জ্বলদর্চি

উপন্যাসের আয়নায় - ৬

উপন্যাসের আয়নায়  -৬

হুমায়ূন আহমেদঃ সায়েন্স ফিকশনের ভুবনে 
দ্বিতীয় পর্ব


প্র শা ন্ত  ভৌ মি ক

‘ইমা’ বইটি যতটা না সায়েন্স ফিকশন, তার চাইতে একে বেশি বলা চলে সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার। এক টানেল-কর্মী অচেনা এক মহাকাশযানে করে পাড়ি দিচ্ছে দূর মহাশূন্যের কোনো এক গ্রহে। প্রতিরাতেই ঘুমের মধ্যে সে ইমা নামের লাজুক শান্ত হাস্যোজ্জ্বল একটি মেয়েকে স্বপ্ন দেখে। অবশেষে সে জানতে পারে, সূর্যের কাছাকাছি একটি গ্রহে অতি বুদ্ধিমান প্রাণীদের সন্ধান পেয়েছে মানুষ। হাইপারডাইভের মাধ্যমে সেখানে গিয়ে তাদের কাছ থেকে উন্নত প্রযুক্তি সম্পর্কে জানার উদ্দেশ্যেই বিজ্ঞানীরা যাত্রা শুরু করেছেন।
‘দ্বিতীয় মানব’ অনেকটাই ফ্যান্টাসি ঘরানার উপন্যাস। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র খলিলুল্লাহ। সে আসে শিল্পপতি মাহতাব উদ্দিনের বাড়িতে। দুজনে একই গ্রামের লোক। মাহতাব উদ্দিনের কন্যা টুনটুনি খলিলুল্লাহের কর্মকাণ্ডে অবাক হয়। অবাক হলেও দারুণ উৎসাহী হয়ে ওঠে খলিলুল্লাহের অতিমানবীয় কিছু ক্ষমতার ব্যাপারে। তার নিরানন্দ জীবনে দারুণ রোমাঞ্চের সৃষ্টি হয়।
‘নি’ উপন্যাসটি স্কুল শিক্ষক মবিনুর রহমানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। গ্রামের এক শিক্ষক তিনি। খুব ভাল শিক্ষক হবার পরেও গ্রাম্য রাজনীতির যাঁতাকলে পড়ে জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। কিন্তু এতসব প্রতিকূলতার মধ্যেও কোথাও যেন প্রকৃতি মবিনুর রহমানের উপর দয়াপরবশ হয়ে থাকে।
‘তারা তিনজন’ উপন্যাসে ভিনগ্রহবাসীদের গল্পের আড়ালে লেখক জেনোফোবিয়া তথা জাতিবিদ্বেষের দারুণ একটি উপস্থাপন করেছেন। বইয়ের তারা তিনজন হল ভিনগ্রহের প্রাণী লী, অয়ু আর নীম। তারা মানুষের সাথে যোগাযোগ করে নিজেদের জ্ঞান বিস্তারের চেষ্টা করে। হুমায়ূনের সায়েন্স ফিকশনগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা এই উপন্যাস।
‘ফিহা সমীকরণ’ উপন্যাসে দেখা যায় ভবিষ্যতের পৃথিবী চলে গেছে জেনেটিকভাবে উন্নত মানুষ ‘মেন্টালিস্ট’দের দখলে। নিজেদের ডিএনএর উন্নতির কারণে তারা নিজেদের মধ্যে টেলিপ্যাথির মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারে। তাদের শাসনে কোথাও বিশৃঙ্খলা নেই। তবে তাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা পুষে রেখেছেন মহান গণিতবিদ ফিহা। তিনি চেষ্টা করছেন গণিত ব্যবহার করে মেন্টালিস্টদের হাত থেকে পৃথিবীকে বের করার। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর নিজস্ব ঢঙে লিখে গেছেন এক অলৌকিক আখ্যান।
‘ইরিনা’ও ভবিষ্যৎ পৃথিবীর গল্প। মানবসৃষ্ট এক মহাদুর্যোগে পৃথিবী প্রায় ধ্বংসের উপক্রম হয়েছিল। মহাজ্ঞানী কিছু মানুষ সেই অবস্থা থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করেছেন। নতুন পৃথিবীতে সার্বক্ষণিক নজর রেখে চলেছে মহাশক্তিশালী কম্পিউটার সিডিসির তত্ত্বাবধানে হাজারো রোবট। প্রথম নগরের বাসিন্দা ইরিনা সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্যবশত সুযোগ পেয়ে যায় নিষিদ্ধ নগরীতে যাবার। সেখানে গিয়ে অনুভব করে, কেমন আছে নিষিদ্ধ নগরীর মানুষেরা? অমরত্ব লাভ করেছে তারা, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তাও কি আপাতদৃষ্টিতে তারা প্রকৃতির কাছে অসহায়?

‘অনন্ত নক্ষত্র বিথী’ উপন্যাসে আবার অন্য ধরনের কাহিনী। বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন একজন মানুষকে মহাশূন্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু মহাশূন্যে সময় সংকোচনের কারণে মহাশূন্যে অতিবাহিত সময়ের চাইতে পৃথিবীতে বহুগুণ বেশি সময় অতিবাহিত হয়। এই ব্যাপারটিই মেনে নিতে পারে না লোকটি। সব মিলিয়ে জমুজমাট এক সায়েন্স ফিকশন।
‘অন্যভুবন’ উপন্যাসটি মিসির আলি সিরিজের অন্তর্ভুক্ত। তিন্নির রহস্যজনক আচরণের ব্যাখা পাবার আশায় তিন্নির বাবা বরকতউল্লাহ মিসির আলি সাহেবের শরণাপন্ন হন। মিসির আলি নিশ্চিত হন তিন্নির অতিমানবীয় ক্ষমতার ব্যাপারে। মিসির আলির অন্যান্য উপন্যাসের মত এটিও একটি সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার। পাশাপাশি সায়েন্স ফিকশন ঘরাণারও বলা যেতে পারে।

‘শূন্য’ এক গণিতের শিক্ষকের গল্প। মনসুর সাহেব একজন গণিতের শিক্ষক। মনসুর সাহেব গণিতের উপর নির্ভর করে ভিন্ন এক জগতের অস্তিত্ব অনুভব করেন। বৃষ্টির মধ্যে এক তরুণের সঙ্গে দেখা হয় মনসুর সাহেবের। সব মিলিয়ে অন্য এক জগতের সম্পর্কে আলোচনা। হুমায়ূন আহমেদ বইয়ের ফ্ল্যাপে বলেছেন,“আমাদের এই শরীরের ভেতর আছে আরেকটি শরীর, আমাদের এই জগতের ভেতরে আছে আরেকটি জগৎ। সেই জগৎ সম্পর্কে লিখলে কেমন হয়?”

‘কুহক’ উপন্যাসে দেখা যায়, ষাটোর্ধ্ব নিশানাথ বাবু সাইনাসের সমস্যার জন্য এক্সরে করাতে এক হাসপাতালে গেলেন। সেখানকার এক্সরে মেশিন ম্যালফাংশন হয়ে তার শরীরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভয়াবহ মাত্রার তেজস্ক্রিয় বিকিরণ। কিন্তু পুড়ে ভস্ম হয়ে যাবার বদলে নিশানাথ বাবু পেয়ে গেলেন আশ্চর্য কিছু ক্ষমতা। আমাদের আশেপাশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার সাথে মিল রেখে অসাধারণ একটি কাহিনী সাজিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। মনে দাগ কেটে দেওয়া দারুণ একটি উপন্যাস ।

হুমায়ূন আহমেদের এই সায়েন্স ফিকশন কিংবা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীগুলো পড়লে এক ধরনের আক্ষেপের জন্ম দেয়। হুমায়ূনের এই লেখাগুলো সঠিকভাবে অনুবাদ হলে তো সারাবিশ্বে হইচই পড়ে যেত। বাংলা ভাষার লেখাগুলো সঠিকভাবে অনুবাদ হয় না বলে আমরা নিজেদের রত্নগুলোকে যত্ন করতে পারি না।

Post a Comment

0 Comments