জ্বলদর্চি

লিটল ম্যাগাজিন অন্তর বাহির


লিটল ম্যাগাজিন অন্তর বাহির     

গৌ ত ম  বা ড় ই

হঠাৎ করেই যেন এ পাওয়া। হঠাৎ করেই যেন আলোক পেলো অন্তর। হাতে এলো একটি বই- ঋত্বিক ত্রিপাঠীর লিটল ম্যাগাজিন অন্তর বাহির।
ঋত্বিক ত্রিপাঠী বিদগ্ধ লেখক, কবি এবং সাহিত্যের জন্য লড়াকু এক যোদ্ধা। তাঁর সাহিত্যের এই অঙ্গনে শেকড় অনেকদূর প্রোথিত। একটা লিটল ম্যাগাজিন পঁচিশ বছরের ওপরে জেলা শহরে বসে দীপ্ত ভঙ্গিমায় প্রকাশ করে চলেছেন। আর এই সম্পাদনা করতে গিয়ে বাংলা সাহিত্যের মূল যে ভিত সেই লিটল ম্যাগাজিন থেকে তাঁর অভিজ্ঞতা তাঁর চিন্তন থেকে যা উঠে এসেছে তাই প্রকাশ করেছিলেন 'একদিন' দৈনিকের রোববারের পাতায় প্রায় তিনমাস ধরে, ২০১৮ সালের শেষদিকে। সেই সংকলিত লেখাই এই বইটি। নাতিদীর্ঘ কিন্তু ভেতরের লেখার সম্পদ অনেক বড়। ভাবাবেই ভাবাবে। যদি আপনি সত্যিকারের সাহিত্যপ্রেমী হন। এ বই আমি মনে করি আমার অল্পবিস্তর জ্ঞানে-- এই পশ্চিমবাংলার সমস্ত লিটল  ম্যাগাজিনের সম্পাদকের সংগ্রহ করা উচিত শুধুমাত্র গাইড হিসেবে। লিটল মানে ক্ষুদ্র নয়, লিটল মানে হীনমন্যতা নয়, এখানে লিটল মানে ভিত্তি। লিটল মানে এগিয়ে চলা।

বইটির সম্বন্ধে ভূমিকায় এক সুন্দর মুখবন্ধ, যেটি লিখেছেন কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সন্দীপ দত্ত। তারপরেও কেন আমার রিভিউ? কারণ একমাত্র এই বই পড়তে গিয়ে একরাশ মুগ্ধতা আমারও। অন্তর বললো কিছু লেখো আরও। তাই এই গ্রন্থ নিয়ে কিছু আলোচনা।

ঋত্বিক ত্রিপাঠী মহাশয় লিটল ম্যাগাজিনের আলোচনায় এই বইটি চোদ্দটি পর্বে ভাগ করেছেন। প্রবন্ধগুলি আগেই বলেছি একদম সহজ কথায় অল্পকথায় অমূল্য সম্পদ। লিটল ম্যাগাজিনের আলোচনার হাত ধরেই উঠে এসেছে এই দেশ কাল এই সাহিত্য ধর্ম চেতনা রাষ্ট্র ভাবীকালের দেখানো পথ আর লিটল ম্যাগাজিনেই অনিবার্য ভাবে ঘটে সাহিত্যের উত্তরণ সেই পথ ও দিশা।

শুরুটা হয়েছে একদম সঠিক ভাবেই লিটল ম্যাগাজিনের দর্শন দিয়ে। প্রাঞ্জল করে একদম সঠিক ভাবে বিজ্ঞানসম্মত ভাবেই সেই দর্শন বলা হয়েছে। এক থেকে বহুত্বের মধ্যে নিজেকে যে খোঁজা সেখানেই রয়েছে লিটল ম্যাগাজিনের সারবস্তু। লিটল শব্দের ক্ষুদ্রত্বের মধ্যেই উঠে আসে বৃহৎ অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা। শুরুর পর অনন্তর যেই পথে হেঁটে চলা, যে পথে চিরন্তন  অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়, সেই অভিজ্ঞতার সিঞ্চনবারি এই লিটল ম্যাগাজিনকে ফুলে ফলে শাখায় প্রশাখায় বর্দ্ধিত করে। শ্রী ত্রিপাঠী যথার্থ কথাই বলেছেন এখানে।
আত্মজিজ্ঞাসা রয়েছে দ্বিতীয় প্রবন্ধে। লিটল ম্যাগাজিনের আদর্শগত কিছু প্রশ্ন আর নির্দিষ্ট গতিপথ বাতলেছেন লেখক এখানে।
লিটল ম্যাগাজিনের আন্দোলন-- সেখানেও কিছু সুনির্দিষ্ট ভাবে মনোজ্ঞ কিছু আলোচনা এসেছে। নিজের আত্মসম্মানবোধ সবসময় সজাগ ও সচেতন রেখেই এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
চতুর্থ প্রবন্ধে সাময়িক পত্র আর লিটল
ম্যাগাজিনের একটা তুল্যমূল্য আলোচনা এসেছে। শ্রীরামপুর মিশনের ইতিহাস গ্রন্থ অনুযায়ী দিগদর্শন,১৮১৮-এপ্রিল কে বাংলার প্রথম লিটল ম্যাগাজিন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার আধুনিক বাংলা কবিতা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ কবি বুদ্ধদেব বসু(১৯০৮-৭৪)-ই প্রথম বাংলায় লিটল ম্যাগাজিন শব্দটি ব্যবহার করেন। স্বাভাবিক ভাবেই বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত- কবিতা পত্রিকা(১৯৩৫) এবং পরবর্তী কিছু পত্রিকাকেই লিটল ম্যাগাজিন ধরতে পারি‌ এরকম ভিন্ন ভিন্ন হিসেব অনুযায়ী লিটল ম্যাগাজিনের বয়স ঐ কম বেশি একশ বছর ধরতেই পারি। প্রবন্ধের শেষের দিকে লেখক তাই লিটল ম্যাগাজিনের বিকল্প লিটল ম্যাগাজিন বলেছেন। বলেছেন লিটল ম্যাগাজিন স্বভঙ্গীমায় স্বকীয়তায় অনন্য এক নজির।
এইভাবে প্রবন্ধের সারণী বেয়ে দেশ ও ধর্ম প্রবন্ধে লেখক ঋত্বিকবাবু এক অনিন্দ্যসুন্দর দর্শন, জীবন দর্শনের সন্ধান দিয়েছেন।এসেছে রম্যা রলাঁ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অন্নদাশঙ্কর রায় প্রসঙ্গ। ভোগবাদকে সোজাসুজি হেনেছেন এই বলে আত্মপ্রত্যয়কে হয় অন্ধ করে, কিংবা ধর্মান্ধ করে। ভোগবাদেই লুকিয়ে আছে আমাদের সর্বনাশের বীজ, ধ্বংসের বীজ। চারিদিকটা দেখে তাই মনে হচ্ছে এখন, দেশ সম্বন্ধে তিনি একটা সঠিক ধারণা দিয়েছেন।জন্মালেই দেশ আমার হয় না। দেশকে অর্জন করতে হয়। দেশ মানে জাতীয় পতাকার সোজা দিক উল্টো দিক, ১৫ অগস্ট কিংবা বন্দেমাতরম নয়। এ সবই প্রতীক। আসল হল মানুষ। যা নিষ্পেষিত হচ্ছে প্রতিদিন। নারী পুরুষ ধর্মের বিভেদ এ সবই কুশলী হাতের তৈরী। একটা দেশ ভেঙ্গে যদি তিনটে চারটে দেশ হতে পারে, তবে সব দেশ একসাথে মিলেমিশে পৃথিবীর নামে একটাই দেশ হবে না কেন? শ্রী ত্রিপাঠীর এমন চিন্তাধারা ছড়িয়ে আছে এই বইয়ের অভ্যন্তরে। যে যন্ত্র আমাদের শাসন করে, বহুধা বিভক্ত করে সেই যন্ত্রের শাসন কোনদিনও মানেনি বা মানবে না এই লিটল ম্যাগাজিন।
লিটল ম্যাগাজিনের এই দুরন্ত সব প্রবন্ধে এসেছে অনেক দৃষ্টান্ত মূলক চরিত্র। এসেছে কিছু সাহিত্যের প্রতি  নিষ্ঠাগত প্রাণ। এসেছে লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে অবিরত কাজ করে চলা সন্দীপ দত্ত মহাশয় ও জাহিরুল হাসানের নাম। সন্দীপ দত্তের লিটল ম্যাগাজিন গবেষণাগার ও লাইব্রেরিতে রয়েছে প্রায় মূল্যবান পঁচাত্তর হাজার পত্র পত্রিকা বইয়ের সংগ্রহশালা। সব লিটল ম্যাগাজিনকেন্দ্রিক। আছে লিটল ম্যাগাজিনের অনেক সুলুক সন্ধান।জেলাওয়ারী অনেক চোখে পড়বার মতন  লিটল ম্যাগাজিনের নাম ও তাদের সম্পাদকের নাম। এক কথায় অনবদ্য এই বইটি- লিটল ম্যাগাজিন অন্তর বাহির।প্রত্যেক লিটল এবং আরো ছোটোখাটো পত্রিকার  সম্পাদকের উচিত এই বই  সংগ্রহ করে একটিবার পড়া। মনে হয় ঋত্বিকবাবুর এই বই থেকে একটা ভালো গাইড বা দিকনির্দেশিকা অবশ্যই পাবেন।

পরিশেষে, ক্রিকেট টিমের ক্যাপটেনের মতন হতে হবে লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদককে।তার হাতেই ম্যাগাজিনের বাঁচা এবং মরা।তাৎক্ষণিক চমক নয় এক দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা লাগে জীবনের সব ক্ষেত্রে,এই সাহিত্যের জগতেও। মাননীয় লেখক ঋত্বিকবাবু শুধু কথার কথা লেখেননি, তিনি নিজেই লিটল ম্যাগাজিনের এক উজ্বলতম উদাহরণ। সাতাশটি বছর ধরে জ্বলদর্চি নামে মেদিনীপুর শহর থেকে একটি লিটল ম্যাগাজিন দক্ষতার সাথে প্রকাশ করে চলেছেন। তাই তাঁর এই মূল্যবান বইকে বিশ্বাস করতেই হয়।

লিটল ম্যাগাজিন অন্তর বাহির
ঋত্বিক ত্রিপাঠী
প্রচ্ছদ- শোভন পাত্র  
প্রথম সংস্করণ- ফেব্রুয়ারি ২০২০
সপ্তর্ষি প্রকাশন/ মূল্য- ২০০.০০

Post a Comment

0 Comments