জ্বলদর্চি

উপন্যাসের আয়নায় -৪


উপন্যাসের আয়নায় ৪

প্র শা ন্ত  ভৌ মি ক  

হুমায়ূন আহমেদ : শুদ্ধতম মানুষ শুভ্রর খোঁজে

হিমু কিংবা মিসির আলির মত জনপ্রিয় না হলেও, শুভ্রও হুমায়ুন আহমেদের সৃষ্ট এক চরিত্র।
 শুভ্র কে? উপন্যাস অনুযায়ী, শুভ্র শুদ্ধতম মানুষ।  তার চোখের অবস্থা খুবই খারাপ। চশমা খুলে নিলে সে অন্ধ। বন্ধুরা তাকে 'কানাবাবা' নামে ডাকে। বিরাট বড়লোকের একমাত্র সন্তান শুভ্র। শুভ্রর বাবা চান শুভ্র হোক সবার চাইতে আলাদা। কিন্তু শুভ্র চায় সবার সাথে মিশতে। সাধারণ একজন হয়ে বাঁচতে।
শুভ্রকে কেন্দ্র করে হুমায়ূন আহমেদ ছয়টি উপন্যাস লিখেছেন৷ প্রথম উপন্যাস 'মেঘের ছায়া'তে আমরা দেখতে পাই, শুভ্র জানে সে দ্রুত অন্ধ হয়ে যাবে। সে চায় অন্ধ হবার আগে যত বেশি সংখ্যক বই পড়ে নিতে। 
'দারুচিনি দ্বীপ' উপন্যাসে শুভ্র তার বন্ধুদের নিয়ে সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে বেড়াতে যাবে। শুভ্রর বাবা নিরাপত্তার কথা ভেবে ছেলেকে যেতে দিতেই রাজি ছিলেন না। পরবর্তীতে যেতে দিতে রাজি হলেন। কিন্তু পথে পথে লোক ঠিক করে রাখলেন।  যারা শুভ্রর সামান্যতম সমস্যাতেও সহায়তা করতে এগিয়ে আসবে।
'রূপালী দ্বীপ' উপন্যাস হচ্ছে 'দারুচিনি দ্বীপ'-এর পরবর্তী অংশ। এখানে দেখা যায়, বন্ধুদের সাথে মিশে শুভ্র নানারকম অস্বাভাবিক আচরণ করে। শুভ্র সিগারেট খায়, বুফে কারের ম্যানেজারের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে। 
এখানে একটা মজার ব্যাপার আছে। 'দারুচিনি দ্বীপ' বইতে শুভ্র এবং তার বন্ধুরা সেন্ট মার্টিন দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেও সেখানে পৌঁছাতে পারে না। কারণ, লেখক তখনো সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যাননি। 
'রূপালী দ্বীপ' বইয়ের ভূমিকায় নিজেই লিখেছেন- "চার বছর আগে জানুয়ারি মাসের এক প্রচন্ড শীতের রাতে একুশ বছর বয়েসী একদল ছেলেমেয়ে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখতে বসেছিলাম।  উপন্যাসের নাম 'দারুচিনি দ্বীপ'। সেই উপন্যাসে একদল ছেলে-মেয়ে ঠিক করল, তারা দল বেধে বেড়াতে যাবে প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন আইল্যান্ডে। সেখানে কাটাবে পূর্ণচন্দ্রের একটি অপূর্ব রাত। আমি উপন্যাস শেষ করব জোছনার সুন্দর একটি বর্ণনা দিয়ে।
পাত্র-পাত্রীদের আমি কিন্তু প্রবাল দ্বীপ পর্যন্ত নিতে পারিনি। তার আগেই উপন্যাস শেষ করতে হয়েছে, কারণ- আমি নিজে কখনো দ্বীপে যাইনি। স্বপ্নের সেই দ্বীপ কেমন আমি জানতাম না।
এখন জানি। সেই অপূর্ব দ্বীপে আমি নিজে এক টুকরো জমি কিনে কাঠের একটা ছোট্ট ঘর বানিয়েছি। তার নাম দিয়েছি 'সমুদ্র বিলাস'। ফিনিক-ফোটা জোছনায় আমি দেখেছি জ্বলন্ত সমুদ্র-ফেনা। আহা, কী দৃশ্য! সেই প্রায় পরাবাস্তব ছবি দেখতে দেখতে মনে হয়েছে, ঐ তরুণ-তরুণীদের শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাই-না সমুদ্রের কাছে!
যেখানে শেষ করেছিলাম 'দারুচিনি দ্বীপ', সেখান থেকেই শুরু হোক নতুন গল্প 'রূপালী দ্বীপ'। "

'শুভ্র' উপন্যাসে দেখা যায় শুভ্রর বাবা হঠাৎ মারা যান। ফলে শুভ্রর উপর এসে পড়ে পৈত্রিক সকল ব্যবসার দায়িত্ব।  তার মধ্যে একটি পতিতালয়ও রয়েছে৷ শুভ্র চায় সেখানকার বাসিন্দাদের এককালীন কিছু টাকা পয়সা দিয়ে ব্যবসাটি বন্ধ করে দিতে। বাস্তবে দেখা যায়, ব্যাপারটা তত সহজ নয়। 
'এই শুভ্র! এই' বইতে শুভ্রর জীবনের আরেকটি দিক প্রকাশ পায়। শুভ্র জানতে পারে সে তার বাবা-মায়ের আসল সন্তান নয়। তাকে দত্তক নেয়া হয়েছে।
শেষ উপন্যাস 'শুভ্র গেছে বনে'তে আবার একেবারে অন্য রূপে পাওয়া যায় শুভ্রকে। ঘটনাচক্রে শুভ্র পদ্মার এক চরে চলে যায়। সেখানে তার ফর্সা গায়ের রঙের জন্য তাকে 'ধলা মিয়া' নামে ডাকা হয়। চরের নাম হয়ে যায় 'শুভ্রর চর'। চরের সবাই শুভ্রকে ভালবাসতে আরম্ভ করে।

এই যে ভ্রমণ শুভ্রকে নিয়ে, যেটা হুমায়ুন আহমেদ শুরু করেছিলেন 'মেঘের ছায়া' দিয়ে, শেষ করেছেন 'শুভ্র গেছে বনে'তে। এই সম্পূর্ণ ভ্রমণে শুভ্রকে কি চেনা যায়? উত্তর একদিকে হ্যাঁ, অন্যদিকে না।
শুভ্রকে চেনা যায়। কারণ, শুভ্রর চরিত্রের বাহ্যিক দিকটা অনেকটাই প্রকাশিত হয়। আবার শুভ্রকে একেবারেই চেনা যায় না। কারণ, শুভ্রর চরিত্রের ভেতরের দিকটা বারবার তার চেহারা পাল্টেছে। 'এই শুভ্র! এই' উপন্যাসে শুভ্রর মদ খাওয়া কিংবা 'রূপালী দ্বীপ' উপন্যাসে সিগারেট খাওয়া, অন্য বইয়ের পটভূমি চিন্তা করলে, কল্পনাই করা যায় না। 

সব মিলিয়ে শুভ্র এমন একজন, যাকে প্রত্যেকটি তরুণ অন্তরে লালন করে। কিন্তু পারিপার্শ্বিকতার চাপে ভুলে যেতে বাধ্য হয়। শুভ্র বেঁচে থাকবে পাঠকের অন্তরে,  অনুভবে।

Post a Comment

0 Comments