জ্বলদর্চি

হারিয়ে যাওয়া ঝিঁঝি পোকা / পর্ব -৪


হারিয়ে যাওয়া ঝিঁঝি পোকা 
পর্ব-৪

 সু দ র্শ ন  ন ন্দী  

ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা,
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা;
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে যে স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি;

গ্রাম আর চাষবাস সমার্থক। মূল ফসল ছিল ধান। তখন বর্ষায় ধান লাগালে তিনমাস লাগত পেকে ঘরে ওঠাতে। পুরো চাষই ছিল বর্ষানির্ভর। তবে পাশের ছোট খাল বিল থেকে প্রয়োজনে ডিঙিতে করে জল নিয়ে মাঠে পাঠানো হত। অত্যন্ত শ্রমনির্ভর এবং ভাগ্যনির্ভর ছিল চাষবাস। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেরা মাঠে যেত চাষবাসের কাজে বাবা কাকাদের সাহায্য করতে। গ্রামে এসে তাদের সাথে আমিও যেতাম। চাষের কাজ বলতে ধানচাষের জন্য জমি তৈরি করা, সার দেওয়া, ধান রোয়া, জল পাওয়ানো, মাঝেমাঝে ওষুধ দেওয়া। তারপর পাকাধান কাস্তেতে কেটে আঁটি বেঁধে গরুর গাড়িতে এনে খামারে তোলা। এরপর কাঠের পাটাতনে চলত ধান ঝাড়াই। মেশিন যন্ত্রপাতির বালাই ছিল না।  সব কাজই হত ম্যানুয়েল। ঝাঁড়াই ধান থেকে তুষ ধান হাওয়া দিয়ে  ঝেড়ে সেদ্ধ করতে হত। সেদ্ধ করার কাজ করত মা ঠাকুমারাও।  এসব পর্যন্ত গ্রামেই হত। অনেক ঘরে ঢেঁকি ছিল চাল বা চালের গুড়ি কুটতে। আমরা ছেলেবেলায় ছিলাম কাঠবিড়ালের ভূমিকায়। ডাব্বাওয়ালাদের মতো ঘর থেকে মুড়ি বা পান্তাভাত নিয়ে গেয়ে কাকা জ্যাঠাদের পৌঁছে দিতাম। কত্তামা খেয়াল করে কাঁচালঙ্কা, ছাঁচি পেয়াজ, তিলের বড়া থেকে কুমড়োর ঘ্যাট সাজিয়ে দিতেন। আমরা গামছা বেঁধে আল ধরে পৌঁছে দিতাম সেই স্বাদিষ্ট লাঞ্চ।  মাঝে মাঝে বায়না ধরতাম লাঙ্গল টানার।  সে সখও মিটত। লাঙ্গলের ফাল’কে মাটিতে চাপ দিয়ে টান দিতাম গরুর লেজ ধরে। বলাবাহুল্য কচি হাতের চাপে শক্ত মাটি হাসত।  বোধ হয় গরুগুলোও হাসত। কারণ তার কোনও কষ্ট ছিল না। কাকা বলতেন এই বয়সে লাঙ্গল ধরলে এক কাঠা জমিও সারা বছরে চাষ হবে না রে।  অতঃপর আরামদায়ক কাজটি করতাম জমি লাঙ্গল দেবার পর।  লাঙ্গলের পর মই টানা হত মইতে চেপে। আহা সে কি আনন্দের ! প্যাটেল করা নেই, নেই হাঁটা । কাঠের পাটাতনের উপর দাঁড়িয়ে বিনা টিকিটে ঘোর আর ঘোর । তবে ধান কাটার সময় কাস্তে হাতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিলাম ঐ বয়সেই। কচি হাতে ধান রুইতেও শিখেছিলাম। মনে হয় শহরে না এলেও চাষবাস করে অন্ততঃ না খেয়ে মরতাম না। এদিকে ধানের চারা বড় হলেই কাঁধে খালুই ঝুলিয়ে ছিপে কেঁচো গেঁথে জমিতে জমির জলে চ্যাং, গড়ুই, ল্যাঠা মাছ ধরার আনন্দই ছিল আলাদা। সারা দুপুর সেসব ধরে ঘরে ফেরা। বকাঝকা, কোথায় গিয়েছিলি কোন কৈফিয়তের বালাই ছিল না। ধান কাটার পর জমিতে যে ধানের শিষ পড়ে থাকত তার ব্যক্তিগত  মালিক ছিলাম আমরাই। এই ধান সংগ্রহ করে এবং ইঁদুর গর্ত থেকে ধান উদ্ধার করে তা বিক্রি করে দু চার আনা পেতাম। সেই পয়সা কাজে লাগত মকর পরবে। সাকুল্যে আটআনার হয়তো বাণিজ্য হল কিন্তু আনন্দটা আদানি-আম্বানি থেকে যে কম ছিল না হলপ করে বলতে পারি। ধান পালুইয়ে জমা হলে হত ঝাড়াইয়ের কাজ।  ঘরের বাখুলে ছিল বিশাল মরাই।  সেই মরাইয়ে রাখা হত ধান।  তার আগে একদিন খামার পুজো হত।  সেদিন  সন্ধেতে শিয়াল যতক্ষণ  না ডাকত ততক্ষণ  সম্পূর্ণ হত না পুজো। ধান ছাড়াও হত সব্জী চাষও। হত পান চাষ। বরুজে পান বাঁধতাম জুনঘাস দিয়ে।  তবে সাপের ভয়ে খুবই কম পা মাড়াতাম। আখের চাষ মন্দ হত না।  আমরা সারা বছর ওত পেতে থাকতাম আখ কখন বড় হবে।  আখ চুরি করে তাড়াহুড়ো করে খেতে গিয়ে দাঁত ভেঙেছি গণ্ডা খানেক। আখ ছাড়াও  চুরি করার আইটেমের মধ্যে আমার ফেবারিট ছিল শীতকালের মটর শুঁটি আর শশা। জমি থেকে চুরি করে ফেরার সময় “পাহারাদার” কাকতাড়ুয়ার কান দুটি কষে মুলে দিতে ভুলে যেতাম কদাচ।
চাষবাসের পর্ব হালকা হলে বসত যাত্রাগানের পালা।  কদিন পর আসত মকর উৎসব।  তার আগে দুর্গাপূজা, কালিপূজা।  টাকাপয়সার জোর না থাকায় দুর্গাপূজা সেভাবে হত না গ্রামে। সে আনন্দ পুষিয়ে নিতাম বিষ্ণুপুরে।  মল্লরাজাদের উনিশদিন ধরে পুজোর অষ্টমী ছিল মুখ্য। রাজ দরবারের অদূরে মূর্চা পাড়ে  কামান দাগা দেখতে সকাল থেকে ক্যাপ, মুড়ি ফটকা, দুদমা নিয়ে রেডি থাকতাম।  সে অন্য প্রসঙ্গ। তবে কালি পুজোয় পাটকাঠি জ্বালিয়ে  ইঞ্জলি পিঞ্জলি ধো  মশা ছন্দ কাটতে কাটতে  গ্রামের চারদিকে ছুটতাম।  ফিরে এসে কত্তামার হাতে পিঠে খাওয়া যেন এখনো জিভে লেগে রয়েছে। এসময় এবং অন্যসময় আটচালায় অষ্টম প্রহর বা চব্বিশ প্রহর হত। হত নাম সংকীর্তন। দূরের গ্রাম থেকেও ভেসে আসত সেখানে অনুষ্ঠিত হওয়া হরি নামের মাতাল করা সুর। পুরো গ্রামকে এক ছাতার নীচে নিয়ে আসত এই নাম সংকীর্তন। মানুষে মানুষে এই আত্মিকতা সুদৃঢ় হবার পিছনে ভক্তিরসের শক্তি কতো সুদৃঢ় আজ আর আমরা সেভাবে ভেবে দেখি না।  দেখিনা বললে ভুল হবে, আসলে সময় নেই ভাববার।

-----

Post a Comment

1 Comments