প্রকৃতির শ্বাস কবিতার শ্বাসবায়ু
খু কু ভূ ঞ্যা
প্রকৃতির শ্বাস যখন কবিতার শ্বাসবায়ু হয়ে ওঠে তখন কবিকে আর আলাদা করে চেনা যায় না। মাঠ ঘাট ফুল ফল গাছগাছালি ধুলো মাটির
গভীরে তার স্নায়ুর শব্দ পাওয়া যায়। গ্ৰাম বাংলার খালবিল নদ-নদী ফুল পাখি লতাপাতাকে যিনি ঈশ্বরী জ্ঞানে ভালোবাসতে পারেন অক্ষরের জন্য তাঁকে খুব বেশি খননকার্য করতে হয় না। আপনিই আসে ঈশ্বরীক আনন্দ নিয়ে দুই হাতের তালুতে। অথবা হৃদয় সমৃদ্ধ সাত্বিক বোধে। যা কবিকে শুদ্ধতা থেকে আরো শুদ্ধতার দিকে।স্বচ্ছতা থেকে আরো স্বচ্ছতার দিকে। কবি হয়ে ওঠে দার্শনিক।নিজের চক্ষুদান নিজেই করেন। তেমনই এক চেতনা সম্পন্ন ধীর স্থির সংযমী এবং অবশ্যই প্রেমিক কবি, প্রকৃতির কবি, লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল।
শুদ্ধ কবিই মানেই ঈশ্বর। কবির দ্যাখার চোখ যখন সমস্ত অন্ধকার অতিক্রান্ত করে ভোরের দরজায় পৌঁছে যান তখন তাঁর দর্শন গড়ে দেয় আলোর উপনিবেশ। সেক্ষেত্রে কবি লক্ষ্মীকান্ত মন্ডল সফল। এবং মনে করি এই সময়ের আধুনিক কবিতার সার্থক কবি।
তাঁর কবিতা আলোছায়ার লুকোচুরি খেলা। এখটি সরলরেখা ধরে ছুঁয়ে আসা যায় না।
যাই হোক, কবিতা বোধের জিনিস মনে করি না,
বা বিশ্বাস করি না। কবিতা দর্শন এবং অনুভবের হরগৌরি মিলন। এখানে কবির ফাঁকি নেই। ফাঁকি দেননি বলেই একটি সজনে ফুলের কাছে রাখতে পেরেছেন নিঃশর্ত সমর্পণ। তাঁর চতুর্থ কাব্যগ্ৰন্থ সজনেফুল ও নিঃশর্ত সমর্পণ। কবিতা গুলো পড়ে মনে হোলো কবি সম্পৃক্ত ভাবে মিশে গেছেন গ্ৰাম প্রকৃতির নাড়ীর ভেতর।
তাই কবি বলতে পারেন---
"সজনে ফুলে লেগে থাকা ভোর,অয়ন কুয়াশা/
কবিতা রং এর আলাপ; শব্দের ঝুমঝুমি/
মৌমাছির ঘরকন্নায় তিল তিল মধু সংগ্ৰহ করে নদী নির্যাস।"
(সজনে ফুল ও নিঃশর্ত সমর্পণ,পৃঃ৭)
কোনো ফুলের ভোর মানেই রঙে গন্ধে বেড়ে যাওয়া কোমলতার ঐশ্বর্য। মাটি হয়ে ওঠে ষোড়োশী মোহিনী। তখন চোখের কুয়াশা ছাপিয়ে যায় নান্দনিক এক আলো। যা অন্তরের সমস্ত ছায়া নাশ করে কবিকে নিয়ে যায় কবিতার ঘরে। যা কবির নিজস্ব ঠিকানা। নৈঃশব্দের ভেতর শ্রম আর রক্তের বিরল শান্তি সঞ্চয়। সেই শান্তি আশ্রমের বুকে শুয়ে কবির চোখ চলে যায় জন্মভূমির দিকে--
"আমার আস্থাদের নিয়ে একা একা হাঁটে গ্ৰামপথ"/
অন্তরের আস্থা অর্থাৎ ভরসা বা আত্মবিশ্বাসে যদি ফাঁক না থাকে,তা দীপ ধূপ চন্দনে মুখরিত হয়। এবং ক্রমে সে বার্তা ছড়িয়ে পড়ে সময়ের প্রতিধ্বনি হয়ে দশদিকে। মোটকথা বিশ্বাস পূজা পসরার মতো পবিত্র হোলেই কেউ না কেউ বহন করবেই প্রিয়জনের মতো ভালোবেসে। যা আমার নিজস্ব অনুভব। এবং কবিরও।
সব হৃদয় একই বিশ্বাস বহন করে না। তাই দেখারও বিস্তর ফারাক। যেমন সব কবিতা এক রঙ নির্যাস ধারণ করে না। তবে শ্বাস একই।
"তখন শরীরে কেবল আকাশ থাকে/
আর ঈশ্বরীর আঁচলে ফণীমনসার মেধা।"
(পথ )
হৃদয় মুক্ত হলেই উঠোন থেকে আকাশ পর্যন্ত এঁকে নেওয়া যায় বাসনার রোদছবি। তখন দুচোখে আলোর তৃষা। সেই আলোর কাছে পৌঁছোতে গিয়ে জীবন অথবা হৃদয়ের অবক্ষয়ের চিন্তারা নেমে আসে না ধারণায়। হোক কাঁটা কংক্রিট চড়াই উৎরাই পথ। যেতেই হবে সেই তার কাছে কাঁটা ছাড়া প্রিয় মানুষটির কাছে কিছুই নেই হয়তো।
তবু সেই সত্য। সেই ধ্রুব। ঈশ্বরীর আঁচলে ফণীমনসা থাকলেও কবি নির্দ্বিধায় ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। কেন কি এটাই কবির সহিষ্ণুতা। পৌরুষ।
"দুপুর রোদে যদি বাজে বিসমিল্লার সুর
মনে হয় সারা রাতের জীবাশ্ম খুইয়ে আসছে
ভোর,"
(আর্তি---এক)
ঈশ্বরের কোনো ধর্ম নেই। তিনি হিন্দু,কি খ্রীষ্টান কি নিগ্ৰো কি মুসলিম-- তিনি একটা শক্তি। তিনি একটা জাগরণ।যার প্রকাশে জন্ম মৃত্যু আলো আঁধারের লীলা চলছে। সেই ঈশ্বরের স্তব, তার মহিমা পাঠের আনন্দ অপার। যার কীর্তনে রাত মুখরিত ছায়া সরে যেতে বাধ্য। আঁধার চিরকাল আলোকে ভয় পায়।
"ক্লান্ত পতনের পাড় পেরিয়ে আবার সেই নদীর কাছে এলাম এই নদী আগাম নিয়েছিল
আমার গ্ৰাম"
(পূনর্বাস)
পরিণতির কথা না ভেবেই হৃদয় জল বলে ডুবে যায় জলে। আর এটাই তো হৃদয় হৃদয়ের কাছে নিঃশেষ সমর্পণ। এখানে কৃপণতা প্রকাশ পেলেই মনের চারপাশে উড়তে থাকে ধুলো বালি কুয়াশা। যেতে হোলে বুক খুলে যাওয়া চাই।যা কবি দুঃসাহসিক ভাবে পেরেছেন সফল হোতে। কিন্তু উজাড় করে দেওয়া নদীটি নিঃস্ব করেছে কবিকে। কাঙাল করেছে। তবুও তিনি সেই নদীর কাছেই ফিরেছেন। কেন কি প্রেমই চেতনা।প্রেমই মহাশক্তি।প্রেম ব্যতীত বৃক্ষের একটি পাতা নড়ার জো টি নেই। দহন ক্ষত শূন্যতা নিয়ে দহনের কাছে ফিরে আসাটাই হৃদয়ের সার্থকতা।
"খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে
আগাম দিনের জল বিরহে"
(জল বিরহ)
সব মেঘ চুরি করে উড়ে যায় কালবৈশাখী হা হা তাপ সাহারায়। নির্বোধ চিল উড়ছে। ফিরছে না মাটির কাছে। আগামীর ছবিটা এইরকম। কিছু একটা দেখে কঁকিয়ে উঠছে কবির বুক। দুচোখে আকুলতার অশ্রু বিরহ। সব কবির অন্তরে শুয়ে আছে একটি করুণাময় সমুদ্র। যে কেবল ভাসিয়ে দিতে চায় ভীষণ খরাকাল। ধরিত্রীকে সাজাতে চির মোহিনী তিলোত্তমা রূপে। কিন্তু বাস্তব,রোগ শোক জরায় ভরা বিবর্ণ ধোঁয়াশাময়। কবিরা বহুদূরের সুন্দরের কথা ভেবে সাজাতে চায় নব বধূটির মতো। বাস্তবে তার যথার্থ রূপ পায় না।
তবু চিন্তার বিকাশ, যদি আগামীকাল বৃষ্টি আসে তুমুল, যদি আসে
"ক্ষোভ নেই, আছে সূর্যের নরম দোকান
প্রচুর কবিতার দাগ ভাঁজে ভাঁজে।"
(গেঁয়োপথ--একটি মনসাগাছ)
যে আলোয় চোখ পাতা যায় মন মজে যায় সেখানেই।আর সেই আলোর দোকান যদি সেজে ওঠে শিশু রবির কলতানে তাহলে তো কথাই নেই। সামনের কাঁটা আর পেছনের খরাময় অন্ধকার পিছু নেবার সাহস করে না।
এখানে কবির ব্যক্তি সত্ত্বার ভেতর এক মহাচেতনাময় দীপ্তির প্রকাশ দেখি।যা কবির ঐশ্বর্য কবিতার গোলাঘর।
"যে মেঘ ছুঁয়ে আছে তার পায়ের আঙুলে
তার বুকে সাগর হংসের কামনা
তুষ্ট নয়, কেবল ভাঙতে চায় আড়াল করা বাঁধ"
(লাঙলকাটা)
বাসনা যতই নিম্নগামী হয় বেড়ে যায় ইচ্ছের আগুন।চাঁদঢালা জোয়ার দুলে ফুলে ওঠে হংসমুখি কামনায়। দ্বিধা দ্বন্দ্ব প্রতিকুলতার পাঁক সরিয়ে হৃদয় ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। সে আগুন হোক বা কাঁচ কাঁটা। একটা সফল মৃত্যুর জন্য ফিরিয়ে দেওয়া আত্মহত্যা।
কবির কাছে কবিতাই তার প্রেমিকা। সর্বনাশা নদী, ঈশ্বরী।যে সমস্ত প্রাচীর ভেঙে গুঁড়িয়ে কবিকে নিয়ে যায় বাউল দেশে। বুক ভরে শ্বাস নেন কবি ও কবিতা।
"ধূসর আকাশ ঝরে যাচ্ছে ফুলের মতো; ঘনীভূত
নিম্নচাপে মাই দেওয়া মমতার নরম হাত।"
(মা)
সময়ের কালাজ্বর। চোখ পেতে মাখা যায় না রোদ। মাটি থেকে চাঁদের দূরত্বে ভালোবাসার মতো কুহক ওড়ে।নক্ষত্র ঝরছে মরা ঋতুর মতো। তার ভেতরেই জন্ম নিচ্ছে আলো স্বপ্ন প্রেম। কেন কি কবি আছেন তাই।
এতো বিবর্ণতা, রক্তপাত, বিপর্যস্ত ছায়া প্রেতের ভেতর প্রহবি বেদনার অহংকার নিয়ে স্তনহাতটি ক্রমশঃ প্রসারিত করছেন প্রসূতি জননী।
এই ভাবনার কাছে আমি স্তম্ভিত। নতজানু।
প্রার্থনা করি আজকের এই ভয়াবহ ভুত ভুত সময়টা জননীর স্তন হয়ে উঠুক। সময় শিশুর কান্না থেমে যাক। কবির চোখ ছুঁয়ে থাক, সজনে ফুলের উত্তাপ।
সজনে ফুল ও নিঃশর্ত সমর্পণ
লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল
প্রথম প্রকাশ---২০১১
প্রকাশক--তূর্য
প্রচ্ছদ ---সুব্রত চৌধুরী
দাম---৮০ টাকা
_______________________________
আলোচনার জন্য আপনিও আপনার বই পাঠাতে পারেন।
www.jaladarchi.com
0 Comments