২২শে শ্রাবণ এবং আত্মকথা
মো না লি সা পা হা ড়ী
"শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে..."
শ্রাবণ মানেই অবিরাম ধারাপাত, অন্তহীন ভিজে যাওয়া। সিক্ত পৃথিবীর ভাঁজে ভাঁজে করুণার রস সঞ্চার। আকাশ জুড়ে কালো মেঘের আস্ফালন, শানিত তরবারির মতো বিজলীর বিদ্যুৎ চমক, বাউল বাতাস যখন হৃদয়ের জমিতে স্মৃতির আঁকিবুকি করতে শেখায় ঠিক পরক্ষণেই মিটিমিটি হাসে একচিলতে রোদ্দুর। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারে কণা কণা রোদ... স্বচ্ছ আকাশের বুকে কালো মেঘেরা তখন সাদা ডানা মেলা পাখি হয়ে উড়ে যায়। এমনই হৃদয় আকূল করা শ্রাবণ যখন দোড়গোড়ায় এসে কড়া নাড়ে বাঙালি অজান্তেই গেয়ে ওঠে--
"শুধু তোমার বাণী নয় গো হে বন্ধু হে প্রিয়/ মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশ খানি দিও..."।
সত্যিই তাই । সেই আরাধ্য প্রেমিক মানুষটির পরশ ছাড়া আমরা কেউ কি জীবনে স্বয়ংসম্পূর্ণ? বোধহয় না। জীবনে যাপনে বিলাসে ব্যাসনে হর্ষে বিষাদে সৌজন্যে আলো আঁধারে তিনিই তো ছড়িয়ে আছেন চতুর্দিকে, ঘিরে রেখেছেন আমাদের অম্লান আলোর সান্নিধ্যে, জাগতিক সুখ দুঃখের মায়াকাজল চোখে পরিয়ে তিনিই তো শিখিয়েছেন পরম প্রাপ্তির পথ, মুক্তির স্বাদ, বেদনার নিভৃত নিগুঢ় নির্জন উপলব্ধির চিরন্তন ছন্দ।
সেই ব্যথার সাবলীল ছন্দ বুকে নিয়ে বাঙালি বাইশে শ্রাবণের প্লাবনে মন ভাসায়। অকূল দরিয়ায় তখন মন কেমনের ডিঙি পথ হারিয়ে ফেলে। আমরা তাকিয়ে থাকি প্রাণের ঠাকুরের অবিচল প্রতিকৃতির দিকে। স্থির হয়ে বসি। বাঙালির কোষে কোষে যাঁর বাস তাঁকে স্মরণ করি তাঁরই সৃষ্টির অপূর্ব জাদুকরী মাধুকরীতে।
তিনিই তো শিখিয়েছেন প্রেমে পূর্ণ হতে গেলে মেনে নিতে হবে বিদায়ের ক্ষণ। ত্যাগের ভেতর প্রাপ্তির আস্বাদ। উজাড় করে বিলিয়ে দেওয়ার ভেতরেই জড়ো হয় কণা কণা সুখের রেণু। তাইতো বাঙালি তাঁকে বিদায় জানাতে পেরেছিল মহা প্রস্থানের পথে। আবার প্রতি বছর এই দিনটিকে বাঙালি চোখের জলের আয়নায় মুখ দেখে।আবিষ্কার করে প্রেমের চিরন্তন রূপ। যে প্রেম কোনো সময়ের সীমানায় গিয়ে ফিকে হয়ে যায় না। বরং উত্তরোত্তর জড়িয়ে ধরে আবেগের সুচারু কারুশিল্পে, আঁকড়ে ধরতে চায় সমস্ত অবক্ষয়ের হাত থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে চেয়ে, সীমাহীন অপ্রাপ্তির শেষেও তাঁর চরণই হয়ে ওঠে আলোর ঠিকানা। সেই আলো বুকে জ্বালিয়ে আমরা গেয়ে উঠি -
"দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে..."
0 Comments