জ্বলদর্চি

২২ শে শ্রাবণ / তপনজ্যোতি মাজি


পঁচিশে বৈশাখ থেকে বাইশে শ্রাবণ 


ত প ন জ্যো তি  মা জি 

দীপ্ত বৈশাখে তাঁর আবির্ভাব ধারা শ্রাবণে মহাপ্রস্থান I না, কোনও সাংকেতিক দিকনির্দেশনা নয় I বস্তুত, তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন অক্ষর নির্মিতি একটি শিল্প কর্ম। শুধু অক্ষর নয় জীবনের সব মুহূর্তই জীবনকে উপস্থাপিত করে , তাই ক্ষণকালকে চিরন্তনতার জ্যোতির্ময় 
আলোকে উদ্ভাসিত করা জীবনের ধর্ম I 

তিনি  যতখানি কবি ঠিক ততখানি দার্শনিক আর ঠিক ততখানি মানুষ I আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতায় কত ভুল আবেগে তাঁকে বিদ্ধ করেছি , এখনও কত বিচিত্র রকমের তুলনা তত্ত্ব খাড়া করে তাকে ক্রুশবিদ্ধ করে যাচ্ছি, যেন আলো নিভিয়ে  দেখাতে চাইছি, দ্যাখো, দ্যাখো অন্ধকার I 
নির্মোহ মূল্যায়ন বা আলোচনা প্রার্থিত I  কিন্তু আমাদের চিরকালীন ভ্রান্তিবিলাস এই যে আমাদের উচ্চতায় তাঁকে নামিয়ে আনার দুরন্ত প্রবণতা I তাঁর অন্তর্লোকের উপলব্ধি মননশীল কাজ I স্থূল কিংবা হালকা আবহে 
দ্রুত কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছলে তাঁর সেই উচ্চতায় পৌঁছানো সম্ভব নয় I আমরা অনেকেই সেই কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠেছি, কারণ আত্মবিস্মৃতি নামক অসুখে আক্রান্ত আমাদের জাতিসত্তা।  

পঁচিশে বৈশাখ যদি সম্মিলিত কণ্ঠে গেয়ে উঠে  'এসো হে বৈশাখ এসো এসো -- -- ' বাইশে  শ্রাবণ যেন একান্তেই আত্মমগ্ন I বুকের সরোবরে খুব ধীর লয়ে মন্দ্রিত হয় 'শ্রাবনের ধারার মতো পড়ুক ঝরে -- -' কোথাও যেন এক নিদারুণ বিচ্ছেদের চিরকালীন বিরহ I তাই  বাইশে শ্রাবণ নির্জন হওয়ার দিন I 

রবীন্দ্রনাথ  ও তাঁর সৃষ্টি এক অনিঃশেষ উপলব্ধি I রূপ সাগরে ডুব দেওয়া 
অরূপরতনের সন্ধানে I নিন্দুকেরা বলতেই পারেন এ তো সুরঋদ্ধ দার্শনিক অতিকথন মাত্র I সমসাময়িক বা বর্তমানের প্রেক্ষাপটে এর বাস্তবতা কোথায় ?  জীবনের এমন কোনও অনুভূতি নেই কিংবা বাস্তবতার এমন কোনও অভিঘাত নেই যা রবীন্দ্রনাথ আলোচনা করেননি I শুধু আলোচনা বললে কম বলা হয় , তিনি সংকট মোচনের উপলব্ধি বা উত্তরণের পথ দেখিয়েছেন I কবিতা ও সংগীতের পর সংকট ও সমস্যা উত্তরণের উপলব্ধিগুলিকে আলোচনা করেছেন প্রবন্ধ সাহিত্যে এবং চিঠিপত্রে I সমস্যা একটাই, আমাদের পড়ার অভ্যাস কমে গিয়ে বলার অভ্যাস বেড়েছে I চর্চার পরিসর সংক্ষিপ্ত করে প্রসারিত হচ্ছে প্রগলভ আনুষ্ঠানিকতা I তাই  রবীন্দ্র প্রতিভার যথার্য মূল্যায়নের পরম্পরা 
কার্যত অনুপস্থিত I
যে অস্ত্রহীন যুদ্ধে পৃথিবীর মানুষ শঙ্কা আর মৃত্যুকে নিয়ে যাপন করছে অনভ্যাসের জীবন, এ সম্বন্ধেও রবীন্দ্রনাথের পর্যবেক্ষণে ইঙ্গিত ছিল I সভ্যতার সংকট নিয়ে তিনি চিন্তিত ছিলেন I আজও সংকটকালে যে 
কোনও ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে তাঁর গান, তাঁর কবিতা, তাঁর প্রবন্ধ আমাদের পথ দেখায় I বাইশে শ্রাবণ মহাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটলেও, রবীন্দ্রচিন্তন অভিযাত্রার শুরু হয়েছে সেই ১৯৪১-এI 
 
আর একটি বাইশে শ্রাবণ I বুকের গভীরে এক ভিন্ন ব্যঞ্জনার অনুরণন I মহাপ্রস্থানে চলে যাওয়া জীবনপথিকের জন্যে মন কেমন করা অনুভূতি I স্বজন হারানোর শূন্যতা। কবিজীবনের এমন সর্বজনীন গ্রহণীয়তার একমাত্র উদাহরণ তিনি I প্রাণের আরাম এবং আত্মার শান্তির জন্যে
যাঁর কাছে অপরিশোধ্য ঋণ আমার, তাঁর জন্যে নিবিড় নির্জন কিছু  মুহূর্ত রাখি প্রতিটি  বাইশে শ্রাবণেI 



Post a Comment

0 Comments