জ্বলদর্চি

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল / পর্ব -৭

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল / পর্ব-৭

স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল

জ্ঞানী ও চালাক

মানুষের সহজাত বুদ্ধিমত্তার প্রধান দুটো দিক রয়েছে। একটি হল নেতিবাচক বুদ্ধি এবং অন্যটি হল ইতিবাচক বুদ্ধি। ইতিহাস বলে নেতিবাচক বুদ্ধিধারীরা সারাজীবন সময়ে অসময়ে মন্দ কাজ করে বেড়ান। যে কোনো চালাক ব্যক্তি অবশ্যই বুদ্ধিমান, কিন্তু তারা বুদ্ধিকে অন্যদিকে খাটায়, তাই তারা জ্ঞানী নয়। জ্ঞান হলো প্রজ্ঞা, জ্ঞানী মানুষ তাই প্রজ্ঞাবান। জ্ঞানী মানুষ নিজের মাথা খাটিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে। চালাক মানুষ আশেপাশের উপাদান ব্যবহার করে সমস্যার সমাধান করে। ধরা যাক ২×২= কত হবে?  চালাক ব্যক্তি বলবে এর উত্তর খুবই সোজা। আমার বন্ধুর  এ বিষয়ে জ্ঞান ভালো, এটা কী ভাবে সমাধান করা যায় সে দেখিয়ে দেবে। এই বলে সে জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে পাঠাবে। জ্ঞানী ব্যক্তি সব শুনে এর কোনো উত্তর দেবে না। কারন এটার উত্তর দেওয়ার কোনো দরকার নেই। যে সমস্যা সমাধান  করার প্রয়োজন রয়েছে সে তার উপর গুরুত্ব দেবে। 

 যেসব মানুষ নিজেকে চালাক, সে অন্যকে বোকা ভাবতে পছন্দ করে, তারা স্বভাবে হয় একচোখা ও একরোখা। নিজেরা অনেক জানে, বোঝে এবং অন্যরা কিছুই বোঝে না মনে করে। তারা জাহির করতে ভালোবাসে। চোখেমুখে নিজেরাই শুধু বলে থাকে এবং  অন্যরা তা কান পেতে কেবলই শুনবে বলে আশা করে। নিজে যা ভাবছে, ষোলো আনা ঠিক, অন্যদের ভাবনা একশো ভুল। যারা অন্যকে ছোট, দুর্বল ও ভুল ভাবতে ভালোবাসে, তাদের মধ্যে অন্যদের কথা শোনা, জানা বা বোঝার আগ্রহ কোনটাই থাকে না। এমনটা স্বাভাবিক নয়। শিষ্টাচার, সভ্যতার তোয়াক্কা না করে নিজেকে জাহির অবশ্যই আত্মম্ভরিতা এবং চালাকি। অন্যকে ছোট ভেবে অসম্মান করে নিজেকে বড় প্রমাণের চেষ্টা কৌতুককর। আমি ভালো, তুমি খারাপ। আমি সত্য, তুমি মিথ্যা। এসবই শ্রেষ্ঠ পরিচয়ের বিপরীত। অস্বাভাবিকতা। অসম্মান, অবিবেচনা, মিথ্যাচার, হিংসা যা যা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ পরিচয়কে ক্ষুণ্ণ করে, সবই চালাকি। 

ইন্ট্রোভার্ট মানুষগুলো খুব জ্ঞানী, বিচক্ষণ ও চিন্তাশীল হয়। আত্মসম্মানবোধটা তাদের প্রবল থাকে। এরা কোনো ঝামেলা পছন্দ করে না, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও পরিস্থিতি তারা খুবই ভালোবাসে। তবে কেউ তাদেরকে অপমান বা অপদস্থ করলে তারা সেটা সহ্য করতে পারে না, ঐ মানুষটির প্রতি বিদ্বেষের আগুন তাদের মধ্যে সারাজীবন জ্বলতে থাকে। এই প্রতিহিংসা তারা কখনোই ভোলে না, প্রতিশোধের নেশাটা তাদের মধ্যে থেকেই যায়। অল্প একটু আঘাতে তাদের মনে গভীর দাগ কেটে যায়, সে ক্ষত সহজে শুকায় না। এরা বিনোদন প্রিয়, বইপড়া, গানশোনা, মুভি দেখা, ছবি আঁকা এগুলো তাদের কাছে নেশার মতো। যে কোনো ধরনের পার্টি, ফাংশন, সামাজিক অনুষ্ঠান, কোলাহলময় ও জনাকীর্ণ পরিবেশ এরা এড়িয়ে চলে।নিরিবিলি ও জনশূন্য পরিবেশে থাকতে এরা খুব ভালোবাসে। এরা সরলতা ও কোমলতা খুব পছন্দ করে। তবে কেউ কর্কশ ব্যবহার করলে এরাও সাময়িকভাবে খুব কর্কশ ব্যবহার করতে পারে। সারাক্ষণ একা একা থাকার কারণে বাইরে থেকে এদেরকে আপসেট মনে হয়, যদিও তারা সেটা নয়। এরা খুব সরলভাবে হাসিখুশি মনে বাচ্চাসুলভ ভঙ্গিতে আপনার সাথে কথা বলবে, আপনি বুঝতেও পারবেন না যে এরা ভেতরে ভেতরে কতোটা চালাক ও বুদ্ধিমান। এরা অনেক কষ্টসহিষ্ণু, শত দুঃখের মাঝেও বিপথে যাওয়ার কথা মাথায় আনে না। নিজের জীবনটাকে এরা খুবই ভালোবাসে, উপভোগ করতে চায়। কোনোকিছুতে হেরে গেলে এদের মধ্যে চরম হীনম্মন্যতা কাজ করে, সহজে হার মানতে চায় না। ইতিহাসের কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তিও কিন্তু ইন্ট্রোভার্ট। তার মধ্যে একজন হলেন বিল গেটস, মাইক্রোসফট এর প্রতিষ্ঠাতা। জ্ঞানী ও চালাক মানুষের পার্থক্য উদাহরণে বোঝা যাক। 
ধরা যাক ৩ টা দরজা আছে। প্রতিটা দরজার ওপাশে নিচের বস্তুগুলো আছে।
দরজা ১. সুখ 
দরজা ২. জ্ঞান 
দরজা ৩. টাকা 
জ্ঞানী মানুষ সুখ নেবে। কেননা যার সুখ আছে তার আর কিছুর দরকার নেই। 
চালাক ব্যক্তি প্রথমে টাকা নেবে, এরপর ২য় দরজা খুলে জ্ঞান আহরণ করবে এবং সবশেষে ১ম দরজা খুলে সুখী হবে। কেউ-তো বলেনি যে একটাই দরজা খোলা যাবে শুধু!
প্লেটোর মতে জ্ঞানের তিনটি স্তর (১) ইন্দ্রিয় দ্বারা আহরিত জ্ঞান (২) মতামতের মাধ্যমে আহরিত জ্ঞান (৩) প্রজ্ঞা বা মুক্তির মাধ্যমে আহরিত জ্ঞান। ইন্দ্রিয় দ্বারা আহরিত জ্ঞান প্রায়শই মানুষকে প্রতারিত করে এবং পরস্পর বিরোধ সৃষ্টি করে। মতামতের মাধ্যমে আহরিত জ্ঞান ও ভিন্ন হয়। তাই এ ধরনের জ্ঞানকে সত্য বলে ধরে নেওয়া যায় না। কাজেই প্লেটোর মতে এ দুটি জ্ঞান প্রকৃত জ্ঞান নয়, প্রজ্ঞা বা মুক্তির মাধ্যমে আহরিত জ্ঞানকে প্লেটো প্রকৃত জ্ঞান বলেছেন। এই জ্ঞান ইন্দ্রিয় ও মতামতের ভিন্নতার কারণে পরিবর্তিত হয় না, বরং এই জ্ঞান শাশ্বত ও চিরন্তন। 
উপনিষদে "প্রথম মুন্ডক" এর দ্বিতীয়  অধ্যায়ে- "অবিদ্যায়ামন্তরে বর্তমানাঃ / স্বয়ং ধীরাঃ পণ্ডিতং মন্যমানাঃ। / জঙ্ ঘন্যমানাঃ পরিযন্তি মূঢ়া/ অন্ধনৈব নীয়মানা যথান্ধাঃ"।। (৮নং শ্লোক)। অজ্ঞানে নিমজ্জিত কিছু নির্বোধ ব্যক্তি আছেন, যাঁরা নিজেদের চালাক ও সর্বজ্ঞ বলে মনে করেন। এমন ব্যক্তিরা একটার পর একটা অনর্থে পড়েন- ঠিক যেমন অন্ধের দ্বারা চালিত হয়ে অন্য অন্ধ ব্যক্তিরা ঘুরপাক খায়। 
মানুষের যেমন দুটি রূপ থাকে- (১) ব্যক্ত আমি ও (২) গুপ্ত আমি! তেমনি মনের ও দুটি রূপ থাকে একটি স্বজ্ঞান আর একটি নির্জ্ঞান। আমরা মানুষের মনের খবর যেটা সচরাচর ভাসাভাসা পেয়ে থাকি, সেটা আসল মন নয়। কেননা একজন মানুষ মনের আসল দিকটা যেকোনো কারণেই হোক নিজের কাছ থেকে সবসময় লুকোতে ব্যস্ত থাকে! যেমন- কোনো বিবাহিত পুরুষ কোন মেয়েকে দেখে তার ভালো লাগলো। তার নির্জ্ঞান মন চাইছে তাকে কাছে পেতে। কিন্তু স্বজ্ঞান তা চেপে দিতে চাইছে সমাজের ভয়ে। তবে আমাদের যা কিছু ব্যবহার, যা কিছু চিন্তা ভাবনা সব নিয়ন্ত্রণ করে নির্জ্ঞান। অনেক সময় জেলখানার কয়েদি দারোয়ানকে ফাঁকি দিয়ে বেরোতে যেমন ছদ্মবেশ ধারণ করে অর্থাৎ চালাকির আশ্রয় নেয়, তেমনি স্বজ্ঞানকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য চালাকির আশ্রয় নেয় নির্জ্ঞান। যেমন ওপরের বিবাহিত পুরুষটি গোপনে মেয়েটিকে বলে সে অবিবাহিত। এটাই হচ্ছে চালাকি! চালাক ব্যক্তিদের মধ্যে অহংকার বোধ কাজ করে। জ্ঞানীদের মধ্যে তা থাকে না। যেমন মহাভারতে ভীষ্মের মৃত্যুর পর যুধিষ্ঠির ভাবেন, তার জন্য ভীষ্ম মারা গেছে। যুধিষ্ঠিরকে জ্ঞানী নয় চালাক ব্যক্তি ভাবেন সাহিত্য সম্রাট 'বঙ্কিমচন্দ্র'। তাই যুধিষ্ঠির বলেন, তিনি না থাকলে যুদ্ধ হতো না! তাই আমার এই রাজ্য দরকার নেই। আমি বনবাসী হব। তখন শ্রীকৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বলে, "হে ধর্ম্মরাজ।"আমি সকল করিতেছি", "ইহা আমার", "এই আমার সুখ", "ইহা আমার দুঃখ", এইরূপ জ্ঞানই অহঙ্কার। এই সকল আপনার দুঃখের কারণ।... আপনার এখনও শত্রু অবশিষ্ট আছে। আপনার শরীরের অভ্যন্তরে যে অহঙ্কাররূপ দুর্জ্জয় শত্রু রহিয়াছে, তাহা কি আপনি নিরীক্ষণ করিতেছেন না। আপনি বুদ্ধিমান কিন্তু জ্ঞানী বলাতে আমার আপত্তি রহিয়াছে"।(কৃষ্ণ চরিত্রে -একাদশ অধ্যায় -কাম গীতা)  তাহলে বোঝা গেল যাহারা প্রকৃত জ্ঞানী, তাদের মনে অহংকার থাকে না। আবার চালাক লোক জ্ঞানের অধিকারী হলেও তা কাউকে দিতে চায় না। পাছে অন্য কেউ তার সমকক্ষ হয়ে ওঠে। কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তিরা জ্ঞান দান করেন। কারণ, সে জানে সে মারা গেলে তার জ্ঞানও মারা যাবে।

----

Post a Comment

0 Comments