জ্বলদর্চি

দিল্লি দর্পণ - ৪

দিল্লি দর্পণ 

কা লী প দ  চ ক্র ব র্ত্তী

বাঙালিদের আগমন (৪র্থ পর্ব)

বাঙালিদের দিল্লি আগমন নিয়ে খোঁজ করতে গিয়ে জানলাম, উমাচরণ বসু নামে এক  ভদ্রলোক ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দের কোনও একসময় দিল্লিতে এসেছিলেন। তিনি প্রথমে ফৌজির চাকরি নিয়ে এলাহাবাদে আসেন এবং পরে সপরিবারে এলাহাবাদ থেকে কানপুর যান।কানপুর থেকে তিনি একা ঘোড়ায় চড়ে দিল্লি আসেন ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে। পরিবারের বাকী সদস্যদের তিনি গরুর গাড়ি করে তার আগেই দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা করিয়ে দিয়েছিলেন।সে সময় দিল্লিতে দ্বিতীয় আকবর রাজত্ব করছিলেন। তার রাজত্বের তখন জরাজীর্ণ অবস্থা ছিল।তখনকার দিল্লি ছিল চাঁদনিচক, কাশ্মীরী গেট, ফতেপুরী,দরিয়াগঞ্জ, পাহাড়গঞ্জ ইত্যাদি এলাকা নিয়ে ছোট্ট একটি জনপদ, যাকে বাদশাহি ভাষায় বলা হত শাহজাহানাবাদ।এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি উমাচরণ বসু দিল্লি আসার আগে অবশ্য রাজা রামমোহন রায়ও দিল্লী এসেছিলেন, তবে তিনি এসেছিলেন সে সময়কার বাদশাহ দ্বিতীয় আকবরের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে।  
জানা যায়, উমাচরণ বসু মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও উর্দু, ফারসি এবং আরবি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।
উমাচরণের বংশের পরবর্তীকালের যে মানুষটি সম্পর্কে বেশি জানা যায়, তিনি হলেন প্রফেসর সুধীর বোস (১৯০০-১৯৭০)। তিনি সেন্ট স্টিফেন্স কলেজের একজন খ্যাতনামা অধ্যাপক ছিলেন। বলা হয় আদব কায়দায় তিনি ছিলেন একশভাগ ইংরেজ কিন্তু মনেপ্রাণে একশভাগ বাঙালি।সে সময়কার যেকোনোও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এবং খেলায় তিনি ছিলেন মধ্যমণি। সাংস্কৃতিক মনস্ক দিল্লি-বাসীরা এখনও তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।বোস পরিবারের আরও অনেকেই ছিলেন দিল্লির সম্মানিত বাঙালি । 
শ্রদ্ধেয় জ্ঞানেন্দ্র মোহন দাস-এর লেখা “বঙ্গের বাহিরে বাঙ্গালী’ লেখাটি পড়ে জানতে পারি যে দিল্লি শহরে ১৮৩৯ খৃষ্টাব্দে যখন গবর্নমেন্ট ডিস্পেন্সরী খোলা হয় তখন বাবু রাজকৃষ্ণ দে সেটির দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়ে দিল্লি আসেন। ১৮৪০ খৃষ্টাব্দে তিনি মারা যান। ওই বছরই মহাত্মা কৃষ্ণানন্দ ব্রক্ষ্মচারী দিল্লিতে কালীবাড়ির স্থাপনা করেন।জানা গেছে তিনি সারা ভারতে ৩২টি কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহের সময় পর্যন্ত অর্থাৎ ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত ওই কালীবাড়িটি যমুনার উপকুলে কাগজী মহল্লায় ছিল। বিদ্রোহীরা সেটি ভেঙে ফেলে এবং জ্বালিয়ে দেয়।মন্দিরটি ধ্বংস করে দুর্বৃত্তরা ক্ষতিগ্রস্ত মূর্তিটি যমুনার জলে ফেলে দেয়। বিদ্রোহের তাণ্ডব শেষ হওয়ার পর নীলমণি (নীলমাধব) ব্রক্ষ্মচারী নামে জনৈক বাঙ্গালী যমুনা-গর্ভ থেকে মা কালীর মূর্তিটি তুলে এনে যথাবিহিত সংস্কার সাধনের পর কুঠিয়াল কৃষ্ণদাস গুড়-ওয়ালার বসতবাড়িতে মাতৃ মূর্তিটি পুনঃ-প্রতিষ্ঠিত করেন। এ কাজে তাকে সহায়তা করেছিলেন শিবচন্দ্র বসু, গোপাল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য ও আরও অনেক ভক্ত। স্থান সংকুলান ও অন্যান্য নানা কারণে ডাঃ হেমচন্দ্র সেনের হস্তক্ষেপে রোশনপুরার একটি ভাড়া বাড়িতে মায়ের মূর্তিটি স্থানান্তরিত করা হয়। এই সময় থেকেই অবাঙালি ভক্তদের আগ্রহে বলি প্রথা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই মায়ের মূর্তিটি ছিল অষ্টধাতুর তৈরি এবং সেটি দক্ষিণা কালীর মূর্তি ছিল। হাবড়ার বসন্তপুর গ্রামের বৈকুণ্ঠনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এর নিত্য পূজারি ছিলেন। 
১৮৭৮ সালে ভরতপুর থেকে রেলে চাকরী নিয়ে এসেছিলেন গোপালকৃষ্ণ ভট্টাচার্য মহাশয়। পরে তিনি রেলের চাকরী ছেড়ে ব্যবসা করে বেশ ধনী হন। জয়পুর রাজ্যের ভূতপূর্ব মন্ত্রী সংসারচন্দ্র সেন মহাশয়ের সহোদর ডাক্তার হেমচন্দ্র সেন মহাশয় দিল্লিতে সে সময় একজন নামকরা এবং সম্মানীয় ডাক্তার ছিলেন।জানাযায় তিনি দিল্লিবাসী বাঙালিদের থেকে চিকিৎসার বিনিময়ে কোনও ফিস নিতেন না।তাঁর মত এরকম জনদরদী চিকিৎসক দিল্লি শহরে খুব কমই দেখা যায় বা দেখা যায়না বললেই চলে।   
এরপর বহুবছর পরে ১৯১৬-১৭ সালে ভক্তেরা ত্রিশ (তিস) হাজারীতে মায়ের মন্দিরের জন্য জমি কেনেন।মন্দির নির্মাণে এগিয়ে আসেন অক্ষয় চন্দ্র বসু, ডাঃ মাধব চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ঈশানতোষ মিত্র এবং আরও অনেক ভক্ত। এছাড়া আর্থিক সহায়তায় এগিয়ে এসেছিলেন বর্ধমানের মহারাজা, দ্বারভাঙ্গার মহারাজা,মহারাজা মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দী, শেঠ যুগল কিশোর বিড়লা, কানোড়িয়া এবং সাধারণ ভক্তেরা।বাঙালির এই ধর্মীয় মিলন ক্ষেত্র থেকেই অঙ্কুরিত হয়েছিল বাঙালিদের সাংস্কৃতিক জীবন,রঙ্গতামাশা, নাটক এবং শিক্ষার প্রয়াস।জানা গেছে ‘বঙ্গ সাহিত্য সভা’ এবং বাঙালি স্কুল ‘ বেঙ্গলি বয়েজ স্কুল’-এর পরিকল্পনা এই কালীবাড়িতে বসেই হয়েছিল। 

তথ্যসূত্র – দিল্লির চাঁদনিচকে কিছুকাল – পূষন কুমার দত্ত
        লালকেল্লা – প্রমথনাথ বিশী
        দিল্লির বাঙালি – চিত্তরঞ্জন পাকড়াশী 
        মুছে যাওয়া দিনগুলি – প্রবীর কুমার ঘোষ 
        দিল্লি স্টুডেন্ট গাইড – স্টুডেন্ট এইড পাবলিকেশন্স, দিল্লি
        দিগঙ্গণ ম্যাগাজিন 
        উন্মুক্ত উচ্ছাস ম্যাগাজিন 
        দিল্লির বিভিন্ন স্থানীয় পত্র-পত্রিকা এবং ম্যাগাজিন

Post a Comment

8 Comments

  1. লেখকের লেখনী সমৃদ্ধ করছে আমাদের।

    ReplyDelete
  2. লেখকের লেখনী সমৃদ্ধ করছে আমাদের।

    ReplyDelete
  3. অনেক অজানা ঘটনা ও ঐতিহাসিক তথ্য জানা গেল। পরের কিস্তির অপেক্ষায় রইলাম।

    ReplyDelete
  4. সুব্রত ঘোষAugust 6, 2020 at 1:47 PM

    সাহিত্যে প্রত্নতাত্ত্বিকতা ।

    ReplyDelete
  5. তুষার রায়August 6, 2020 at 2:07 PM

    কত অজানা তথ্য জানলাম ।অভিনন্দন আর ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  6. খুব ভালো লাগল বিষয় গুলো জানতে পেরে । জানবার তথ্য যে সীমা হীন তা বলাই বাহুল্য।

    ReplyDelete
  7. তথ্য সমৃদ্ধ সাবলীল লেখা । পরবর্তী সংখ্যার জন্য পাঠক উন্মুখ হয়ে থাকে ।

    ReplyDelete
  8. সুদেব ভট্টাচার্যAugust 29, 2020 at 10:29 AM

    খুব ভালো লাগলো। বহু অজানা তথ্য তুলে ধরার জন্য লেখক কে ধন্যবাদ

    ReplyDelete