জ্বলদর্চি

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল -৯


অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল || পর্ব -৯

স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল

বুদ্ধিজীবী গুণবাচক বিশেষণ 
 
বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত পণ্ডিত দার্শনিক 'জুলিয়েন বেন্দা' বলেছিলেন, যিনি বলতে পারবেন, "এই পৃথিবী আমার রাজ্য নয়। তিনি বুদ্ধিজীবী"! অর্থাৎ এই যে পৃথিবী, যে পৃথিবীতে মানুষ শুধু তাৎক্ষণিক, বস্তুগত লাভ, নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ, ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত থাকে বুদ্ধিজীবীর পৃথিবী সে রকম ক্ষুদ্র স্বার্থে চালিত হবে না। বুদ্ধিজীবীর কাজ হচ্ছে নিঃস্বার্থ এবং আপসহীন জ্ঞানচর্চা।বুদ্ধিজীবী বলতে আবার 'নীটশে' বলেন, "যারা নির্ভীক, জীবন রসিক, যাদের ইচ্ছাশক্তি প্রবল, কোনও সংকটেই যারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় বা ভোগবৃত্ত হয় না। তারা যেমন জীবনকে পরিপূর্ণভাবে ভোগ করে, মৃত্যুকেও তারা তেমনি স্বাগত করতে জানে"। 
আসলে অসাধারণ এই মানুষরা ধীর, স্থির, হাসিখুশি এবং বিপদের মধ্যে তারা বাস করতে ভালোবাসে। কূলকিনারাহীন মহাসমুদ্রে তারা নৌকা ভাসায়। অজেয়কে জয় করতে তারা আগ্রহী। তারা জীবনশিল্পী, কারণ তারা নিজেদের প্রয়াসে নিজেদের গড়ে তোলে। সংযমী বলেই তারা যথার্থ স্বাধীন। ইতিহাসে কোনও নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি নেই, নেই কোনও নির্ভরযোগ্য আশ্বাস। নিয়ত এই পরিবর্তনীয় জগতে কোনও স্থায়ী সম্পর্ক অসম্ভব। তাই বহমান এই অনিত্য ধারণাকে নিয়ে কোনও নির্ভরযোগ্য ধারণা, নিয়ম বা বিজ্ঞান দাঁড়াতে পারে না। নীটশের মতে যারা এই নিরুদ্দেশ গতিময়তা নিজেদের মধ্যে উপলব্ধি করেন, তাঁরাই যথার্থ বুদ্ধিজীবী দার্শনিক। তিনি আরও মনে করেন, প্রচলিত নৈতিকতা সব ওপর থেকে চাপানো। অতএব তা ভঙ্গুর ও আপেক্ষিক। বুদ্ধিজীবীরা নিরন্তর আত্ম-জিজ্ঞাসার ফলে, এই সত্য তারা হৃদয়ঙ্গম করেন এবং তাদের অভিজ্ঞতা হয় আতঙ্কের এবং আনন্দের। আতঙ্ক কারণ, যে ধারণা বা ব্যবস্থা প্রচলিত তার বিরুদ্ধে দাঁড়ালে, আক্রমণ নেমে আসতে পারে। আবার আনন্দ ও লাগে। কেননা এই তো  উপযুক্ত সময় তার ভিতরের ক্ষমতা যাচাই করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস আছে কিনা তা দেখে নিতে পারে। নীটশের বিচারে এ সামর্থ্য বেশির ভাগ মানুষের নেই। যাদের আছে, তারাই বুদ্ধিজীবী দার্শনিক ও শিল্পী। তারা স্রষ্টা ও বীর, তারা মায়ামোহমুক্ত সত্যকাম, গড়পড়তা মানুষ থেকে আলাদা। তাঁরাই ভবিষ্যতের মহামানব বা অতিমানব।
কবি শিল্পী লেখক এই বুদ্ধিজীবীর পর্যায়ে পড়েন। কারণ নিষ্প্রাণ উপাদান সমূহে তারা প্রাণ দান করেন। শূন্যতা ও নৈরাশ্যকে রুপান্তরিত করেন আনন্দে। জীবন যন্ত্রণার মোকাবিলা করে তার আনন্দ খাঁটি শিল্পীরাই জানে। সুখ দুঃখ ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাদের চেতনা 'সৃষ্টি সুখের উল্লাসে' মগ্ন থাকে। যে কোনো শিল্প উচিত অনুচিতের বাইরে। তাই নীটশের মতে, যথার্থ কবি শিল্পী লেখক দার্শনিক বুদ্ধিজীবী ও বিপ্লবী। তাই বুদ্ধিজীবীরা লোক দেখানো আতিশয্যের ধার ধারে না। তারা ভালোমন্দের সীমানা অতিক্রম করে, এক আলাদা শ্রেণী।
বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক 'কার্ল মার্ক্স'(১৮১৮-১৮৮৩) নিজের ১১নং থিসিসে ফয়েরবাখকে নিয়ে লেখার সময় বলেছিলেন, "এখনও পর্যন্ত দার্শনিকরা শুধু জগতের ব্যাখ্যা করেছেন মাত্র; যার মূল উদ্দেশ্য আসলে জগতটাকে বদলানো"। অর্থাৎ তিনি বলতে চাইলেন, এখনকার বুদ্ধিজীবীরা মানুষের সমস্যাগুলো তুলে ধরতে ব্যস্ত। কিন্তু সমস্যা সমাধানের পথ বাতলাতে সচেষ্ট নয়। বুদ্ধিজীবী তারা, যারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে না। তারা দুর্নীতিকে ঘৃণা করেন। তারা অন্যায় শোষণ নির্যাতন এবং অপঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। ইতালীয় দার্শনিক 'আ্যন্টেনিও গ্রামসি' তার 'Selection from prison Notebooks' বইয়ে লেখেন,"সব মানুষই বুদ্ধিজীবী একথা প্রত্যেকেই বলতে পারে, তবে সমাজে সব মানুষ বুদ্ধিজীবীর কাজ করে না"। বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে তিনি দুভাগে  ভাগ করেন -
(১) প্রথাগত বুদ্ধিজীবী। যেমন- শিক্ষক, সাহিত্যিক, যাজক ইমাম পুরোহিত ইত্যাদি। 
(২) জৈবিক বুদ্ধিজীবী- যারা পেশাগত বৈশিষ্ট্যের বাইরে, রাষ্ট্রের বিপরীতে কিংবা নেতিবাচক ও ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ভিন্নরকম কোনো বিষয়ে মতপ্রকাশ বা ভাষ্য নির্মাণের ক্ষমতা রাখেন। 
'গ্রামসি' আরও বলেন, এই পৃথিবীতে প্রত্যেক সামাজিক গোষ্ঠী, বুদ্ধিজীবী তৈরি করেন, বুদ্ধিজীবীরা  শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও থাকে। ফলে প্রত্যেক শ্রেণী বুদ্ধিজীবী তৈরি করে। যেমন পুঁজিপতির পক্ষে বুদ্ধিজীবী তারা প্রমাণ করেন, বিশ্বে যে এত মানুষ খেতে পায়না। কারণ মানুষের দারিদ্র্যতা। তিনি বলবেন না, যে দেশে কম পরিমাণ খাদ্য শস্য উৎপাদিত হচ্ছে। অথবা খাদ্যের মজুত হচ্ছে। কালোবাজারি হচ্ছে। আবার চাষী গোষ্ঠীর বুদ্ধিজীবী আছে যারা শস্যের রোগ, উৎপাদন সেচ দেওয়ার পদ্ধতি নিয়ে পরামর্শ দেয় ইত্যাদি। আবার শ্রমজীবী মানুষের, শিক্ষা সংস্কৃতি জগতেও বুদ্ধিজীবী আছেন। 
তবে এটা অবধারিতভাবে সত্য যে, বুদ্ধিজীবীরাই সমাজের প্রহরী।একটি জাতিকে নিবীর্য করে দেওয়ার প্রথম উপায় বুদ্ধিজীবী শূন্য করা। জাতির বিবেক, জাগিয়ে রাখেন তাদের রচনাবলীর মাধ্যমে, সাংবাদিকের কলমের মাধ্যমে, গানের সুরে শিক্ষালয়ে পাঠদানে, চিকিৎসা, প্রকৌশলে, রাজনীতি ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের সান্নিধ্যে এসে। বুদ্ধিজীবী যে কোনো জাতির গর্ব। তারা সহানুভূতি সম্পন্ন। অন্যের দুঃখ কষ্টকে যখন নিজের দুঃখকষ্টের মতো অনুভব করি তখন তাকেই বলি সহানুভূতি! যখন দেখি আপন কোন মানুষ যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে আমরা স্থির থাকতে পারি না। আবার পৃথিবীতে কোন না কোনো মানুষ সব সময় কষ্ট পাচ্ছে, সবার জন্য করা আমাদের সম্ভব নয় বলে, আমরা বলে থাকি সীমাহীন সহানুভূতি নিয়ে বাঁচা দুঃসাধ্য। কিন্তু বুদ্ধিজীবীর এই সীমাহীন সহানুভূতি নিয়ে তাদের পথ চলা। তাদের হৃদয় কঠিন নয় কোমল, নিষ্প্রেম নয়, প্রেমে পরিপূর্ণ। বুদ্ধিজীবীদের এইসব করার স্বার্থ কি? কারণ সাধারণভাবে আমরা জানি মানুষ স্বার্থ ছাড়া কিছু করে না। এই বুদ্ধিজীবীদের পেছনে একটাই শর্ত কাজ করে, তা হল এই সমগ্র পৃথিবী তাদের আপন! প্রতিটি মানুষ তার আত্মার আত্মীয়। বুদ্ধিজীবীরা অন্যায় অত্যাচারের জন্য গর্জে ওঠেন। তাঁরাই পারেন কোনো বিপ্লব ঘটাতে আবার যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাতে। তাদের দেখেই সাধারণ মানুষ মিলিত হয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। তারা কখনো সাধারণ মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করে না। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বললেন, "ন বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্মসঙ্গিনাম্।/ জোযয়েৎ সর্বকর্মাণি বিদ্বান্ যুক্তঃ সমাচরন্"।। (কর্মযোগে ২৬নং শ্লোক) অর্থাৎ জ্ঞানবান ব্যক্তিরা কর্মাসক্ত জ্ঞানহীন ব্যক্তিদের বুদ্ধি বিভ্রান্ত করবেন না।তাঁরা ভক্তিযুক্ত চিত্তে সমস্ত কর্ম অনুষ্ঠান করে জ্ঞানহীন ব্যক্তিদের কর্মে প্রবৃত্ত করবেন। 
বুদ্ধিজীবীরা সবসময় যেকোনো কাজে জয়ের বাসনাতেই ময়দানে নামেন। তাঁরা নিরাপত্তা চান না। তাঁরা খোঁজেন জয়ী হওয়ার সুযোগ। বুদ্ধিজীবীরা জলে ভাসা হাঁসের মতো। জলের উপরে হাঁসগুলি এমন শান্ত সরলরেখায় ভেসে যায় দেখলে বোঝা যাবে না, জলের নীচের দিকে তাদের পা অবিরাম পরিশ্রম করে চলেছে। বুদ্ধিজীবীরা বাইরে থেকে যতই শান্ত সৌম্য হোক, ভেতরে ভেতরে তারা জগতের শুভাশুভ নিয়ে মগ্ন।
একজন বুদ্ধিজীবী স্পষ্টবক্তা! তিনি কোন কিছুর পরোয়া না করে তার মতামত দেন। সম্পূর্ণ অকপট হতে গিয়ে তিনি মৃত্যু উপত্যকা পর্যন্ত হেঁটে যেতে রাজি! মৌনতা বা তোষামোদ বা মিথ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করেন না।তাঁরা ভাবেন যতক্ষণ আমি শ্বাস নেবো, ততক্ষণ আমি পৃথিবীর ভবিষ্যতের জন্য লড়বো।সেই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ যার মধ্যে মানুষ দৃঢ়তা ও সুন্দরতার মধ্য দিয়ে তাঁর আলোকিত ইতিহাস রচনা করবে। পদ বা পুরষ্কারের মোহ তাকে লালায়িত করে না। তার কাছে মূল প্রশ্ন সুবিচার ন্যায়। আর এই জীবন জিজ্ঞাসুদের চিরকাল ভয় পেয়েছে সমাজপতিরা। 'সক্রেটিস'কে বিষপাত্র তুলে দিয়েছিল? কে বা পুড়িয়ে মারলো 'জিওর্দানো ব্রুনো'কে কারা উত্ত্যক্ত করলো 'শেক্সপিয়ার'কে? কেন 'ভিকতর য়্যুগো', 'রম্যাঁ রলাঁ' দেশছাড়া কেন? বা ভলতের কে কেন বারবার নির্বাসিত হতে হয়? আর কেন বা ভারতের প্রান্তিক মানুষের কবি 'ভারাভারা রাও'এর জেল তার দ্বিতীয় বাড়ি। আমরা কি প্রশ্ন করতে পারবো না 'লুক্সেমবার্গে'র সেই উক্তি, "শুধুমাত্র সরকারের সমর্থকদের স্বাধীনতা, সেটা স্বাধীনতা নয়"।

Post a Comment

1 Comments

  1. অসাধারণ লাগলো পরিতৃপ্ত হলাম।

    ReplyDelete