জ্বলদর্চি

হিমালয়ের পথে চলতে চলতে -৭

হিমালয়ের পথে চলতে চলতে || পর্ব- ৭

 দে ব ব্র ত   ভ ট্টা চা র্য্য 

 কেদারনাথ দর্শন
        
রামওয়াড়া নামটা অনেক বার শোনা হ'ল ।হিমালয় পথিক উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এর লেখায় পড়েছিলাম বিংশ শতকের গোড়ায় কেদারনাথ যাত্রার পথ ছিল গুপ্তকাশী থেকে নালাচটী হয়ে মৈখণ্ডাচটী। এখানে একটি দোলনা ছিল। যাত্রীরা ঐ দোলনায় বসে বিশ্রাম নিতো। তাই এ চটীর নাম যাত্রীদের মুখে মুখে ঝুলা চটী। এখান থেকে যেতে হবে রামপুর চটী। এর পর শুরু হবে চড়াই পথ। সোজা কুড়ি কিলোমিটার হাঁটলে বাবার দরজায় পৌঁছনো যাবে। মাঝে পড়বে রামওয়াড়া। ওখান থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে বাবার মন্দির। 
আবার  ভারত সেবাশ্রম এর মহারাজ সন্তোষানন্দজী মন্দাকিনীর তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে রামওয়াড়ায় এক রাত কাটিয়ে ছিলেন। তাঁর কাছে এ স্থানের নাম শুনেছি। 
     এ ছাড়া গতকালই গৌরীকুণ্ডে চা দোকানে বসে রামওয়াড়ার এক করুণ কাহিনী শুনেছি। 
  এখন আমরা অন্য এক রামওয়াড়ার মাটিতে দাঁড়িয়ে। 'জয় বাবা কেদারনাথ' বলে চড়ে পড়লাম  চতুষ্পদ বাহনে। পথ আরও দুর্গম। দেখলাম পথের একপাশে নতুন করে পাথর বসানো হচ্ছে। আর একপাশ দিয়ে কোন মতে যাওয়া আসা চলছে। আগেই শুনেছিলাম এ পথ এখন বড়ই বিপজ্জনক। কিন্তু ঠিক কতটা দুর্গম সে ব্যাপারে আমাদের কোন ধারণা ছিল না। যাওয়া আসার যাত্রীরা প্রায় এ ওর গায়ে এসে পড়তে চায়। কেবল শিক্ষিত ঘোড়াদের দক্ষতা আর তাদের চালক মানুষগুলোর তীক্ষ্ণ নজর আমাদের বাঁচিয়ে নিয়ে চলেছে। 
    হঠাৎ ওপর থেকে নেমে আসা একটি ঘোড়া আমাদের সামনেই হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। তার সহিস ছেলেটির সাহসী উপস্থিতি ব্যাপারটা সামলে নিল। হীরু আমার ঘোড়াকে ছেড়ে এগিয়ে গেল। ঘোড়ার পিঠে বসা মাঝবয়সী মানুষটি ভয়ে কাঁপছেন। চোখ দুটি বন্ধ। ঠাকুরের নাম নিতেও ভুলে গেছেন বোধহয়। ছেলেদের চেষ্টায় তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আত্মগত ভাবে বলে উঠলেন -
  বাবা কেদারনাথ রক্ষা করেছেন। জয় বাবা কেদারনাথ। 
  আমরাও আর এক বাঙ্গালী পেয়ে উৎফুল্ল। আমি বললাম 
  -ভয় নেই। বাবার দর্শন পেয়েছেন। কোন ভয় নেই। 
  ভদ্রলোক বাংলা ভাষা শুনে কি ভাবে আনন্দ প্রকাশ করবেন বুঝতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠলেন 
  -জয় বাবা কেদারনাথ। জয় বাবা কেদারনাথ। 
  ততক্ষণে আগে পেছনে ব্যস্ত যাত্রীরা ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছেন 
  -জরা হটকে ভাই, সামাল কে  চলো ভাই। 
  আবার চলা শুরু। আমরা একে অপরকে সাবধান করতে করতে এগিয়ে চলছি 
 -  ভবেশদা, সোজা হ'য়ে বসুন 
  -দেবুদা শক্ত করে ধরে বসুন। 
  রাস্তা মাঝে মাঝে পথ প্রায় একশ আশি ডিগ্রী ঘুরে যাচ্ছে ।এই ঘুরপথে এগোতে এগোতে পথের দৈর্ঘ্য ছয়/সাত কিলোমিটার বেড়ে গিয়েছে। এমনি একটি বাঁকে মোচড় ঘুরতেই অবাক বিস্ময়ে দেখলাম এক নারী মূর্তি। দুটি চোখে অহংকার নেই কিন্তু প্রত্যয় আছে। করুনা নেই কিন্তু প্রশ্রয় আছে। খোলা চুল ঘাড়ের কাছে এক গুচ্ছ চুলের বাঁধনে বাঁধা। সাদা ধপধপে শালোয়ারের উপর গেরুয়া পাঞ্জাবী। সাদা ওড়না বাম কাঁধের থেকে ঝোলানো ডান পাশে গিঁট দিয়ে বাঁধা। প্রথমেই চোখে পড়বে কালো রঙের ঘোড়াটি। যেন বনদেবী পাহাড়ের কোল থেকে নেমে এলেন। তাঁর হৃদয়ের গভীরে উৎসারিত দ্যুতিময় ছটা সারা পথ আলোয় ভরিয়ে দিল। পবিত্র হ'য়ে গেল সমগ্র মন প্রাণ। ইনিই হিমালয় কন্যা পার্বতী। উমাপতির চরণ বন্দনা করে নেমে আসছেন তাঁর সন্তানদের সে পুণ্যের ভাগ পৌঁছে দেওয়ার জন্য। মাতৃ দর্শনের সুখে বিভোর হয়ে গেলাম। তাঁর অঙ্গ সুবাসে এ চরাচর আমোদিত। মা যেন বলছেন 
  -যাও বাছা, যোগীরাজ মহা যোগে ধ্যানস্থ। এত কষ্ট সহ্য করে এসেছো। তিনি তো তোমাদেরই প্রতীক্ষায়। কষ্ট কি কেবল তোমাদের বাছা, তিনিও তোমাদের জন্য ব্যাকুল! 
        আমার সামনে যিনি ঘোড়া নিয়ে গলদঘর্ম তাঁকে ডাক দিলাম 
  -ও ভবেশদা -!
  কোন উত্তর পেলাম না। 
  -সব ঠিক আছে তো? আমরা কিন্তু এসে পড়লাম। 
  -ঠিকই তো ছিল। কিন্তু সব যে কেমন ওলট পালট হয়ে গেল দেবুদা! একটা বিরাট ঢেউ যেমন কুলের মানুষকে অকুলে নিয়ে যায়, তেমনি এক ঝোড়ো বাতাস বইছে আমার সারা অন্তর জুড়ে। অতীত বর্তমান ভবিষ্যত কেমন যেন একাকার হ'য়ে গেল। 
  হঠাৎ হীরুর গলা শুনলাম 
--সাব, একটু নামতে হবে যে। 
ব্যাপার কিছু বুঝলাম না। তবে কিছু একটা কারণ আছে নিশ্চয়। ঘোড়ার পিঠে চড়া যতটা কষ্টের তার চেয়েও বেশী কসরৎ করতে হ'ল নামার সময়। হীরু বলল 
  -সাব, এই দুটো 'পহেচান' গলায় পরে নিন। এখান থেকে সামান্য পথ আপনাদের হেঁটে যেতে হবে। সামনের বাঁকটা ঘুরলেই আমরা দাঁড়িয়ে থাকবো। 
      গলায় ফিতে দিয়ে আটকানো একটা সাদা কার্ড ঝুলিয়ে দিলো। উত্তরাখণ্ড সরকারের পরিচয়পত্র। পাহাড়ী চড়াই ভেঙে উঠতে বেশ কষ্ট। তবে এখন হাঁটতে খুব খারাপ লাগছে না। নড়বড়ে পাথরগুলো একটু জ্বালাচ্ছে। একটু এগোতেই ব্যাপারটা পরিস্কার হ'ল। চেকপোষ্টে সরকারী বাবুরা বসে হিসেব নিচ্ছেন। সব কুল রক্ষা করার প্রক্রিয়া। সবাই কিছু উপার্জন করবে, কেবল সরকার বাহাদুর আঙ্গুল চুষবেন।
    
 এতক্ষণ ঘোড়ার পিঠে বসে  সব করেছি, শুধু প্রকৃতিটাই আমাদের চোখ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। এখন চোখ তুলে চাইলাম। আমাদের বামে গভীর খাদ। নীচে রূপালী রেখা এঁকে মন্দাকিনী চলেছেন আপন ছন্দে। যেন হাত বাড়িয়ে ডাকছেন 
  -আয় না, নীচে নেমে আয়। অতুল ঐশ্বর্য এখানে। 
  অপরূপ প্রকৃতির ডাক যেন সত্যিই টেনে নিয়ে যেতে চায়। বড় বড় পাথরের ফাঁক ফোকর গলে উচ্ছলা মন্দাকিনী জল ছিটিয়ে ছুটে চলেছে। বিপরীত তীরে লম্বা লম্বা গাছগুলো যেন ঝোলা বারান্দায় দোল খাচ্ছে। নীচের মাটি কাঁকর টেনে নিয়ে গেছে দুঃস্বপ্নের সেই বন্যা। 
     মোড় ঘুরতেই দেখলাম, হীরু -জাবরু তাদের ঘোড়ার লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে। ওরা যে কোন্ পথে আমাদের ছাড়িয়ে আগে এসে পড়ল বুঝলাম না। 
  -আর বেশী দূর নয় সাব, আর এক কিলোমিটার দূরেই ঘোড়ার চলা শেষ। বাকীটা আপনাদের হাঁটতে হবে। 
    বুঝলাম, পায়ে না চললে তীর্থ দর্শনের পুণ্য অর্জন হয় না। 
    মনকে শান্ত কর। সংসার থেকে এত দূরে এসেও সংসার ভুলতে পারলি না? দেবতা হাত ধরবেন। হাতটা একটু পরিস্কার কর। ঈশ্বরের রাজ্যে দাঁড়িয়ে তাই একমাত্র কামনা 
   -দেব, বাসনা নিবৃত্ত করো। একাগ্র চিত্তে তোমার চরণে সমর্পিত হতে চাই। 
 -জয় বাবা কেদারনাথ। জয় বাবা কেদারনাথ। (চলবে)
----------

Post a Comment

0 Comments