উপস্থাপনার সাতকাহন
পঞ্চম পর্ব
...."হাসিতে হাসিতে আলোকসাগরে"
হাঁড়ির খবর শোনার ইচ্ছা কমবেশি সবার থাকে। মুশকিল হল, সে খবর বাইরে বেরিয়ে গেলে হাঁড়ির হাল হতেই পারে। তাই গপ্পো নিয়ে আমি বেশ কৃপণ। তবে পান, ফান, স্যাটায়ার নিয়ে উপস্থাপনের ঘর-সংসার। তার ছাটে যে ইহলোক ভিজবেই তা বলাবাহুল্য।হাস্যরসের ব্যাকরণগত ধারাপাতে না গিয়েও রোজকার কেজো কারবার থেকে হাতে উঠে এসেছে কিছু অনাবিল মুহূর্ত, যা সারা জীবনের সম্পদ।
এমনও দিনে তারে বলা যায়,গোছের ইন্ট্রো দিয়ে খুব সিরিয়াস একটা প্রোগ্রাম শুরু করেছি। বিষয়, প্রেমে অপ্রেমে। প্রচুর কাগজপত্র ছড়ানো, কবিতার বই.... আমরা দুজন উপস্থাপক মুখোমুখি বসে। বিকেল পাঁচটা। ছোট্ট একটা পাঁচ মিনিটের খবর পড়তে হবে। পাঁচটা বাজতে তিরিশ সেকেন্ড বাকি। অন এয়ার তখন সিগনেচার টিউন যাচ্ছে। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আমরা নিউজটা পাচ্ছি না। অথচ ,দু 'মিনিট আগেও চোখ বুলিয়েছি।এইরকম অবস্থায় পড়লে উপস্থাপকরা নিজেদের হার্টবিট নিজেরা শুনতে পায়। আমরাও পাচ্ছি!ঘড়ির কাঁটায় বিকেল পাঁচটা বেজে 4 সেকেন্ড। আবিষ্কার করলাম নিউজ এর লতপেতে তিনটে কাগজ টেবিলের নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কো-প্রেজেন্টার কে বললাম,"নিউজ পড়ে গেছে"! সে বেচারা যারপরনাই নার্ভাস! বড় বড় চোখ আরো বড় বড় হয়ে গেছে! ডানদিক বাঁদিক তাকিয়ে অসহায় গলায়...."কে পড়ে গেল গো?"বুঝলাম বাংলা ভাষায় হবে না!"নিউজ ফল ডাউন "বলেই নিচু হয়ে কাগজ কুড়িয়ে, শুরু করলাম....."টোকিও সফর থেকে ফিরে আজ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন....."
10 সেকেন্ডের হুলুস্থুলু!! কেউ টেরটিও পেলেন না!!
উপস্থাপনার রান্নাঘরে এমন হুলুস্থুলু চলতেই থাকে। এ ঘটনাটি বেশ কিছুদিন আগের। স্মৃতি থেকে বলছি। বড়দের মুখে শোনা। ভারত পাকিস্তানের টেস্ট ম্যাচ শুরু হয়েছে দিল্লিতে। খেলার ওপেনিং অ্যানাউন্সমেন্ট দিয়ে প্রেজেন্টার গেছেন চা খেতে। ভাঁড় শেষ করে, চারমিনার এর ধোঁয়া সবে ছেড়েছেন। ডিউটি অফিসারের জরুরি তলব। একেবারে আক্ষরিক অর্থেই ছুটতে ছুটতে স্টুডিওতে ফেরত। প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হওয়ায় খেলা স্থগিত। দিল্লি কলকাতা কেন্দ্রে লাইন দিয়ে দিয়েছে। স্টুডিওর লাল আলো জ্বলছে। প্রচন্ড তাড়াহুড়োতে ফেডার তুলতেই মুখ দিয়ে যা বেরোলো...."আকাশবাণী কলকাতা, এখন প্রচন্ড খেলার জন্য বৃষ্টি বন্ধ।"
একবার একজন খুব ব্যস্ত গাইনোকোলজিস্টের ইন্টারভিউ নিয়েছি। ডাক্তারবাবুর পদবী চক্রবর্তী। ইন্টারভিউ নেওয়ার পর পাততাড়ি গুটিয়ে স্টুডিও থেকে বের হব, এমন সময় স্টুডিওর ফোন বাজছে। ফোন ইন প্রোগ্রাম ছিল। গোটা অনুষ্ঠান জুড়ে অজস্র মানুষ ফোন করেছেন। সেই ধারাতেই সময় শেষ হলেও কিছু ফোন আসেই। তাই কাঁধে ব্যাগ নিয়েও রিসিভার তুললাম। এরপর এপার-ওপার যে কথোপকথন সেদিন হয়েছিল---
---নমস্কার, দিদি। আমি চাপাডাঙ্গা থেকে বলছি।
-----নমস্কার, বলুন
-----আপনি এতক্ষণ যে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা কইলেন, আহা !আমরা ভরে গেলাম দিদি!
------ধন্যবাদ
------এত ভাল ডাক্তার! এতক্ষণ ধরে শুনছিলাম। খুব ভরসা পেলাম। রেডিওই তো পারে এমন সব সম্পদকে আমাদের কাছে এনে দিতে। আজ সকালের ডিডি বাংলায় ডা. বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী কে দেখেছি। বিকালে আপনি এনাকে নিয়ে এলেন। কি অপূর্ব যোগাযোগ ঠাকুরের! পিতা-পুত্র একসঙ্গে পেলাম! আমি চিকিৎসার জন্য যাবই।
-----ডা. বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী অকৃতদার
------তাতে কি! উনি তো টেস্টটিউব বেবি করেন! ওনার পুত্রেরই তো এতক্ষণ সাক্ষাৎকার নিলেন দিদি
-------একেবারেই না
-------কেন? এনার পদবী তো চক্রবর্তী! কি সুন্দর, কি ভালো যে লাগলো ঠিক সকালের মতো!
-------এই ডাক্তার বাবুর বাবা ডা. বৈদ্যনাথ চক্রবর্তীর নন
--------কি বলছেন দিদি! একই রকম সব কথা তো বললেন দুজনেই! এ ঠাকুরের যোগাযোগ। এ মিথ্যা হতে পারে না। সকালে আমার টিভি তে ভগবান দর্শন হয়েছে, বিকালে আপনারা ভগবানের কথা শোনালেন। এই তো বিধির বিধান... ঈশ্বরের নির্দেশ... এবার আমি....
লাইন কেটে দিতে হয়েছিল।
স্টুডিওতে প্রচন্ড ঠান্ডা। সেন্ট্রালী এসি ।বৈশাখের গরমেও ঠকঠক করে কাঁপতে হয়। শাল , হাত কাটা সোয়েটার পড়ি আমরা। তখন ওভারনাইট চলছে। দীর্ঘসময় স্টুডিওতে। টানা 7 ঘন্টা ডিউটির পর ছুটি। মনে আছে সময়টা এপ্রিল মাস। কলকাতা শহরের সকাল আটটায় তাপমাত্রা থাকে প্রায় 34 ডিগ্রি। আমি রেডিও অফিস থেকে বেরিয়ে বাসে উঠেছি। মনে তখনো অনুষ্ঠানের রেশ ,গুনগুন করছি গান। বাসে উঠে দেখি সবাই আমার দিকে চাইছে। এমনিতেই রাত্রি জাগরন। ক্লান্ত চেহারা। সামান্য অস্বস্তি নিয়ে সিটে বসলাম। বাসের চাকা ঘুরতেই কন্ডাকটর সামনে এসে হাত বাড়ালেন, দিদি কতদূর যাবেন? গলায় বেশ সহানুভুতি সূচক বাড়তি সর্তকতা! গন্তব্য জানিয়ে টিকিট কাটতেই হঠাৎ নজর পড়লো বাসের লুকিং গ্লাসে! নিজেকে দেখে নিজেই চমকেছি..... গায়ে আমার গজ কুমারের শাল। অর্থাৎ বাস সমেত মায় কন্ডাকটর দাদাও আমাকে অসুস্থ ভাবছেন! শারীরিক নাকি মানসিক, সেটা উনারাই বলবেন!
0 Comments