামতা ও বেআবরু শব্দচিত্রের জন্য বেশ বিতর্কের জন্ম দেয়। এই বইটির কয়েক মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়। এখনও হচ্ছে। সব থেকে বেশি ভাষায় প্রায় পঞ্চাশটি ভাষায় অনূদিত হয়। এক সদ্য যুবকের তীব্র আত্মরতি, অসম প্রেম, প্রেমের অব্যক্ত প্রকাশ ও আবেগের অসঙ্গতি সবই এ বইতে ধরা আছে। 'এলেনবুর্গ' বলেন, "এই বই এমন একজন কবির জন্ম দিয়েছে যে বাঁধাধরা সব নিয়মের বাইরে"। এরপর ১৯২৭ সালে তিনি রেঙ্গুনে কনসাল হয়ে যান। 
এইসব কবিতায় নারী শুধু শরীর সর্বস্ব সত্তা নয়। কবি সেই নারীর মধ্যে রহস্য আবিষ্কার করে প্রসারিত করে দিয়েছেন নদী, জল, গাছ, ফুল প্রায় সমস্ত বিশ্বলোক। এই বইতে রবীন্দ্রনাথের 'গার্ডেনার' কাব্যের ৩০নং কবিতা যখন আসে, তখন পাঠক অনুমান করে নেয় কবি তৈরি হচ্ছেন জীবনকে এ পৃথিবীর অংশ হিসাবে দেখার জন্য। 
১৯২৫ শে প্রকাশিত হয় 'রেসিডন্সিয়া এন লা তিয়েরবা'। এই বইতে পাওয়া যায় বিভ্রান্তিকর এলোমেলো পরিবেশ। চর্তুদিকের সব কিছু জীবন্ত, কিন্তু লক্ষ্যহীন। কবির প্রশ্ন, কোথা থেকে, কার মধ্য দিয়ে যেতে হবে কোন উপকূলে? 
এই সময় কবি এশিয়া মহাদেশে অবস্থান করছেন। হাতে বেতন নেই, সঙ্গী নেই, ইংরেজি ভালো জানা নেই, ব্রিটিশ বণিক প্রকাশকদের সঙ্গে মনের মিল নেই। তীব্র হতাশা, পানাসক্তি কবিকে গ্রাস করে। এই বইতে 'ঐক্য' কবিতায় তাই লেখেন, "আমি কাজ করি নিঃশব্দে, আমার নিজের ওপরেই ঘুরপাক খাই,/ কাক যেমন মৃত্যুর ওপর, কাক যেমন শোকের ওপর "।
নেরুদা কবিতাকে কি চোখে দেখতেন তার নিজের বর্ণনায়, " আমি অনুমান করে নিতে চেয়েছি শোষিত, দরিদ্র আর জনগণের পক্ষ নেবার সময় দ্বারা সম্মান প্রাপ্ত দায়কে। বেশ কয়েকজন পন্ডিত ব্যক্তি দায়িত্ব নিয়েছেন, আলোকে আবছায়া করে দিতে, রুটিকে কয়লা করতে, শব্দকে স্ক্রু বানাতে। এরা পারসি পুরোহিত, অস্পষ্টতার দেবতা। এই ভেজালবাজরা সমস্ত মানুষের মধ্যে সংগীতের সংযোগকে বাজেয়াপ্ত করতে চায়। আমি কোনো তত্ত্ব চিবুতে নারাজ। আমি মানুষকে আমন্ত্রণ জানাই সেখানে, যেখানে সে পেতে পারে রুটি জল"। 
মানসিকভাবে ক্লান্ত কবি নারীর কাছে সন্ধান করেন এই দুর্বলতা থেকে মুক্তি, রমণের মাধ্যমে অস্তিত্বের উষ্ণতাকে রক্ষা, পক্ষী ও পতঙ্গের পুষ্প ও উদ্ভিদের সুগন্ধে চান পরিত্রাণ, কারণ "অন্ধকারে শিকড় ছড়িয়ে দিয়ে যেতে চাই না আমি"। লোরকা ও আলবের্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব তার মনের নৈরাশ্য কাটায়। ১৯৩৩- এ বুয়েনস আইরেস এ তার বদলি, ১৯৩৪ এর মে -তে বার্সেলোনায় বদলি এবং ১৯৩৪ এর ডিসেম্বরে মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতা পাঠের বিরাট আসরে আমন্ত্রণ। ১৯৩৫ এর ফেব্রুয়ারিতে তিনি বদলি হয়ে আসেন রাজধানী মাদ্রিদে। ১৯৩৫ এর এপ্রিল মাসে  Homenaje a Pablo Neruda  নামে একটি সংকলন বেরুলে তাকে সবাই স্বীকৃতি জানায়। আর ১৯৩৫ এর অক্টোবর এ একটি লিটল ম্যাগাজিন 'কাবাইয়ো ভের্দে পারা লা পোয়েসিয়া'-র (কবিতার সবুজ ঘোড়া) তিনি হলেন সম্পাদক। 
"কবিতার সবুজ ঘোড়া" যখন বার হতে যাচ্ছে তখন 'হিমেনেথ' প্রতি সপ্তাহে নেরুদার কবিতার বিরুদ্ধে কটু মন্তব্য করতেন এক পত্রিকায়। নেরুদা যদিও বলেছেন এ আক্রমণের প্রত্যুত্তরে তিনি ছিলেন অনাগ্রহী। 
"ব্যবহার ও কবিতা" নামের আর একটি সম্পাদকীয় গদ্যে শিল্পসর্বস্ব কবিতার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেন,"যে কবিতা রক্ত দিয়ে লেখা, -যা অনুভব করা যায় একমাত্র রক্তে, তা ছাড়া আর কোনো কবিতাই টিকবে না। মধ্যবিত্ত জীবন আমার জঘন্য লেগেছে, যারা অশান্ত, অতৃপ্ত, তারা শিল্পী হোক আর ক্রিমিনাল হোক, তাদের জীবন আমার পছন্দ"। রাজনীতি ও কবিতা হয়ে উঠলো সেখানে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্বদেশের ক্ষোভ, ও উত্তেজনা, স্পেনের গৃহ যুদ্ধের অবিচারে স্ফুলিঙ্গ বিস্ফোরিত হল "রেসিডেন্সিয়া" র দ্বিতীয় পর্বে, যেখানে নেরুদা নিপীড়িত মানুষের কবি হয়ে ওঠেন শিল্পেরও সামর্থ্যে। 'ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা' র উদ্দেশ্যে লেখা 'ওড' কবিতাটির গুরুত্ব অপরিসীম। বন্ধুর আকস্মিক মৃত্যু কবিকে কান্নাতুর করলেও তিনি কাঁদতে পারেন না, বলেন, 'আমি মরে যেতে পারি সেই মাধুর্যের জন্য যা আসলে তুমি,-- ভেজা পেঁয়াজের গন্ধে ভরা সব নগরী/অপেক্ষা করে আছে তোমার জন্যে, কখন তুমি পথ দিয়ে যাবে /ঘন গাঢ় গলায় গান গাইতে গাইতে"। এই বক্তৃতাতেই তো নেরুদা বলেন লোরকা হলেন স্পেনের হৃদয়ের 'sonorous defender'। ইতিমধ্যে স্পেন পরিনত হয়েছে ধ্বংসস্তুপে।তিনি বলেন, 'হায়, যদি এক বিন্দু কবিতা বা ভালোবাসা দিয়ে শান্ত করতে পারতাম পৃথিবীর ক্রোধকে, কিন্তু তা করা যেতে পারে শুধুমাত্র প্রচেষ্টা এবং সংকল্পিত হৃদয় দিয়ে'। চিলির রাষ্ট্রদূত হিসেবে তার নিরপেক্ষ থাকারই কথা, কিন্তু প্রিয় বন্ধু লোরকার হত্যা তাকে নিরপেক্ষ থাকতে দেয়নি। বক্তৃতা দিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, সভা করলেন স্পেনীয় নির্বাসিতদের ও অন্যান্য আগ্রহীদের নিয়ে। এবার ডিপ্লোমেটিক চাকরির সম্ভাবনা গেল একেবারে, চিলির সরকার তাকে ডেকে পাঠালেন।চিলি থেকে ফেরার পথে,জাহাজে স্পেন সম্পর্কে কবিতা লেখার কাজ শেষ করেন।বইটি প্রকাশিত হয় ১৩ নভেম্বর ১৯৩৭, পরে যা 'রেসিডেন্সিয়া'র চতুর্থ পর্ব রুপে গণ্য হয়। 
এবার আসা যাক " রেসিডেন্সিয়া"র পঞ্চম পর্বে। এখানে কবিতার সংখ্যা নয়টি। তার মধ্যে দু-টি কবিতা স্ট্যানলিগ্রাদ বিষয়ক। ১৯৩৪ এর ১০ অক্টোবর নেরুদা ফিরে আসেন চিলিতে, ৭ নভেম্বর স্থাপন করেন "Alliance of Chilean Intellectuals for the defense of Culture "। " রেসিডেন্সিয়া"র শেষ পর্বের বিখ্যাত কবিতা "বোলিভারের জন্য একটি গান" ১৯০১ এবং " স্তালিনগ্রাদের জন্য নতুন ভালোবাসার গান" প্রথম পাঠ ১৯০২, ৩০ সেপ্টেম্বর রচিত হয়। 
১৯৪৮, ৬ জানুয়ারি সেনেটে যে ভাষণ দেন তা  yo acuso (অভিযুক্ত করি আমি) নামে প্রকাশিত হয়। ১৯৪৮, ৩ ফেব্রুয়ারী চিলির সুপ্রিম কোর্ট তাকে সেনেটর পদ থেকে সরিয়ে দেবার বিধান দেয়, ৫ ফেব্রুয়ারী তাকে গ্রেফতারের আদেশ জারি করা হয়। কমিউনিস্ট পার্টিও বেআইনি ঘোষিত হয়, এর সভ্যরা আত্মগোপন  করতে অথবা পালাতে বাধ্য হন। নেরুদাও আত্মগোপন করেন কয়েক মাস, বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নেন। এ সময় 'হেনেরাল' লেখা চলতে থাকে। 
১৯৪৯ সালে পান্ডুলিপি হাতে নিয়ে নেরুদা আন্দিজ পর্বতমালা পার হয়ে চলে যান। এই নির্বাসন পর্ব ছিল দীর্ঘ। তিনি পারিতে এক শান্তি সম্মেলনে যোগ দেন, তারপর প্রথমবারের মতো সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণে যান, সেখানে পুশকিন জন্মের ১৫০ তম বার্ষিকী উদযাপিত হয়। সোভিয়েত লেখকবৃন্দ তাকে সম্মান জানান। পোল্যান্ড এবং হাঙ্গারীতে ভ্রমণের পর নেরুদা ফরাসি কবি 'পল এলুয়ারে' র সঙ্গে মেক্সিকো ভ্রমণে যান।নেরুদার কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে, সবচেয়ে দীর্ঘকাল ধরে লেখা এবং আকারে বড়ো যেটি তার নাম 'কান্তো হেনেরাল', যা ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৯ র মধ্যে লেখা, ১৯৫০ সালে প্রকাশিত হয় মেক্সিকোয়।এই কাবগ্রন্থের প্রথম পর্বের কবিতা "Amor America"  (1400)-তে তিনি বলেন - "আমি এখানে এসেছি ইতিহাসের কথা বলতে"। 
"কান্তো হেনেরাল" অর্থ সাধারণ সঙ্গীত বা সার্বজনীন সঙ্গীত। এর পনেরোটি অধ্যায় এর নামগুলি হলো- ১. পৃথিবীর ওপরকার প্রদীপ (৬টি কবিতা), ২.মাচ্চু পিচ্চুর উচ্চতায়(১২ টি কবিতা) ৩. আগ্রাসনকারী(২৫টি কবিতা) ৪. মুক্তিদাতারা (৪৩টি কবিতা) ৫. প্রতারিত সেই ভূমি (৪টি কবিতা) ৬. আমেরিকা, আমি বৃথাই তোমার নাম ধরে আহ্বান করি না(১৯ টি) ৭. চিলির সার্বিক সঙ্গীত(১৮ টি) ৮. ইয়ামা হুয়ান নামের পৃথিবী (১৭টি) ৯. ওঠো কাঠুরিয়া জাগো(৬টি) ১০. পলাতক (১৩টি) ১১. পুনিতকির ফুলগুলি(১৫টি) ১২. গানের নদীগুলি(১৫টি) ১৩. অন্ধকারাচ্ছন্ন স্বদেশের জন্য একটি নববর্ষীয় ঐকতান (১৭টি) ১৪. বিপুল মহাসাগর (২৪ টি) ১৫. আমি হই (২৮ টি)।
প্রেমের কবিতায় নেরুদা প্রচলিত শব্দ ব্যবহার করেননি। 'বডি অফ ওম্যান' কবিতায় হয়তো 'জন ডানের' মতো বলতে চেয়েছেন, "দেহ একটি গ্রন্থ, যা পাঠের মধ্য দিয়েই মন পর্যন্ত যেতে হয়"।
সব প্রেমিক বিপ্লবী হন না,কিন্তু সব বিপ্লবী প্রেমিক। নেরুদা ছিলেন প্রকৃত অর্থে বিপ্লবী। প্রথমে দেশকে ভালোবেসে ১৯৪৫সালে কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।১৯৪৬সালে কবি হয়েও দলের  প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়ানো 'গঞ্জালেস'এর জন্য, প্রচার চালান।১৯৪৭সালে খনি শ্রমিকদের শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ান।সরকারের রোষানলে পড়েন।তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়।দু বছর আত্মগোপন থাকার পর ১৯৪৯ সালে গোপনে দেশত্যাগ করেন।১৯৫২ সালে আবার দেশে ফেরেন।কবিতা লেখার জন্য মেক্সিকো থেকে নেরুদাকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। আবার অনেক দেশে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
 নেরুদা বিপ্লবী। তাই তিনি প্রেমিক। তাঁর প্রথম প্রেম বার্মাতে কনসাল জেনারেল থাকাকালীন। এখানে প্রেমে পড়েন 'জেসি ব্লিস'এর সংগে।তাকে নিয়ে লেখেন কবিতা 'জেসি ব্লিস-১'এবং 'জেসি ব্লিস-২'।এরপর সিংহলে এসে এক তামিল মেয়েকে ভালোবাসলেন।লিখলেন কবিতা 'তামাটে মেয়ে'।বিয়ে করেন তিনটি। প্রথম বিয়ে১৯৩২সালে 'ভগেলজানজিন জাভা'।দ্বিতীয় বিয়ে 'দেল ক্যারিল'১৯৪৫সালে।১৯৬৬সালে বিয়ে করেন 'মাতিলদে'কে।মৃত্যু পর্যন্ত ইনি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তাই তিনি লেখেন,"নারী  দেহ,আমি তোমার মাধুর্যের মাঝে বেঁচে থাকবো"।
নেরুদা ভারতবর্ষে তিন বার এসেছিলেন। দেখা হয় রবীন্দ্রনাথ, শক্তি চট্ট্যোপাধ্যায়ের সাথে।রবীন্দ্রনাথের "তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা -------" গানটির তিনি অনুবাদ করেছিলেন।তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলন,"আমি ভারতবর্ষের সামাজিক অবস্থা দেখে বেশ নাড়া খেয়েছিলাম। এই বিশাল,নিরস্ত্র দেশটি কিভাবে সাম্রাজ্যের জোয়ালে বন্দী। ইংরেজ সংস্কৃতির প্রতি যা-ই একটু ভালো লাগা ছিল এর ফলে ঘৃণা জন্মেছিল"।
তিনি তাঁর অনুলিখনে লিখেছেন, একজন কবি চুমুও খায়,থাপ্পড় খায়,আদরও পায় লাথিও পায়।কবি কখনো ঈশ্বর নয়।কবিতার শত্রু কবি নিজে। ১৯৭১ সালে সারাজীবনের সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরষ্কার পান।তিনি সেখানে বলেন,"কবিতা লেখার ফর্মুলা নেই। কবিতা সম্মানিত হয় রাস্তায় নামতে পেরে।সংগ্রামের পর সংগ্রামে অংশীদার হয়ে।কবিতা হল বিদ্রোহ। কবি হবেন স্বেদ,সুরা,রুটি ও পরিশ্রমী মানুষের স্বপ্নের শরিক"।
 'চে গুয়েভারা' ১৭ বছর বয়সে তাঁর প্রেমিকাকে নেরুদার কবিতা শুনিয়েছিলেন। চে যখন বলিভিয়াার উদ্দেশ্যে যান তাঁর স্ত্রী র কাছে রেখে যান নিজের গলায় রেকর্ড করা নেরুদার কবিতা। যখন ধরা পড়েন চে, তাঁর কাছে ছিল নেরুদার কবিতার বই।
নেরুদা ১৯৪৩ সালে পান 'মোরেলিয়া' বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি.লিট।১৯৪৫সালে চিলির জাতীয় পুরষ্কার। ১৯৫৩ সালে লেনিন শান্তি পুরষ্কার। ১৯৭১ সালে আজীবন সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরষ্কার। এছাড়াও জীবনভোর আরও অনেক পুরষ্কার সাহিত্যের জন্য।১৯৭৩ সালে আগস্টে ক্যান্সার ধরা পড়লো পাবলো নেরুদার। ১৪ আগস্ট রাতে নেরুদার বাড়ি আক্রমণ করল রাষ্ট্রপতি 'পিনশো'র সৈন্যদল। নেরুদা কমান্ডারকে বললেন, " দেখো চারপাশ। এখানে মাত্র একটি বিপজ্জনক জিনিস- পাবে, তা হলো কবিতা "।
১৮ই আগস্ট চিলির স্বাধীনতা দিবস নেরুদাকে ভর্তি করা হল হাসপাতালে। মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত বিমানের ব্যবস্থা করলো নেরুদাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সরকার তার হাসপাতালের ঘর থেকে, টিভি সংবাদপত্র, ফোন সব সরিয়ে নিলেন, কোনরকম যোগাযোগ করতে পারলেন না।অবশেষে ১৯৭৩ সালের ২৩ শে সেপ্টেম্বর সব শেষ। বাতাসে ভাসতে থাকলো কবিতার পঙক্তিগুলি - " জেনারেলের দল/ বিশ্বাস ঘাতকের দল/ তাকাও আমার মৃত বাড়ির দিকে / তাকাও ভেঙেচুরে যাওয়া স্পেনের দিকে/ যা শিয়ালের দল এমনকি শেয়াল ও খারিজ করতে পারে"।
কবির মৃত্যুর পর তার সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সব সরকার দখল করে নিল।অথচ যা আগে থেকে দেশের কমিউনিস্ট পার্টি কে দান করা ছিল। কোথায় যেন দূরের অন্ধকার থেকে ভেসে আসছে,"আলো করে দাও সব  কুঠার যা চকচক করে উঠছে তোমার রক্তে"।

-----

Post a Comment

0 Comments