জ্বলদর্চি

বাদশামারির গল্পের নদী/ রাখহরি পাল

ফোটোগ্রাফি- সৈয়দ স্নেহাংশু   

বাদশামারির গল্পের নদীরা


রা খ হ রি পা ল


নিজের কষ্ট তত বাজে না

যতটা ঝন-ঝন বেজে ওঠে বাবার স্মৃতি রোমন্থন।

বাধা দিই না। 

শীতল হাওয়ার স্পর্শে ভেসে বেড়ানো বাষ্পকণা

শ্রাবণের ধারার মতো থামতেই চায় না।

বাবা বলতেন,

---"বাবার একটা সার্জের কোট তাতে

সোনার চেনে বাঁধা পকেট রিস্ট ওয়াচ

যেটা পরে রাধাবল্লভপুর তালুকে যেতেন ঘোড়ায় চড়ে।

প্রজারা গলায় গামছা দিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করত।

মাঝে মাঝে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন,

সে কি খাতির! আমাকে বড় বাবু বলত।

জমাদার পুকুরে মাছ ধরা হলে সেরিয়া রুই মাছ,

কাঁচের জারে গাওয়া ঘি ভেট আসত।"

গল্পগুলো রূপকথার মতো

পক্ষিরাজ ঘোড়ার ডানা মেলত কষ্টকল্পের উড়ান।

ফেডারেল কাঠামোয় বাবু সবাই। 

একটা বিধ্বংসী ঝড় থেকে জেগে ওঠা বাঁশঝাড়।

কড়াইয়ের কালো লেগে থাকে মায়ের শাঁখায়। 

দীর্ঘ আলস্যের দোলনায় দোল খেতে খেতে

মাঠে নামার সাহস হারিয়েছেন বাবা 

এখন শুধু ঐতিহ্য বেচে , 

জমি জমা,খাট পালঙ্ক,জানালা,দরজা বন্ধক রেখে

নিঃস্ব মায়ের উনুনে শুকনো কলমীর আগুন জ্বলে।  


একটা এজমালি ঘর,বৈঠকখানা।

আমরা সেখানে মাদুর পেতে পড়তে বসতাম।

মেঝের কিছুটা অংশে উঁকি দেয় তামাটে রঙের শান।

বাবা বলতেন,এখানে মস্ত দালান ছিল

সিংহদুয়ার দিয়ে এখানে ঢুকতে হত।

তার কপাট গুলো এখনো বেমানান ভাবে 

শোয়ার ঘরে লাগানো আছে।    

দেখতাম কারুকার্যময় সুজনিপাতা ফুল

প্রতিটির গর্ভ-পত্রে বসানো ছাতামাথা পেরেক।

একবার লুকোচুরি খেলতে গিয়ে 

চোরাছাদে আবিস্কার করি নক্সশা কাটা

শিঙ দিয়ে বাঁধানো দাদুর ছড়ি,

হাতির দাঁত বাঁধানো গড়গড়া। 

বাবার গল্পগুলো কেন্দ্র বিন্দুতে রেখে

কতবার ভেবেছি,-----

প্রপিতামহী মুক্তাবালা, রুপোর রেকাবি থেকে নিয়ে 

পান মুখে দিচ্ছেন, কিরণী দাসী পুরানো ঘি দিয়ে

হাত পা মালিশ করে দিচ্ছে।

গুনধর দোলাই একটা কিলো আড়াই রুই মাছ

দলিজে রেখে গেল।

রান্নাঘরে বামুনদি, ননীদাসী কোটনা কোটায় ব্যস্ত।

গ্রামের কুলীন মধুবাবুরা আজ দুপুরে খেয়ে তাসের আড্ডায় মাতবেন।

পাইক ধ্রুব সেনাপতি ধরে নিয়ে এসেছে

সোনা পাতর কে ছাগল চুরির অপরাধে।

প্রপিতামহ তারাচরন আরাম কেদারায় বসে হুকুম দিচ্ছেন, দশ ঘা বেত লাগানোর।

লক্ষ্মীচক তহ্সিলের আদায়কৃত খাজনা চুকোচ্ছে খাজাঞ্চিবাবু। 


বাবা বলেছিলেন সূর্যাস্ত আইনের আওতায়

জমিদারি লোপ পেতেই পলস্তারা খসতে শুরু করল।

ঠাটবাট বজায় রাখতে

মেহগনি কাঠের পালঙ্ক চলে গেল রায় বাড়িতে,

কুলদেবতার জন্মাষ্টমীতে দেশ খাওয়ানোর রেওয়াজে  

হাতছাড়া হল সোনার প্যেটা, পাঁচ বিঘার বন্দ-------------।


আমাদের কষ্টে দুঃখ লাগে না

যাপনের প্রত্যহিকতায় আগাগোড়া পোক্ত।

বন্ধুদের অনিচ্ছার শুকনো মুখের দিকে না তাকিয়ে 

চেয়ে নিয়েছি বই,

খাবারের গল্প এড়ানো অসম্ভব হলে 

ঠাকুমার রান্নাঘরের পাত পেড়ে ফেলেছি অবলীলায়।

দাহ দিয়েছে কামারের জল ধরানো কাঠিন্য। 


দাওয়ায় বসে সিংহ মার্কা বিড়ির উষ্ণতায়

যখন স্মৃতির কুন্ডলীকৃত ধোঁয়া ছাড়ে 

অবসাদ ক্লিষ্ট ঠোঁট,

মা বিরক্ত হয়ে বলেন,

---রাখো তোমার বাদশামারি গল্প,

দু পয়সা রোজকারের মুরোদ নেই,-------।  

আমি মাকে আশ্বস্ত করতাম।


স্মৃতি মেদুরতায় নরম হৃদয়ের সরোদ 

আপন খেয়ালে বেজে ওঠে,

কান্নার জমাট বাঁধা অশ্রু জালিকা ভেদ করে নদী হয় না বলেই

সরোদে বেহাগ ধ্বনিত হয়

বাবার দোষ খুঁজে পাই না।

ফোটোগ্রাফি- সৈয়দ স্নেহাংশু   

Post a Comment

0 Comments