জ্বলদর্চি

দিল্লি দর্পণ - ৫

দিল্লি দর্পণ - ৫

কা লী প দ  চ ক্র ব র্ত্তী

প্রথম বাংলা স্কুল 

১৮৯৯ সালে কাশ্মীরি-গেট (পুরাতন দিল্লি) নামক জায়গায় প্রথম জন্ম নিয়েছিল বাংলা স্কুল। এটির বর্তমান নাম বেঙ্গলি সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল। ১৯৬০ সালে এই স্কুল আলিপুর রোডে স্থানান্তরিত হয়। এই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র শিশির কুমার সেন আই সি এস পরীক্ষা পাশ করে কলকাতা হাইকোর্টের জজ নিযুক্ত হয়েছিলেন ব্রিটিশ আমলে। হকি খেলোয়াড় বীরেন ঘোষ (বীরু ঘোষ) অলিম্পিকে গেইমস-এ হকি খেলার রেফারি হয়েছিলেন। আরও অনেক কৃতি ছাত্র আছেন এই স্কুলের, তাদের নাম এই স্বল্প পরিসরে করা সম্ভব হল না।   
আর নতুন দিল্লিতে সর্বপ্রথম বাঙালি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হল ‘রাইসিনা বেঙ্গলি স্কুল’।রাইসিনা গ্রাম এবং রাইসিনা হিল-এর নামানুসারে স্কুলটির নামকরণ করা হয় ‘ রাইসিনা বঙ্গীয় বিদ্যালয়’। ১৯২৫ সালের ২রা জানুয়ারি জন্ম নেয় এই স্কুল।বর্তমানে এই স্কুলের শাখাও খোলা হয়েছে চিত্তরঞ্জন পার্ক-এ। ১৯২৭ সালে নতুন দিল্লিতেই প্রতিষ্ঠিত হয় লেডী আরউইন স্কুল। এই স্কুলটি কমলা সেনগুপ্তর সুদক্ষ পরিচালনায় শুধুমাত্র দিল্লিতেই নয়, সারা এশিয়ায় বিশিষ্ট কন্যা-বিদ্যালয় হওয়ার দুর্লভ সম্মান লাভ করেছে। এরপর ধীরে ধীরে দিল্লির বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু বাংলা ভিত্তিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। 

১৯৪৮ সালে হারকোর্ট বাটলার স্কুল থেকে আলাদা হয়ে জন্ম নেয় ‘সিমলা বেঙ্গলি বয়েজ স্কুল’। এর এক বছর পর এই স্কুলের নাম বদল করে রাখা হয় ‘ইউনিয়ন একাডেমী’। ১৯৪৮ সালে স্বনামধন্য শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর উৎসাহে এবং তত্ত্বাবধানে জন্ম নেয় ‘ শ্যামাপ্রসাদ বিদ্যালয়’। বিনয়নগর বেঙ্গলি স্কুল প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৫২ সালে। এই স্কুলের প্রতিষ্ঠার পেছনে যার অবদান স্মরণীয়, তিনি হলেন মনিকা সেন। ওনাদের বাড়িতেই এই স্কুলের যাত্রা শুরু হয়েছিল। মোতিবাগে ১৯৬২ সালে জন্ম নেয় ‘বিধানচন্দ্র বিদ্যালয়’। এছাড়া গোল-মার্কেটে নগর-পালিকা বেঙ্গলি বয়েজ এবং গার্লস স্কুল একটি নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
অতীতের দিল্লিতে করোলবাগ, লরেন্স রোড,গোলমার্কেট ইত্যাদি এলাকায় বাঙালিদের বসবাস বেশি ছিল। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি ডি আই জেড এলাকার এবং আশপাশের এলাকার লোকেদের প্রতিদিনের পণ্যদ্রব্যের চাহিদা মেটানোর জন্য গড়ে উঠেছিল ‘গোল মার্কেট’। গোলাকার, চারদিকে রাস্তা নিয়ে ছোট্ট একটা বাজার। দেখা গেছে এরমধ্যে শুরুর দিকে বাঙালিদের দোকানই বেশি ছিল। ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টোর্স’ এবং ‘গ্রেট ইস্টার্ন স্টোর্স’ তখনকার দিনে নামকরা ষ্টেশনারী দোকান হিসেবে বিবেচ্য হত। সেখানে ছিল গৌরি-বাবুর ‘ ভারত ভাণ্ডার’। সেখানে বাংলা বই এবং মাছ ধরার সরঞ্জামও পাওয়া যেত। ‘ইউনিভার্সাল স্টোর্স’ নামে একটি মুদীর দোকানও ছিল সেখানে।‘কমলা ভাণ্ডার’-এ মুদীর জিনিসপত্র ছাড়াও দশকর্মের দ্রব্যাদি পাওয়া যেত। স্কুলের পাঠ্যবই এবং নতুন প্রকাশিত বাংলা বইয়ের দোকান ‘সরস্বতী বুক ডিপো’ এবং ‘বি এন সুর এন্ড কোম্পানি’-র দোকান খুবই বিখ্যাত।বাঙালিরা দিল্লিতে থাকবে আর সেখানে বাঙালি মিষ্টি পাওয়া যাবে না একথা ভাবাই যায় না। তখন ‘কমলালয় মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ পঞ্চানন-বাবুর মিষ্টির দোকান এবং ‘বেঙ্গল স্যুইটস হোম’ গোল মার্কেটের নির্ভরযোগ্য মিষ্টির দোকান হিসেবে খুবই বিখ্যাত ছিল। জামা, কাপড়, শাড়ী ইত্যাদির জন্য ‘মহামায়া স্টোর্স’, ‘নিউদিল্লি ক্লোদিং স্টোর্স’ এবং গিরীন মুখার্জীর দর্জির দোকানেরও খুব নাম-ডাক ছিল। হিলী চ্যাটার্জীর মাছের দোকান এবং ‘লাকী টি’ কোম্পানির দার্জিলিং চা-এর কথা আজও  লোকের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। সে সময় অফিস কর্মীদের লাঞ্চ ও টিফিন করার জন্য বিখ্যাত ছিল ‘গাঙ্গুলি’স টিফিন রুম। অনঙ্গ বোস দ্বারা স্থাপিত হয়েছিল ‘বসু বোর্ডিং এন্ড লজিং হাউস’। গোল-মার্কেট এলাকায় দিল্লিতে আসা বাঙালিদের একটা নির্ভরযোগ্য সাময়িক আশ্রয় হয়েছিল। এই অনঙ্গ-বাবুর পরিচালিত ওষুধের দোকান ‘ব্রিটিশ মেডিক্যাল হল’ এবং কনটপ্রেসের ‘গ্যালেন মেডিক্যাল হল’ আজও  লোকেরা স্মরণ করেন। পুরানো দিল্লির দরিবা কালান এলাকায় বাঙালিদের পছন্দমত গয়নার দোকান ছিল ‘ বেঙ্গল জুয়েলার্স’ এবং ‘ ব্যানার্জী ব্রাদার্স ‘। ১৭-১৮ বছর ধরে ‘লোকনাথ জুয়েলার্স’ এবং করোলবাগের ‘ব্যানার্জী ব্রাদার্স’ও বাঙালিদের গহনার জন্য খুব প্রসিদ্ধ। কনট প্লেসে ‘গাঙ্গুলি ব্রাদার্স’ হল খুবই পুরাতন ঘড়ির দোকান। ভ্রমণ সংক্রান্ত ব্যবস্থায়ও দিল্লির বাঙালিরা পিছিয়ে নেই। বাঙালি পরিচালিত কয়েকটি ভ্রমণ সংস্থা হল, ‘চ্যাটার্জী ট্যুর’, কালীবাড়ি এবং ভগত সিং লেন-এ ‘রিডস ট্রাভেলস্’, গোল মার্কেটে রণজিৎ চ্যাটার্জীর ‘মুরগন ট্রাভেলস্’ এবং ‘রাজেন্দ্র ট্রাভেলস্’। 


তথ্যসূত্র – দিল্লির চাঁদনিচকে কিছুকাল – পূষন কুমার দত্ত
        লালকেল্লা – প্রমথনাথ বিশী
        দিল্লির বাঙালি – চিত্তরঞ্জন পাকড়াশী 
        মুছে যাওয়া দিনগুলি – প্রবীর কুমার ঘোষ 
        দিল্লি স্টুডেন্ট গাইড – স্টুডেন্ট এইড পাবলিকেশন্স, দিল্লি
        দিগঙ্গণ ম্যাগাজিন 
        উন্মুক্ত উচ্ছ্বাস ম্যাগাজিন 
        দিল্লির বিভিন্ন স্থানীয় পত্র-পত্রিকা এবং ম্যাগাজিন

Post a Comment

2 Comments

  1. অতি সুন্দর তথ্য । খুব ভালো লাগল পড়ে ।

    ReplyDelete
  2. আমি আমার কর্মজীবনের শুরুতে গোল মার্কেট অঞ্চলে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছি। লেখাটি পড়তে পড়তে নস্টালজিক হয়ে পড়লাম। তথ্য সমৃদ্ধ এক অসাধারণ লেখা।
    লেখককে ধন্যবাদ।

    ReplyDelete