জ্বলদর্চি

হিমালয়ের পথে চলতে চলতে -১১


হিমালয়ের পথে চলতে চলতে 

 দে ব ব্র ত  ভ ট্টা চা র্য্য 

কেদারনাথ দর্শন 
একাদশ ও অন্তিম পর্ব 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার একটি লাইন মনে এলো,-শেষ হয়েও হইল না শেষ। আমার এ চলার দশাও তেমনি। বাবা কেদারনাথ দর্শনে বেরিয়েছিলাম পথের কষ্ট যেমন পথ আগলে দাঁড়িয়েছে তেমনি প্রকৃতির হাতছানি সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দিয়েছে। আজ এই গৌরীকুণ্ডে বসে দুটি পা কে বিশ্রাম দেওয়ার আয়োজন চললেও মনের অবাধ চলা সমানতালে গতিশীল। 
  চায়ে চুমুক দিলাম। বেশ ভালো লাগছিল। এমন সময় এক হিন্দি ভাষাভাষী ভদ্রলোক আমায় প্রশ্ন করলেন -আপনারা তো কেদারনাথ দর্শন করলেন। কিন্তু বাকী চারটি কেদার ও দর্শনের ইচ্ছে আছে? 
পঞ্চ কেদার সম্পর্কে আমার অনেকটা ধারণা ছিল। 2010 এর কুম্ভস্নানে হরিদ্বারে এসে ভারত সেবাশ্রমের এক মহারাজের সাথে সাক্ষাত হয়। পরে জানতে পারি তিনি আমার পূর্ব পরিচিত। গার্হস্থ জীবনে আমার শহরের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। এখনকার সন্ন্যাস নাম সন্তোষানন্দ মহারাজ। মহারাজ ওখানেই আমাকে পঞ্চ কেদারের সঙ্গে অনেকটা পরিচয় করিয়ে দেন। আমি ঐ ভদ্রলোক কে বললাম -
  -না, এবার তো তেমন কিছু মনে নিয়ে আসিনি, তবে পরের বার ঐ তীর্থ গুলি দর্শনের ইচ্ছে আছে। 
  ঐ হিন্দীভাষী বললেন -
-সেগুলির সম্পর্কে যদি কিছু বলেন। বাংলাতে বললেও আমরা বুঝতে পারবো 
  হাতে সময় আছে। কাহিনী শোনার আগ্রহী শ্রোতা আছে। সুতরাং মনের আনন্দে শুরু হল আমার পঞ্চ কেদার কাহিনী। 
      -আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। এটি তো আমরা সবাই জানি, পঞ্চ কেদারের প্রথম ও প্রধান টি হল কেদারনাথ ধাম। কিন্তু অন্যগুলিও দেব মাহাত্মে ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমান আকর্ষনীয়। তবে বাংলায় বলবো, বুঝতে একটু অসুবিধা তো হবেই। 
  দেখলাম ঐ ভদ্রলোক তো বটেই আমার পাশে বসা অন্যান্য আরও কয়েকজন যথেষ্ট আকর্ষণ নিয়ে অপেক্ষায়। সুতরাং আমার কথা এগিয়ে চললো। আমার তো সন্তোষানন্দজী ই ভরসা। তাঁকে মনে মনে প্রণাম জানালাম। 

কেদারনাথ থেকেই শুরু করি। কেদারনাথ পর্বতের পেছনে মন্দাকিনী হিমবাহ থেকে মন্দাকিনীর উৎপত্তি। একে 'ব্রহ্মকুণ্ড' ও বলে। দীর্ঘ নব্বই কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে রুদ্রপ্রয়াগে মন্দাকিনী ঝাঁপ দিয়েছে অলকানন্দায়। মন্দাকিনীর তীরে কেদারনাথ ধাম। মন্দিরের বামপার্শে একটি সরু নালা আছে। একে সরস্বতী নালা বলে। ঐ নালা পেরোলে অনেক ধর্মশালা ও দোকান বাজার আছে। তবে বর্তমানে এর অবস্থানের সবকিছু বদলে গেছে।
   গৌরীকুণ্ড থেকে একুশ কিলোমিটার পথ। মন্দাকিনীর প্রবাহকে পাশে নিয়ে পায়ে হেঁটে বাবার চরণে পৌঁছোতে হয়। অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশ সব কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। 

দ্বিতীয় কেদার হলেন তুঙ্গনাথ দেব। সর্বোচ্চ কেদার। প্রায় তিন হাজার ছয় শত মিটার উচ্চতায় এ মন্দিরের অবস্থান। মহারাজ সন্তোষানন্দজী বলছিলেন, 
  -হিমালয়ের প্রতিটি পথই প্রকৃতির কোলে শোয়ানো সৌন্দর্যের আকর। তবে সব চেয়ে মন ভোলানো রূপ হল তুঙ্গনাথের পায়ে হাঁটা পথটুকু। চোপতা থেকে পাঁচ ছয় কিলোমিটার চড়াই পথটির পাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য অবর্নণীয়। 
    চোপতা হল তুঙ্গনাথের প্রবেশদ্বার। গুপ্তকাশী থেকে একটী পথ মন্দাকিনীর তীর থেকে পাহাড়ের চূড়াই ভেঙে উখীমঠ হয়ে চামোলি পর্যন্ত বিস্তৃত। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে বদ্রীনাথ ধাম যাওয়ার পথে চামোলি জেলা শহর পড়ে। উখীমঠ থেকে চামোলির ঠিক মাঝ বরাবর চোপতার অবস্থান। পঁচিশ কিলোমিটার দূরত্ব। 
   চোপতা থেকে তুঙ্গনাথের পথে চড়াই শুরু। এ পথের দৈর্ঘ্য কম কিন্তু উচ্চতা খুব বেশী। বসন্তে সমগ্র অঞ্চল বরফে ঢাকা থাকে। কালো পাথর সাদা, সবুজ পাতা সাদা  ,লাল ফুলেদের গায়ে সাদা তুষারের চাদর। সে যে কি অপরূপ রূপ, না দেখলে জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। শেষ মোড় টি ঘুরলেই সামনে দাঁড়িয়ে বাবা তুঙ্গনাথ। সামনে একটা হলুদ রঙের সাদা মাটা ঘর। এটি অতিথি নিবাস।সামনে প্রধান ফটক। একটি বড় ঘন্টা বাঁধা। মন্দিরের বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য নেই। যা কিছু বৈশিষ্ট্য অধীশ্বর তুঙ্গনাথ দেবের নাম এবং তার স্থান নির্বাচনে। এখানে মহিষরূপী মহাদেবের বাহু অংশ পূজিত হন। মতভেদে দেবতার হৃদয় এখানে প্রস্তরীভূত। সন্ধ্যা আরতি এই মন্দিরের বিশেষ আকর্ষণ। পর্যটন মরসুমে বহু তীর্থযাত্রী সমাগমে এ স্থান পূর্ণ হয়ে যায়। সব যাত্রী নিবাস হোটেল ভর ভরন্ত থাকে। 
  তুঙ্গনাথ থেকে আরও একটু চড়াই পথে কিলোমিটার দুয়েক এগিয়ে গেলে একটি মেলানো চাতালে পৌঁছোনো যায়। এটি হল 'চন্দ্রশিলা'। এর  উচ্চতা চার হাজার মিটার। এই শিলার উপর বসে শ্রী রাম চন্দ্র মহাদেবের ধ্যান করেছিলেন। এখানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দর্শন মহা সৌভাগ্যের। সব থেকে মনোমুগ্ধকর হল, এই শিলার উপর দাঁড়িয়ে কাছে দূরে অসংখ্য জানা অজানা পর্বত শৃঙ্গ চোখে পড়বে। নন্দাদেবী, চৌরাস্তা, কেদারনাথ, বন্দরপুঞ্চ আরও কত! শীতে অন্যান্য মন্দিরের মত তুঙ্গনাথের দরজাও বরফের নীচে চাপা পড়ে যায়। মহেশ্বরের প্রতিমূর্তি নেমে যায় উখীমঠের পাশে মুখীমঠে ।এর প্রকৃত নাম মুক্কুমঠ। 

 তৃতীয় কেদার হলেন মধ্যমহেশ্বর। উচ্চতা 3490 মিটার। উখীমঠ থেকে উনিয়ানা হয়ে রাশিগ্রাম। রাশিগ্রামে রাকেশ্বরী মাতার মন্দির। এখান থেকে ভীমসি ঝর্ণা পেরিয়ে গৌণ্ডার ছয় কিলোমিটার হাঁটাপথ। এখান থেকে আরও দু কিলোমিটার গেলে বাণতোলি। এখানে একটি সঙ্গম আছে।মার্কণ্ডেয় গঙ্গা ও নন্দাকিনী গঙ্গার মিলন। নন্দীকুণ্ড থেকে নন্দাকিনী আর চৌখাম্বা থেকে মার্কণ্ডেয় গঙ্গার উৎপত্তি। বানতোলি থেকে এগারো কিলোমিটার খাড়াই পথ হেঁটে মধ্যমহেশ্বর মহাদেবের চরণে পৌঁছোনো যাবে। ছোট্টো মন্দির। অতি সাধারণ। কিন্তু এখানের ঈশ্বর মন্দিরে নয়, বাইরের প্রকৃতিতে ছড়িয়ে আছেন। সে অপরূপ সৌন্দর্য বর্ণনার অতীত।  মধ্য মহেশ্বর থেকে আরও কিছুটা পথ এগিয়ে গেলে বৃদ্ধ মহেশ্বরের মন্দির। শীতে এই কেদারের দরজাও বন্ধ হয়ে যায়। উখীমঠে বাবা কেদারনাথ এর পাশে বসে বাবা মধ্যমহেশ্বরও পুজো গ্রহণ করেন। 
        এ প্রসঙ্গে উখীমঠের কথা একটু বলে নেওয়া যেতে পারে। গুপ্তকাশীতে মন্দাকিনীর বিপরীত তীরে যাওয়ার জন্য একটি নীচু ব্রীজ আছে। এই ব্রীজ পেরিয়ে পাহাড়ের চড়াই ভেঙে পিচ ঢালা পথ ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে গেছে উখীমঠ পর্যন্ত। প্রায় ছয় সাত কিলোমিটার। এই পথই চোপতা যাওয়ার দ্বিতীয় পথ। প্রথম টি রুদ্রপ্রয়াগ থেকে বদ্রীবাশাল দর্শনে যাওয়ার পথ ।মাঝে চামোলি থেকে বাঁক নিয়ে একটি পথ  চলে যাবে সোজা চোপতা।

উখীমঠে শিব পার্বতীর মন্দির। শিব পার্বতী ছাড়াও মহারাজ মান্ধাতা, অনিরুদ্ধ এবং তাঁর স্ত্রী বাণরাজার কন্যা ঊষাদেবীর মূর্তি আছে। সবাই বলে ঊষা দেবীর নাম অনুসারে এ মঠের নাম ঊষীমঠ বা উখীমঠ।
 
  চতুর্থ কেদার হলেন রুদ্রনাথ মহাদেব। এ মন্দিরের উচ্চতা 3555 মিটার। মহিষরূপী মহাদেবের মুখমন্ডল প্রস্তরীভূত হয়ে রয়েছেন এখানে। 
     চোপতা থেকে চামোলি যাওয়ার পথে গোপেশ্বর জেলা শহর। গোপেশ্বর থেকে সগরগ্রাম হয়ে রুদ্রনাথ যাওয়া যায়। গোপেশ্বর থেকে চার কিলোমিটার দূরে সগরগ্রাম।এ পর্যন্ত চক্রযান যেতে পারে। এর পর আঠারো কিলোমিটার হাঁটা পথ। মাঝে 'পেনার বুগিয়াল'। এখান থেকে শেষ দশ কিলোমিটার প্রচুর চড়াই উৎরাই। এ পথের সর্বোচ্চ স্থান 'পিতৃধারা'। 4100 মিটার উঁচু। এখন থেকে অনেকটা নীচে নেমে রুদ্রনাথ। প্রকৃতপক্ষে রুদ্রনাথ মন্দির কোন মন্দির নয়। দেবাদিদেব এখানে গুহাবাসী। একটি গুহাকে মন্দিরের রূপ দেওয়া হয়েছে। 
    রুদ্রনাথ যাওয়ার আরও একটা পথ আছে। গোপেশ্বর থেকে কিছুটা এগোলে মন্ডল জনপদ। সেখান থেকে অনুসূয়া পাঁচ কিলোমিটার। তারপর দীর্ঘ ষোল কিলোমিটার এক নাগাড়ে হাঁটতে হবে ।মাঝে কিন্তু কোন চটী বা বিশ্রাম স্থান নেই। তবে এ কষ্ট সহজেই ভুলে যাবেন হিমালয়ের সৌন্দর্যে। কেউ যেন নিজের হাতে সাজিয়ে তুলেছেন তাঁর নিজের উদ্যান খানি।ভাষায় সে সৌন্দর্য অপ্রকাশ্য। 
পঞ্চম তথা শেষ কেদারটি হল কল্পেশ্বর কেদার। বদ্রীনাথের পথে পিপলকোঠির পর আসবে হেলং। এখন থেকে একটি তীর্যক পথ 'উরগম' গ্রাম পেরিয়ে 'লিয়ারি' গিয়েছে। এই এগারো কিলোমিটার পথ গাড়ীতেই যাওয়া যাবে। এরপর হাঁটাপথ শুরু। মজার কথা প্রতিটি শিবক্ষেত্রে পৌঁছোতে হলে কিছুটা পথ হাঁটতেই হবে। পায়ে না চললে মহেশ্বর সদয় হন না। 
     উরগম একটি সাজানো গোছানো জনপদ। ফলফুলে পূর্ণ। এর পর আসবে দেবগ্রাম  ।দেবগ্রাম থেকে নিম্নগামী পথ ধীরে ধীরে কল্পগঙ্গার উপর শোয়ানো একটি ছোট্ট ব্রীজে গিয়ে থামেছে। নদী পেরিয়ে কিছুটা চড়াই পথ সোজা কল্পেশ্বর কেদারের মন্দিরে পৌঁছে দেবে। এখানে মহাদেবের জটা অংশ প্রস্তরীভূত। এ মন্দিরের উচ্চতা সব চেয়ে কম। 2200 মিটার। অলকানন্দার উপনদী কল্পগঙ্গা তার তীব্র গতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে মায়ের কোলে। সে সঙ্গম স্থল লোকচক্ষুর অন্তরালে। অরন্যের গহন গভীরে। কথিত আছে, এখানে দুর্বাসা মুনি তপস্যা করেছিলেন। শীতে অন্যান্য মূর্তির মত কল্পেশ্বর মহাদেবের প্রতিমূর্তি উখীমঠে পুজো গ্রহণ করেন। 
          আমি কথা থামলাম। চেয়ে দেখলাম, আমার বেঞ্চের পেছনেও বেশ কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে। সবাই গল্পে ডুব দিয়েছেন। দেবগাথা সবার হৃদয়ে তৃপ্তির খুশী ছড়িয়ে দিয়েছে বুঝলাম। এদিকে রুটী সবজী হাজির। আর কথা নয়। শরীরের প্রতিটি কোশ বিশ্রাম চাইছে। কালকের প্রভাতে এক নতুন পথে নামতে হবে।  বাবা কেদারনাথ এর অনুমতি নিয়ে আমরা বিষ্ণু দর্শণে পা বাড়াবো। 
    এখানে গৌরীকুণ্ডে থাকবেন সৃষ্টিধর বাবু তাঁর ছোট্টো দোকান নিয়ে। মন্দাকিনী তার উচ্ছ্বল জলধারা নিয়ে শিবগাথা শোনাতে শোনাতে ছূটে চলবে সঙ্গমের পথে। অসংখ্য পুন্যার্থী হিমালয়ের পথ বেয়ে উঠে আসবে মনের অন্ধকার দূর করার মানসে। আমরা তাদের মধ্যেই হাঁটবো চিরকাল। প্রকৃতি মাতার কোলে আমাদের ফিরে ফিরে আসতেই হবে। 
(সমাপ্ত) 

Post a Comment

0 Comments