জ্বলদর্চি

হিমালয়ের পথে চলতে চলতে - ৯

হিমালয়ের পথে চলতে চলতে || 
নবম পর্ব 

দে ব ব্র ত  ভ ট্টা চা র্য্য


কেদারনাথ দর্শন 

বিশ্বপালক হিমালয় পরিব্রাজক সরলমতি মহেশ্বরের স্বগৃহ বলে ধরা হয় কেদারনাথ ধামকে। সব চেয়ে দুর্গম এ শিবক্ষেত্র। মন্দির প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আমরা দুজন সমতলবাসী প্রকৃতই ভাগ্যবান। সমগ্র দেহমন জুড়ে সে পরম শক্তির ছোঁয়া অনুভব করলাম। 
       পরিপূর্ণ পুণ্য লাভের জন্য মন্দির প্রদক্ষিণ রীতি। আমরাও চললাম প্রদক্ষিণে। মন্দিরের পেছনে অনেকটা চাতাল। সবটাই বাঁধানো। তারপরে বেশ কিছুটা উঁচু পাঁচিল। পাঁচিলের ওপাশে পাহাড়ের চড়াই শুরু। অনেক ছোট বড় প্রস্তর খণ্ড বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়ানো। কিন্তু দেখলাম পাঁচিলের ঠিক পাশে একটি সুবৃহৎ শিলাখণ্ড। অতিকায় সেই শিলাখণ্ডটি লোহার চেন দিয়ে ঘেরা। ভাবলাম, এও বুঝি বাবার অপর একটি রূপের প্রকাশ। আমি এগিয়ে গেলাম ,
  -চলুন ভবেশদা, দর্শণ করে আসি। 
  কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে গেলাম। অনেক পুণ্যার্থী শিলাটিকে ঈশ্বর জ্ঞানে প্রণাম করছে। সবার দেখাদেখি আমরাও মাথা ছোঁয়ালাম চেন আটকানো স্তম্ভে। ঠিক তখনই চোখে পড়ল একটি সূচনা। স্তম্ভের সঙ্গে আটকানো একটি ফলকে হিন্দিতে লেখা। বড় বড় করে লেখা -
-"ভীমশিলা"। নীচে হিন্দিতে লেখা হলেও বেশ পড়া গেল, 
-এই শিলা 2013 সালের 16 জুন পাহাড়ের ওপর থেকে তীব্র জলস্রোতের ধাক্কায় গড়িয়ে আসে। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে এখানে এসে হঠাৎই স্থির হয়ে যায়। শিলার বাধায় সে বাণের স্রোতধারা দুভাগে বিভক্ত হয়ে মন্দিরের দুপাশ দিয়ে বয়ে যায়। বাবার মন্দিরকে স্পর্শও করেনি। 
  -করাল ধংস লীলায় সব কিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষ, প্রাসাদোপম অট্টালিকা, দোকান বাজার,গুহাবাসী,
অসংখ্য আশ্রমিক এবং মন্দিরের পান্ডা -সব কেমন ভোজবাজির মত অদৃশ্য হয়ে গেছে। কেবল বাবা কেদারনাথ মন্দির আর সে মন্দিরে আশ্রয় নেওয়া কিছু ভক্তজন অক্ষত থেকে গেছেন। 
  এই কথাগুলি বলছিলেন সাধনবাবু। সাধন ভট্টাচার্য্য। 
 -মন্দিরের গর্ভগৃহে আমিও সেদিন আশ্রিত ছিলাম। বাবার করুণার এ কোন পৌরাণিক কাহিনী নয়। কলিযুগে এ ভাবে প্রত্যক্ষ করুণা লাভ! আমার পুনর্জন্ম ঘটেছে। 
  দেখলাম, সাধনবাবুর দুটি চোখ বন্ধ। দু গাল বেয়ে নেমে আসছে আনন্দ ধারা। এ প্রেমধারায় আমাদের হৃদয়ও বিগলিত হ'ল। কিছুসময় আমরা চাতালের কোনায় স্থির ভাবে বসে রইলাম। 
  সাধনবাবুই প্রথম কথা বললেন, 
 -ঐ যে দোকানে আপনারা পূজোর অর্ঘ্য নিলেন, ঐ ছেলেটিও সেদিন‌‌‌‌‌‌ আমার সঙ্গে  ছিল। আরতি দেখতে গিয়েছিল। ওর সম্পূর্ণ পরিবার আজ মন্দাকিনীর কোন বাঁকে পাথরের তলায় ঘুমিয়ে আছে। ও আমারই মত এক নিঃসঙ্গ ভাগ্যবান। অমর পুণ্যের অধিকারী। 
    আমরা কথা বলতে পারছিলাম না। ভবেশদা বললেন, 
  -সাধনবাবু -
  -হ্যাঁ বলুন। 
  -একটা প্রার্থনা রাখবো? আপনাকে একবার স্পর্শ করতে পারি? 
  সাধনবাবু হেসে ফেললেন। দু হাত বাড়িয়ে আমাদের দুজনকে বুকে টেনে নিলেন। আমরাও দুচোখ বুঁজে ঈশ্বরের  স্পর্শসুখ অনুভব করলাম। 
         ধীরে ধীরে বাস্তবে ফিরে এলাম আমরা। নতুন করে কনকনে ঠাণ্ডার অনুভূতি এসে রক্তের প্রবাহ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। পরিস্কার মেঘমুক্ত আকাশ। মন্দিরের ঠিক পেছন থেকেই উঠে গেছে ছোট বড় পর্বত শ্রেণী। প্রতিটি শৃঙ্গ বরফের মুকুটে সাজানো। সমতলে বসে সে সৌন্দর্য আজও সমান উজ্জ্বল। 
  সাধনবাবু বললেন, 
 -বাবা কেদারনাথের সন্ধ্যারতি দৃশ্য, সে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। রাজবেশধারী নীলকন্ঠের সামনে বিশাল দীপদান হাতে নিয়ে আরতি শুরু হয়। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে ঘি ও কর্পূর শিখায় সে আরতি দেখার জন্য বোধহয় দেবতারাও অলক্ষ্যে এসে হাজির হন। অগণিত ভক্তের উদাত্ত কণ্ঠে "ওঁ নমঃ শিবায় "ধ্বনি দূরের কেদারনাথ পর্বতের কোনায় কোনায় প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে আবার ফিরে যায়। 
     সাধনবাবু আর এক আশ্চর্য কথা শোনালেন -
  -জানেন কি? পূর্বে বদ্রীবিশাল মন্দিরের পুরোহিতই কেদারনাথ মন্দিরের পুজোর দায়িত্বে ছিলেন। একই দিনে বদ্রীবিশালের আরতি শেষ করে পায়ে হেঁটে চলে আসতন কেদারনাথ মন্দিরে। তখন নাকি এই দুই মন্দিরে যাওয়া আসা করার জন্য একটি বিশেষ পথ ছিল। তার দূরত্ব নিশ্চয় খুব বেশী ছিল না। 
  আমার মত যাঁরা এই দুই মন্দিরের বর্তমান দূরত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তাঁরা তো বিস্ময়ে হতবাক হবেন সন্দেহ নেই। 
   বহু মানুষ যাওয়া আসা করছেন। কিন্তু সবাই যেন চুপিসারে কথা বলছেন। যেন সবাই ধ্যানস্থ। আসলে এখানে  কখনও জোরে কথা বলতে নেই। কারণ বাবার ধ্যান ভঙ্গ হলে এক মহা প্রলয়ের সূচনা হবে। আমি সাধনবাবু কে প্রশ্ন করলাম -
 -শুনেছি বাবা কেদারনাথ হলেন দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের প্রথম এবং প্রধান। এই জ্যোতির্লিঙ্গ সম্পর্কে সামান্য কিছু জানতে চাই। যদি আপনার অনুমতি হয় -।
  সাধনবাবু দুহাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, 
-সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে এক বা একাধিক জ্যোতির্লিঙ্গের অবস্থান। কিন্তু তাদের বিষয়ে জানার আগে জ্যোতির্লিঙ্গের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি প্রচলিত কাহিনী বলে নিতে হবে। 
    আমরা আরো উৎসুক হৃদয়ে নতুন কাহিনী জানার জন্য তৈরী হোলাম ।
 -ব্রহ্মা ও বিষ্ণু এ জগৎ সংসারের সৃষ্টি ও পালন কর্তা। এঁরা দুজনেই মনে মনে নিজেদের শ্রেষ্ঠতর মনে করতেন। এই মানসিক বিরোধ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এক সময় সে বিরোধ মন থেকে প্রকাশ্যে এসে পড়ল। তাঁরা একে অপরের সাথে বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন। বিরোধ আরও বৃদ্ধি পেলে তা শেষে প্রকৃত যুদ্ধে পরিণত হ'ল। দুজনেই যুদ্ধাস্ত্রে নিপুণ। ঘোরতর যুদ্ধ এমন রূপ নিল যাতে সমগ্র বিশ্ব প্রায় লয় হওয়ার উপক্রম। দেবতাকুল ভীত সন্ত্রস্ত হ'য়ে মহাদেবের শরণাপন্ন হলেন। মহাদেব সব শুনে দেবতাদের আশ্বস্ত করে চললেন রণক্ষেত্রে। দুজন প্রতিপক্ষ তখন একে অপরের উপর বিভিন্ন দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করে চলেছেন। অনোন্যপায় মহাদেব দুজনের মাঝে এক স্তম্ভলিঙ্গ রূপে অবতীর্ণ হলেন। তিনি দুজনকে বললেন -
  - হে দেব কুলতিলকদ্বয় ,আপনারা অস্ত্র সম্বরণ করুন। এ কাজ আপনাদের শোভনীয় নয়। 
  ব্রহ্মা ও বিষ্ণু নিজেদের ভুল বুঝতে পারলেন। তাঁরা শান্ত হ'য়ে শিবের স্তবগান শুরু করলেন। স্তবগানে তুষ্ট মহাদেব বললেন -
  -আমার এই লিঙ্গরূপই আজ থেকে বিশ্বে পূজিত হবে। কিন্তু এর দিব্যজ্যোতি মানবকুলের কাছে সহনীয় হবে না। তাই এর প্রস্তরীভূত রূপ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দিলাম। এগুলির প্রতিটি আজ থেকে জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে পূজিত হবে। 
         পরবর্তী কালে মহাগুরু শঙ্করাচার্য ভারতবর্ষের সকল শিবক্ষেত্র দর্শণ করেন এবং তাদের মাহাত্ম্য বিশ্লেষণ করে বারটি ক্ষেত্রকে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের মর্যাদা প্রদান করেন। 
  সাধনবাবু স্থির হলেন। আমার বন্ধুবর জানতে চাইলেন -
  -ঐ জ্যোতির্লিঙ্গ গুলি ভারতের কোন্ কোন্ স্থানে অবস্থিত? মানে জানার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল --
  সাধনবাবু হাসলেন। 
  -দুটি বা একটি ছাড়া আমি সবক'টি জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শণ করেছি। দেখি, তাদের অবস্থান স্মরণে আসে কিনা। 
  আমি তাঁকে থামিয়ে দিলাম। 
   -একটু অপেক্ষা করুন। আমি এখনই আসছি। 
    এক ছুটে আমি পুজোর সামগ্রী কেনার দোকানে পৌঁছলাম। দুটো ব্যাগ আর দু'জোড়া জুতো নিয়ে ফিরে এলাম আগের স্থানে। 
  -আসলে এত সব নাম ধাম তো আর স্মৃতিতে ধরে রাখা সম্ভব নয়। তেমন শক্তি আমার নেই। তাই -
  ব্যাগ থেকে ডট্ পেন -ডায়েরী বের করলাম। সাধনবাবু অপেক্ষা করছিলেন। আমার ব্যাবস্থা দেখে হাসলেন। এবার তিনি শুরু করলেন -।আমিও সেগুলি সংক্ষেপে লিখে চললাম। 
 -এক) বাবা কেদারনাথ -উত্তরাখণ্ড -হিমালয়ের বুকে একমাত্র জ্যোতির্লিঙ্গ। 
 দুই) বাবা বিশ্বনাথ -বারাণসী (কাশী) -উত্তরপ্রদেশ। গঙ্গার তীরবর্তী একমাত্র জ্যোতির্লিঙ্গ। 
তিন) বাবা বৈদ্যনাথ -ঝাড়খণ্ড -দেওঘর। 
চার) মহাকালেশ্বর -মধ্যপ্রদেশের উজ্জ্বয়িনী তে অবস্থিত। 
পাঁচ) বাবা ওঁকারনাথ -মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে। নর্মদা নদীর তীরে অবস্থিত। 
ছয়) বাবা রামেশ্বরম -তামিলনাড়ু তে সেতুবন্ধে। শ্রীরাম নিজে হাতে এ শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন। 
সাত) বাবা মল্লিকার্জুন -অন্ধ্রপ্রদেশ -শ্রীশৈলম। একই কমপ্লেক্সের মধ্যে জ্যোতির্লিঙ্গ স্থান এবং ব্রহ্মরম্বা নামে একটি শক্তিপীঠ অবস্থিত। 
আট) বাবা সোমনাথ -গুজরাট -সৌরাষ্ট্র। আরব সাগরের তীরে অবস্থিত। এ মন্দির বহুবার মুসলিম নবাবদের হাতে ধংস হয়। 
নয়) বাবা নাগেশ্বর -গুজরাটের দ্বারকাপুরী তে অবস্থিত। 
দশ) বাবা ত্রৌম্বকেশ্বর- মহারাষ্ট্রের নাসিকে অবস্থিত। রোগ মুক্তির জন্য বিশেষ ভাবে বিখ্যাত। 
এগারো) বাবা ভীমশঙ্কর -মহারাষ্ট্রের সহ্যাদ্রি পর্বতের উপর প্রায় 3500 ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। পুনের নিকটবর্তী ভোরগিরি গ্রাম। 
বারো) বাবা ঘৃষ্ণেশ্বর -মহারাষ্ট্রের ভীরুলে অবস্থিত। এই মন্দির একটি মাত্র পাথর কেটে তৈরী। মন্দিরটি ওপর থেকে নীচে পাথর কেটে তৈরী। 
  সাধনবাবু একটু থামলেন। তারপর আবার যোগ করলেন 
-তবে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ (ASI) আরও একটি শিবক্ষেত্রকে জ্যোতির্লিঙ্গের মর্যাদা দান করেন। এটি হ'ল বাবা জাগেশ্বর শিবক্ষেত্র। উত্তরপ্রদেশের গাজীপুর। ফতেপুর জেলায় অবস্থিত। 
          আমার কলম থেমে গেছে। কিন্তু মন ছুটে চলেছে এক শিবক্ষেত্র থেকে আর এক শিবক্ষেত্রে। মনে অনুরণিত হচ্ছে, "জয় বাবা কেদারনাথ -ওঁ নমঃ শিবায় "।

Post a Comment

0 Comments