উপস্থাপনার সাতকাহন - ৪
পৌ লো মী ভ ট্টা চা র্য
আকাশবাণী কলকাতার তৎকালীন কেন্দ্র অধিকর্তা শ্রী প্রদীপ মিত্র একবার আমাদের বলেছিলেন, উপস্থাপনার কাজ যারা সঠিকভাবে করতে পারেন তারা জীবনের অন্য ক্ষেত্রগুলোতে সফল হন। কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। সামান্য কয়েকটি বাক্য কিংবা শব্দ কিভাবে বদলে দিতে পারে পরিস্থিতি ও সম্পর্ক তা বয়স বাড়ার সাথে সাথে ব্যক্তি জীবনে বারবার বুঝেছি। চার দেয়ালের বাইরে এক পৃথিবী সম্পর্ক অপেক্ষা করে আছে আমাদের সবার জন্য।এখনকার বদলে যাওয়ার সময়ে এই সম্পর্কগুলোকে কি নামে ডাকবেন সেটা আপনার উপর ছেড়ে দিয়ে সরাসরি চলে যাই বিষয়ে।
প্রফেশনাল জায়গায় অর্থাৎ একেবারে রুজি-রোজগারের জায়গায় কিভাবে কি কথা বলা উচিত তার শেখানোর জন্য অজস্র কোর্স, ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে। নানা পেশার জন্য নানান উপস্থাপন কৌশল সেলসে চাকরি কিংবা যারা ফ্রন্ট ডেস্কে কাজ করেন তাঁদের একরকম উপস্থাপন কৌশল। আবার যারা সরাসরি না হলেও অপ্রত্যক্ষভাবে আপনাকে সাহায্য করছেন তাদের উপস্থাপন কৌশল আর একরকম। তবে সবকটি ক্ষেত্রেই প্রতিটি পেশার নিজস্ব ট্রেনিং এর মধ্যে দাঁড়িয়ে উপস্থাপনের রংটি বদলে বদলে যায় তবে মূল কথা একই থাকে সার্ভিস। সেইসব ক্ষেত্রের কথা একটু বলব যেখানে সার্ভিস দিতে নয়, নিতে হয় আমাদের। একেবারে সাধারণ জীবনযাপনে সাজিয়ে গুজিয়ে নিজের দরকারটা উপস্থাপন করা বড্ডো জরুরি সেখানে। ভালো থেকে আরো ভালো থাকার জন্য। পেট কামড়ালে, ঠ্যাং ভাঙলে, নিদেনপক্ষে ছোড়দির চারমাসের ছানাটা রাতভর কাঁদলে আমরা দৌড় লাগাই ডাক্তার বাবুর চেম্বারে। হ্যাঁ আপনার হয়তো মনে হচ্ছে এর সঙ্গে উপস্থাপনের কি সম্পর্ক। ডাক্তার দেখাবো, নিদান নেব, কেটে পড়বো। কিন্তু আদতে ব্যাপারটা এত সহজ নয়। আমরা ডাক্তার বাবুর সামনে গিয়ে ভনিতা গৌরচন্দ্রিকা এত বেশি করে বসি যে সামনের মানুষটি খেই পান না। তার সঙ্গে ক্রমাগত সুড়সুড়ি দেয় আমাদের গুপ্ত জ্ঞান প্রকাশ এর ইচ্ছে । যেকোনো উপস্থাপনার জন্য চূড়ান্ত গোল্লা খাবার জায়গা এই ইচ্ছে। কি কি জানি, তা জানানোর জন্য যত বেশি 'হুরুম দারুম' করবেন ততই আপনার নম্বর নিচের দিকে। ধৈর্য এবং মনোযোগ দুটোই ভালো উপস্থাপনের বড় গুণ। আপনার অ্যান্ড্রয়েড সেটের বোতাম চেপে নিশ্চিত খাবারের প্যাকেটটা বর্ষা রাতে হাতে পাওয়ার পর রোগা ছেলেটাকে আড়াই মিনিট 33 সেকেন্ড দেরিতে আসার কথা মনে নাই বা করালেন। ছোট্ট একটা বাক্যে যদি এক চিলতে হাসি উপহার দেন তবে আপনার উপস্থাপনায় কথা বলে উঠবে। সে কথা কথার কথা নয়।
প্রতিটি শব্দ উচ্চারণেই ব্যক্তি মানুষের প্রাত্যহিক জীবন চর্চা ফুটে ওঠে, যা গভীর সংস্কারের মতো জন্ম দেয় এক আবেদনের। রেডিও সম্প্রচারের ক্ষেত্রে কণ্ঠস্বর যেমন প্রয়োজনীয় মাধ্যম, তেমনই তার আবেদন টুকু একেবারে ফেলে দেবার নয়।
খুব ছোট্ট পরিসরে কয়েকটি বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান উপস্থাপনা নিয়ে কথা বলা যেতেই পারে।
প্রথমে কথিকার কথাই ধরা যাক। একেবারেই যা ক্লাস রুমের লেকচার নয়,আবার সেমিনার মঞ্চের দেওয়া গুরুগম্ভীর বক্তব্য নয়। কথিকা একটি চমৎকার বিষয় নির্ভর উচ্চারণ। রেডিও র অচেনা-অজানা শ্রোতার মনোযোগ আকর্ষণ করা ই এর মূল উদ্দেশ্য। আর সে মনোযোগ পাঁচ থেকে দশ মিনিটের বেশি ধরে রাখাও শক্ত। বক্তা ১০ মিনিটের সময়সীমায় কখনোই শ্রোতাকে জ্ঞানী করে তোলেন না। বরং শ্রোতার আগ্রহকে বাড়িয়ে তোলেন, যাতে তিনি এই সম্পর্কে ভাবেন এবং আরো জানার চেষ্টা করেন। শ্রোতার মন আকাশে মননশীলতার বৃষ্টি ছড়িয়ে দেওয়াই মূল উদ্দেশ্য।
রেডিও শব্দ মাধ্যম। শব্দ এবং নৈঃশব্দ্য একসঙ্গে তৈরি করে মুহূর্ত। আর সেইসব মুহূর্তের যোগফলে তৈরি হয় গভীর রসায়ন।তাই রেডিওর আলোচনা ধর্মী অনুষ্ঠান উপস্থাপনার ক্ষেত্রে উপস্থাপকের বাড়তি সতর্কতা থাকেই। এক্ষেত্রে তার ভূমিকাটি মডারেটরের। নির্দিষ্ট বিষয়ের মধ্যে ধরে রেখে প্রয়োজনীয় প্রশ্ন করে সমস্ত অনুষ্ঠানের শরীরে সজীবতা বজায় রাখে সে। আর সেজন্যই আলোচ্য বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান থাকতেই হয়, নইলে আলোচনা কিছুতেই দানা বাঁধে না। আবার যেকোনো সাক্ষাৎকারে , বিশেষত পার্সোনালিটি ইন্টারভিউ এর ক্ষেত্রে উপস্থাপক যেন স্বয়ং শ্রোতার প্রতিনিধি। অতিথির কাছে যেসব প্রশ্ন শ্রোতা জানতে চান, সেগুলোই জেনে নিচ্ছেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই সাক্ষাৎকার নেবার আগে যে ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে, তার সম্পর্কে বিশদ হোমওয়ার্ক খুব জরুরী। শ্রুতি মাধ্যমে সাক্ষাৎকার নেবার সময়, এমন কোন প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়াই যুক্তিযুক্ত, যেখানে অতিথির উত্তর, হ্যাঁ কিংবা না হতে পারে। এক্ষেত্রে সব সময় লক্ষ্য হওয়া উচিত অতিথিকে বিস্তারিত উত্তরের সুযোগ দিয়ে বিষয়ের গভীরে যাওয়া। ব্যক্তিগত প্রশ্নে জর্জরিত না করেও তার জীবন, তার সংগ্রাম, তার মনস্বীতার দিক নিয়ে এমন সব প্রশ্ন কাম্য যেখানে অতিথির একটি ছবি বা প্রোফাইল শ্রোতার মনের আয়নায় অনায়াসে ভেসে ওঠে। প্রশ্ন হবে, ছোট্ট কিন্তু উত্তরের ব্যাপ্তি ঢেকে দেবে যাবতীয় কৌতুহল। এখানেই ভালো উপস্থাপকের একান্ত গরিমা। ভালো সাক্ষাৎকার সবসময়ই আন্তরিক প্রাণখোলা কথাবার্তার এক ঝলক টাটকা বাতাস। ফোন ইন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে শ্রোতাদের সরাসরি অংশগ্রহণ বাড়তি মর্যাদা দিয়েছে শ্রোতা বন্ধুদের। একটু সাল তামাদির দিকে তাকালে দেখবো ভারতে ফোন-ইন অনুষ্ঠান,1990 এর পরে শুরু হলেও, BBC এর প্রচলন করেছিল 1968 তে তাদের লোকাল রেডিওতে। ফোন ইন অনুষ্ঠান শ্রুতি মাধ্যমকে বাড়তি জনপ্রিয়তা দিয়েছে সে কথা বলাই বাহুল্য। স্টুডিওতে হাজির বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বাবুর সঙ্গে কথা বলে উপকৃত হয়েছেন দূরে র শ্রোতা। ক্রেতা সুরক্ষা কিংবা পথ নিরাপত্তা বিষয়ক কথোপকথনে অংশ নিয়ে বহু সমস্যা থেকে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে আসতে পেরেছেন বহু মানুষ। সঠিক প্রশ্ন সঠিক উত্তর... অথচ নিরস বেসামাল কথোপকথন নয়।ভারসাম্যের তুলাদণ্ডটি এক্ষেত্রে কিন্তু উপস্থাপকের মুষ্টিবদ্ধ।
এবার আসি ফিচার প্রসঙ্গে। রেডিও ফিচার এর পরিধি ব্যাপক, উপস্থাপনার পদ্ধতি বিচিত্র। অল ইন্ডিয়া রেডিও প্রথম কন্ট্রোলার লায়নেল ফিল্ডেন ফিচার সম্পর্কে বলেছিলেন...."তথ্য জানানো ও বিনোদনের জন্য সম্প্রচারের সমস্ত কারিগরি ব্যবহার করেই ফিচার অনুষ্ঠান তৈরি হয়।"
ফিচারের সঙ্গে কথিকার একটি প্রাথমিক পার্থক্য, ফিচার এ কথিকার প্রামাণ্যতার সঙ্গে নাটকের নাটকীয় শক্তির মিশ্রণ ঘটানো হয়। অথচ নাটকের কাল্পনিক মোহময়তা থাকে না, বরং সত্য ঘটনা বা চিন্তার সঙ্গে শ্রোতার পরিচয় ঘটানোই ফিচারে উপজীব্য।
"দা লায়নস অফ গির"... এই ফিচারটি নির্মিত হয়েছিল গির অরণ্য পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী মানুষদের লোকগাথা অবলম্বনে, আর ক্রমে ওইসব মানুষদের জীবনচিত্র আর অরণ্যের সিংহদের কথা এসেছে এই ফিচারে। শুনতে শুনতে শিহরণ জাগে। এতটাই বাস্তব তার উপস্থাপনা। পরিসংখ্যানের কচ কচি নয়, অসহজ ভাষার ভার নয়, অথচ চিন্তার চমৎকার ঐক্য শব্দ বা সাউন্ড ইফেক্টস এর মধ্যে দিয়ে অর্থময় হয়ে ওঠে। এখানেই ফিচার উপস্থাপনের মুনসীয়ানা।
0 Comments