জ্বলদর্চি

২২ শে শ্রাবণ / অনিন্দিতা শাসমল

শ্রাবণের উচ্চারণে ,তুমি..

অ নি ন্দি তা  শা স ম ল

" জীবনে আমার যত আনন্দ 
পেয়েছি দিবসরাত
সবার মাঝারে তোমারে আজিকে 
স্মরিব জীবননাথ ! "
     (নৈবেদ‍্য/৭)

সেই কোন ছোটোবেলায় মায়ের আঁচল জড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে আধো উচ্চারণে, মায়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতাম--
 "কতদিন ভাবে ফুল, উড়ে 
যাবো কবে, যেথা খুশি সেথা যাবো, ভারি মজা হবে। তাই ফুল একদিন---"
         তারপর থেকে যখনই আনন্দ পেতাম যে কোনো বিষয়ে অথবা প্রকৃতির অপরূপ রূপ পরিবর্তন দেখে মনে মনে বলে উঠতাম  লাইনগুলো। তখনও হয়তো তত গভীরভাবে উপলব্ধি করিনি প্রতিটি শব্দের মানে। তবুও যতটুকু বুঝতাম, তাতেই মনের মধ‍্যে অনুরণন হতো কথাগুলোর। সেই থেকেই শুরু কবিতার প্রতি ভালোলাগা। মায়ের কাছে শুনতাম ওই কবিতাটি যিনি লিখেছেন, তাঁর কত কথা ! ধীরে ধীরে তাঁর গান শুনলাম, কবিতা পড়লাম। একবার শোনার পর তার রেশ ফুরোয় না কিছুতেই ! সকালে ঘুম থেকে উঠে রেওয়াজ করতে বসতাম --
"আলো আমার আলো ওগো, আলোয় ভুবন ভরা ---"
আমার আকাশ ক্রমশ রবির আলোয় আলোময় হয়ে উঠলো। ক্লাস এইটের জন্মদিনে বাবা উপহার দিলেন --সঞ্চয়িতা।বাড়ির পুরোনো সঞ্চয়িতা থেকে মা অনেক কবিতা শোনতো মাঝে মধ‍্যে। কিন্তু ওটা আমার নিজের মনে হতো না। আমার নাম লিখে দেওয়া বাবার উপহারের সঞ্চয়িতাটা নিজের বইয়ের তাকে রেখে দিলাম যেদিন থেকে, সেদিন থেকে কবিগুরু আমার নিজের হলেন -- আমার একান্ত নিজের রবীন্দ্রনাথ। তারপর থেকে প্রতি জন্মদিনে উপহার পেয়েছি একে একে গীতাঞ্জলি, গীতবিতান, নৈবেদ‍্য, ডাকঘর, গল্পগুচ্ছ, রবীন্দ্ররচনাবলীর বিভিন্ন খণ্ড। এই সব বই মন প্রাণ দিয়ে পড়তে পড়তে কখন যে রবীন্দ্রনাথ নিজের অজান্তেই আমার রক্তস্রোতে মিশে গেছেন, জানি না। 
 মাধ‍্যমিক পরীক্ষা দিয়ে হারিয়েছিলাম আমার প্রিয় মানুষটিকে, আমার ঠাকুমাকে -- যাঁর কাছে শুয়ে রাতে গল্প না শুনলে আমার ঘুম আসতো না। তাঁকে হারিয়ে মন খারাপের একলা রাতে ঘুম না এলে, শান্ত হতাম  --"তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যতদূরে আমি ধাই--
 কোথাও দুঃখ ,কোথাও মৃত‍্যু ,কোথা বিচ্ছেদ নাই।" -- এই গানের লাইনগুলো মনে করে।
তখন থেকে জানলাম, শুধু আনন্দ নয়, বেদনার মুহূর্তেও তাঁর গান কবিতায়, তাঁর সৃষ্টির অতলে ডুব দিয়ে শান্ত হওয়া যায়, সব দুঃখকে দূরে সরিয়ে ভালো থাকা যায়। সেই থেকে আমার সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে উঠলো রবীন্দ্রকবিতা অথবা গান।
উচ্চশিক্ষার পথে পা বাড়িয়ে  যখনই  কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছি, মনে সাহস যুগিয়েছে বিশ্বকবির সেই অমোঘ লাইনগুলি -- 
"যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে ---"
সব বাধা সরিয়ে একলা পথ চলার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছি রবিঠাকুরের এই গানে। আমার গ্রামীণ জীবনযাপনে, তথাকথিত সমাজব‍্যবস্থার অন‍্যায় নিয়মের গুরুভার সহ‍্য করতে না পেরে -- যেদিন আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, আমার  মায়ের বুকে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম, মাথায় হাত বুলিয়ে মা সঞ্চয়িতা খুলে 'সবলা' কবিতা পড়তে দিলো। আমার মননে, আমার চেতনার গভীরে মিশে গেল কবিতার প্রতিটি লাইন -- "নারীকে আপন ভাগ‍্য জয় করিবার 
কেন নাহি দিবে অধিকার হে বিধাতা ? 
নত করি মাথা
পথপ্রান্তে কেন রব জাগি
ক্লান্তধৈর্য্য প্রত‍্যাশার পূরণের লাগি 
দৈবাগত দিনে?
শুধু শূন‍্যে চেয়ে রব? কেন নিজে নাহি লব চিনে
 সার্থকের পথ ? "
রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটিই মূলত ছিল শিক্ষাজীবন শেষে ডিগ্রী অর্জনের পর, কঠোর পরিশ্রম করে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার একমাত্র প্রেরণা। পরবর্তীকালে সংসারজীবনে প্রবেশ করে যত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি , বারবার উচ্চারণ করেছি --
 "বিপদে মোরে রক্ষা করো
 এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
 দুঃখতাপে ব‍্যথিত চিতে নাই বা দিলে সান্ত্বনা, দুঃখে যেন করিতে পারি জয় ।"
 কর্মক্ষেত্রে, সমাজজীবনে, সংসারযাপনে দৃঢ় প্রত‍্যয় নিয়ে সব সম‍স‍্যার সমাধানের পথ দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
       আজ দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় জীবনের মধ‍্যগগনে পৌঁছে ভাবি, রবীন্দ্রনাথের বিপুল সৃষ্টির সঙ্গে পরিচয় না হলে আমার জীবনের ছন্দপতন হতো নিশ্চিত। আজ বাইশে শ্রাবণে আমার প্রেম, বিরহ, স্বদেশচেতনা, প্রতিবাদের ভাষা, মুক্ত অনর্গল কর্মময় জীবনের সব ঋণ রাখলাম বিশ্বপথিক এই ঋষিকবির কাছে----
"এসো দুঃখে সুখে, এসো মর্মে ,
এসো নিত‍্য নিত‍্য সব কর্মে,
এসো সকল-কর্ম -অবসানে।
তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে।"
(গীতাঞ্জলি ৭)


Post a Comment

2 Comments

  1. Very simple but interesting. Amader sobar moner katha

    ReplyDelete
  2. Brilliant write up - it shows your authority in this subject !

    ReplyDelete