উপস্থাপনার সাতকাহন || পর্ব- ৩
পৌ লো মী ভ ট্টা চা র্য
....."ইতিহাস কথা কয়"
উচ্ছে করলা নিমপাতা.... তিনটিই আমার খুব প্রিয়। আমার স্বভাব ও চেহারা দুটোই করলার মত। এহেন তিতকুটে মেয়েটার বাল্যপ্রেম, কবিতা। রেডিও বগলদাবা করে ছোটবেলায় অংক করত সে। এটা এমন কিছু স্পেশাল নয়, ওই সময় অনেকেই করত। রেডিওর মধ্যে কোনকালে ঢুকবো এমনটা কস্মিনকালে ভাবিনি। সেটা পাকেচক্রে ঘটেছে। তবে যাঁদের গলার আওয়াজে আমার ভেতরের গ্রাফ ,ঊর্ধ্বমুখী তখন, তাঁরা জগন্নাথ বসু, উর্মিমালা বসু। আমার পারিবারিক পরিবেশে গ্রুপ থিয়েটার ছিল বলেই নাটক শোনা ছিল আমার অবসেশন। আর সেই পরিসরেই জগন্নাথদার কণ্ঠ অভিনয়। উর্মিমালা বসুদির নাটকের সংলাপ একবার শুনলেই আমার মুখস্ত হয়ে যেত। আমি প্রত্যক্ষ ভাবে ছাত্রী না হয়েও কতকিছু যে আত্মসাৎ করেছি।
উপস্থাপনার দায়িত্বে আসার পর এমন অনেক মণি-মাণিক্যের সঙ্গে প্রতিদিনের দেখা, যে , সেসব গল্প শোনাতে বসলে একটু যেন আত্মপ্রচারের গন্ধই বেশি বেরিয়ে আসবে। তবু এটুকু অস্বীকার করি কি করে!আমার নিজের পরিবারের গণ্ডিতে গ্রুপ থিয়েটারের সাইড লাইনে বসে থাকা মেয়েটাকে "পঞ্চম বৈদিক" এর জন্য নির্বাচন করে নিয়ে গিয়েছিলেন শাঁওলিদি (মিত্র)উপস্থাপনার উঠোন থেকে। শাঁওলি মিত্রের রেডিও নাটকে আমি চিরকালই বুঁদ। একটিই জিজ্ঞাসা ছিল তাঁর। "তুমি কি কেবল কবিতা আবৃত্তি করো নাকি নাটক করেছো? আমার উত্তর ছিল, 'কবিতা বলি'।
আসলে সমস্ত কবিতারই ফ্রেমে লুকিয়ে আছে ছোট্ট ছোট্ট নাটক! সেই নাট্যরসটুকু শ্রোতার কাছে পৌঁছে গেলে তৈরি হয় একটা ছবি। উপস্থাপনার কাজে সেই ছবিটা খুব দরকারি। বিশেষ করে রেডিও উপস্থাপনাতে। কারণ সেখানে আমাকে কেউ দেখতে পায়না। গলার আওয়াজটুকুই এঁকে দিয়ে যায়, মুহুর্তের রঙ। শ্রাবন্তী মজুমদারের 'বোরোলিনের সংসার' শুনতে শুনতে যারা আমরা বড় হয়েছি, তারা এই রংটাকে খুব চিনি। রেডিওর ধারাপাতে এফএম টকশো আসার পর তো সেই রঙেই সবাই রঙিন। সাদা কালো থেকে কালার টেলিভিশনে ক্লান্ত বাঙালি তখন আবার রেডিওর নব ঘুরিয়েছে। রীতা দত্ত চক্রবর্তী, স্বরাজ বসু, সৌমিত্র বসু.... একঝাঁক কণ্ঠ। উপস্থাপনার ক্যানভাসে অন্য বাঁক। সে তো ইতিহাস।
ইতিহাসের পাতা ধূসর হয়। থেকে যায় গহীনে। ক্রোমোজোমের গল্প যেমন শরীরের খাঁজে ঘুমিয়ে থেকে চাওয়া-পাওয়া, ইচ্ছে অনিচ্ছের সুতো ধরে টান দেয়... তেমনি , সময় থমকে দাঁড়ায় একটি নামে। দাদা ঠাকুর। শরৎচন্দ্র পণ্ডিত। শ্রীযুক্ত নলিনীকান্ত সরকারের রচনায় আমরা পাই....."কলকাতা বেতার প্রতিষ্ঠানে দাদাঠাকুর ছোটদের বৈঠকে ও পল্লীমঙ্গল আসরে সেসময় নিয়মিত যোগদান করতেন। কোন কোন দিন দাদা ঠাকুরের সঙ্গে সংগীত অংশে অবতীর্ণ হতেন হাসির গানের গায়ক সারদা গুপ্ত। দাদাঠাকুর একটি বিষয় নিয়ে কিছুক্ষণ সরস ভাষণ দেওয়ার পর, সেই বিষয়বস্তু অবলম্বনে দাদা ঠাকুরেরই রচিত গান ধরতেন সারদা গুপ্ত।.... দাদা ঠাকুর ভূমিকা করে বলতেন, 'আজকের অনুষ্ঠানে আমি কথা বলব, আর আমার হয়ে গান ধরবে সারদা। কারণ আমি যেমন সুরকানা, তেমনি তালকানা। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে আমি ধৃতরাষ্ট্রের মতো অন্ধ, তাই আজ সারদা আমার গানধারী হয়ে এসেছে'.... রেডিওতে দাদাঠাকুর যেন কথার ফুলঝুরি নিয়ে খেলা করতেন। একদিনের একটি প্রোগ্রামের কথা বলি। বিষয়টি ছিল ,প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর।....দাদা ঠাকুর প্রায় দশ পনেরো মিনিট ধরে এই জাতীয় প্রশ্ন উত্তরের এক লম্বা ফিরিস্তি দিলেন।
প্র. এটা কি গ্রাম?
উ. এ টাকি গ্রাম।
প্র. একি মা?
উ. এ কিমা।
প্ৰ. মাসি কি দিয়েছে?
উ. মা সিকি দিয়েছে।
ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি".......
এখনো সেই তৈলচিত্র রেডিও অফিসের দেওয়াল জুড়ে। অসংখ্য গল্প ডানা মেলে শব্দ অর্থের অভূতপূর্ব জাগলারিতে।
১৯৩০ সাল। দুর্গা ষষ্ঠীর সকাল। আরো একবার মন্থিত বাঙালি সুরে মন্ত্রে। চরাচর জুড়ে 'জাগল রে ভুবন'! শ্রী বিরূপাক্ষ এর সোশ্যাল স্যাটায়ার। উৎকর্ণ বেতারের শ্রোতা। অপরূপ সৃষ্টি ধর্মীতা, চলিত ভাষার ব্যবহার, সময়সীমা নির্দিষ্ট, বেতারে পঠিত হবে, ক্রিয়াপদ কম। আর সেখানেই কিস্তিমাত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের। উপস্থাপনা আর একটা প্রোগ্রামের ঘেরাটোপে থাকলই না। মিশে গেল সর্বসাধারণের জীবন অভ্যাসে। আর এই অভ্যাসের দলিলে ১৯৭১ সালে উত্তাল দস্তখত। রাত দশ টা থেকে সাড়ে দশটা। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, উপেন তরফদার এর কণ্ঠ। স্থানীয় সংবাদ, সংবাদ বিচিত্রা , সংবাদ পরিক্রমা।.. ..মুক্তিযুদ্ধের আকাশে ইথার তরঙ্গের উদ্বোধন উদ্দীপন। একটা গোটা জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জাপ্টে রইল উপস্থাপনের একটা যুগ, একটা সময় ।
পৃথিবী থেমে থাকে না। সেঁকে নেয় পিঠ সূর্যের আলোয়। কথা বলে চলে সময়। ইতিহাসের সূত্র ঐতিহ্যের ছাতা ধরে দাঁড়ায় চুপ করে। ধরে রাখে ট্রান্সমিটারের ওয়েবে ছড়ানো যৌথ পরিবারটাকে। পালশি দিনহাটা রাজবলহাট শ্যামবাজার সোদপুর সুন্দরবন একসঙ্গে কথা বলে। উপস্থাপনা সেখানে সঙ্গত করে মাত্র। রেডিওর এপার-ওপার তখন একাকার।
0 Comments