জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস - ৭


আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৭

শ্যা ম ল  জা না   

পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীরা এবং তাঁদের মতবাদ ও ছবি(৩য় অংশ)


পল গগ্যাঁ ও সিম্বলিজম্, সিন্থেটিজম্, ক্লোইসোনিজম্, প্রিমিটিভিজম ও পন্ত অ্যাঁভে স্কুল(প্রথম পর্ব)- 

ভ্যান গখ্-এর ছবি আঁকার মূল উপাদান যেমন ছিল মানসিক যন্ত্রণা থেকে জন্ম নেওয়া আবেগ-অনভূতি, তেমনি পল গগ্যাঁ-র ছিল সুদুরপ্রসারী কল্পনা ৷ পাঠক, এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে নেওয়ার প্রয়োজন আছে ৷ অনুভূতি ও কল্পনা দুটি এক জিনিস নয় ! অনুভূতি হচ্ছে Raw Meterial.৷ আর কল্পনা হচ্ছে অনুভূতির Finish Product.৷ ভ্যান গখ্ সরাসরি অনুভূতিকে ক্যানভাসে ধরেছিলেন ৷ কিন্তু, পল গগ্যাঁ কখনোই পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া অনুভবকে সরাসরি ক্যানভাসে আনেননি ৷ ফলে, অনুভব থেকে কল্পনা— এই পরিক্রমাটি তিনি সব সময় ছবি আঁকার ক্ষেত্রে বজায় রেখেছিলেন ৷ আর, এই কল্পনার সাহায্য নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নতুন কিছু করার অদম্য প্রয়াস তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিল ৷ এ জন্য, প্রত্যেক দিন যে নতুন করে পৃথিবী জন্মায়, তার ভেতরে তিনি নতুন নতুন শৈলীর জন্ম দিয়ে বহু ইজম্-এর শরিক হয়ে আছেন ৷ এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল সিম্বলিজম ৷

যখন প্রকৃতির কোনো একটি বিষয়, বা বস্তু, বা তার রং অন্য আর একটি ভিন্ন দর্শনের প্রতিনিধিত্ব করে তখন তাকে প্রতীক(Symbol)বলে ৷ ধরা যাক একটি আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলা হচ্ছে ৷ শেষ মুহূর্তে একজন খেলোয়াড় একটি গোল দিল৷ এতে সে বা তার দল যে জিতবে, সেই তাৎক্ষণিক উচ্ছ্বাসটি সে বোঝাতে চাইল ওই মাঠের এক লক্ষ দর্শককে ৷ সে যদি চেঁচিয়ে সবাইকে শোনাতে চায়, কখনোই পারবে না ৷ তখন সে Victry(জয়)-র আদ্যাক্ষর V-কে হাতের আঙুলের মধ্যমা ও তর্জনীর সাহায্যে দৃশ্যত “ভি” তৈরি করে, হাত তুলে দেখালো ৷ সমস্ত দর্শক তক্ষুণি বুঝে গেল সে কী বোঝাতে চাইছে ৷ এখানে আঙুল দিয়ে তৈরি “ভি” মুদ্রাটি হল জয়ের প্রতীক(Symbol)৷ যে কোনো কিছুকেই সরাসরি বর্ণনা করলে, গভীর অনুভূতি থেকে যে চরম সত্য উপলব্ধ হয়, তাকে পরিবেশন করা যায় না ! কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রতীক ব্যবহার করলে কাজটি খুব সহজ হয়ে যায় ৷ এটাই সিম্বলিস্টদের মূল বিশ্বাসের ভিত্তি ৷

সারা পৃথিবীর আধুনিক কবিতার জনক ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার ৷ ১৮৫৭ সালে তাঁর প্রথম বই Les Fleurs du mal. থেকেই সিম্বলিজম-এর সুত্রপাত হয় ৷ সিম্বলিজম-এর মূল কথাটি তিনি এইভাবে বললেন— “বাঙ্ময়তাকে হত্যা করো, আত্মার একটি অবস্থার নামই কবিতা(পেন্টিং বা অন্য সৃষ্টির ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য)”৷ অর্থাৎ যা দেখছি, তাকে সরাসরি বর্ণনা করতে হলে প্রচুর শব্দ খরচ করতে হয় ৷ এই অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহারকে বাঙ্ময়তা বলা হচ্ছে, যাকে হত্যা করতে হবে ৷ যা দেখছো, তাকে, শুধু দেখে বর্ণনা না করে আত্মীকরণ করো ৷ তারপর তাকে শিল্পরূপ দাও ৷ তবে, সিম্বলিজম-এর এই ভাবনায় বোদলেয়ার পাইওনীয়ার হলেও একে আন্দোলনের(১৮৬০-১৮৭০)পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব তাঁরই দুই ভাবশিষ্য স্তেফান ম্যালার্মে এবং পল ভার্লেন-এর ৷

এখান থেকেই অনুপ্রাণিত হন চিত্রশিল্পীরা ৷ এঁদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যাঁরা, পল গগ্যাঁ তাঁদের অন্যতম ৷ তিনি ক্যানভাসে এমন বিষয়হীন বিষয় বাছতেন, যেখানে প্রতীকের(Symbol)প্রয়োগই বেশি প্রাধান্য পেত ৷ আর, একে ফুটিয়ে তোলার জন্য তিনি প্রয়োগ করতেন মৌলিক রং, যা প্রকৃত অবস্থার চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল(ছবি-১)।

আর ক্যানভাসে তিনি যে মানুষ, প্রাণী বা বস্তুর ছবি আঁকতেন, সেগুলি হত অত্যন্ত সহজ-সরল(Simple)৷ এরও একটি নির্দিষ্ট কারণ আছে ৷ সহজ-সরল মানুষ, যাদের মনে সভ্যতার জটিলতা তেমনভাবে বাসা বাঁধেনি, তারা জটিল ও মিশ্র রঙের ধারণা মাথার ভেতরে তেমনভাবে তৈরি করতে পারে না ৷

পল গগ্যাঁর এই যে ছবিকে যতটা সম্ভব সহজ-সরল করার প্রবণতা, তা ইম্প্রেশনিস্ট ধারণা থেকেই তৈরি হয়েছিল৷ যে, প্রকৃতিকে যত হুবহু ক্যানভাসে ধরার চেষ্টা করব, ততই অনুভূতির গভীরতা কমে যাবে ৷ এ জন্যই ফোটোগ্রাফিক ডিটেল থেকে সরে এসেছিল ইম্প্রেশনিস্টরা ৷ পল গগ্যাঁ তাঁদের অন্যতম শরীক হলেও, তিনি ছবিকে আরও সহজ-সরল করতে চাইলেন ৷ তিনি চাইলেন— আলো-ছায়াজনিত কারণে কোনো বস্তুর যে আয়তন বা ভলিউম(Volume)তৈরি হয়, ছবি থেকে তাকেও প্রায় বাদ দিতে ৷ কারণ ওই একই— যে, কোনো কিছুকে সরাসরি বর্ণনা করলে, গভীর অনুভূতি থেকে যে চরম সত্য উপলব্ধ হয়, তাকে পরিবেশন করা যায় না ! একটি পেনসিল ছুলতে ছুলতে যেভাবে তীক্ষ্ণ হয়, সেভাবে পল গগ্যাঁ ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরিক্ষার মাধ্যমে এই দর্শনের সূক্ষ্মতায় পৌঁছোতে চাইছিলেন ৷

পল গগ্যাঁ-র জন্ম ১৮৪৮ সালে ৷ প্রায় ওই সময়ের কথা— ফ্রান্সের ব্রিটানি শহর থেকে একটু দূরে, অ্যাভেঁ নদী যেখানে আটলান্টিক সমুদ্রে গিয়ে পড়েছে, সেই জায়গাটি মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ ৷ অথচ ট্যুরিস্টরা তখনো তার সন্ধান পায়নি ৷ এখানে, ১৮৫০ সালে বেশ কয়েকজন চিত্রশিল্পী মিলে খুব কম বাজেটে একটি আর্টিস্ট কলোনী তৈরি করলেন ৷ নাম দিলেন— “পন্ত অ্যাভেঁ স্কুল”৷ চিত্রশিল্পী না হলে এখানে থাকতে পারবে না, আর কাজ বলতে শুধু ছবি আঁকা, অন্যকিছু নয় ৷ প্রায় তিরিশ বছর পর গগ্যাঁ এঁদের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন ৷ আর, এই “পন্ত অ্যাভেঁ স্কুল” থেকেই ১৮৮৬ সালে পল গগ্যাঁ সিন্থেটিজম(Synthetism)-এর সূত্রপাত করেন  এমিল বার্নার্ড ও লুই অ্যাঙ্কুয়েতিঁ-র সঙ্গে যৌথভাবে(ছবি-২) ৷

সিন্থেটিজম মানে আপনারা নিশ্চয়ই জানেন৷ একাধিক লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যর সম্মিলিত প্রয়াস ৷ এই সিন্থেটিজম-এর মূল তিনটি উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হল—

১. প্রকৃতির ডিটেল নয়, তার আপাত ও বাহ্যিক রূপটিকে শুধুমাত্র ব্যবহার করা ৷

২. ছবিতে সরাসরি বিষয় নয়, বিষয়ের ভেতরে যে গভীরতা, তাকে অনুভব করা ও  ক্যানভাসে আনা ৷

৩. শুধুমাত্র রং(Colour), রেখা(Line), ও গঠন(Form)-এর সাহায্যে(আলো-ছায়া দিয়ে তৈরি ভলিউমকে প্রায় এড়িয়ে গিয়ে শুধুমাত্র ফ্ল্যাট রঙের প্রলেপ দেওয়ার পর কালো আউটলাইন দেওয়া) ছবির বিশুদ্ধ সৌন্দর্যকে ধরার চেষ্টা করা ৷   (ক্রমশ) 




Post a Comment

7 Comments

  1. ছবি আর কবিতার তুলনা করলে আমার মনে হয় ছবিকেই আগে রাখা যায়। তবে এ তুলনা হাস্যকর।

    ReplyDelete
  2. অত্যন্ত মননশীল রচনা। ভালো লাগছে / পার্থপ্রতিম আচার্য

    ReplyDelete
  3. অনবদ্য বিশ্লেষণ। যা মনোমুগ্ধকর। কারণ এমন "সহজ করে সহজ কথা যায় না বলা"আবহমানের মিথ্যা সহজ ভাবে ব্যাখ্যা করে শ্যামল জানা কৃতিত্বের সাথে করতে পাাাছে বলেই এত মনোগ্রাহী হচ্ছে বলে আমার বিশ্বাস।
    তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  4. অনবদ্য বিশ্লেষণ। যা মনোমুগ্ধকর। কারণ "সহজ করে সহজ কথা যায় না বলা"এই আবহমানের প্রচলিত মিথ
    ভেঙে সহজ ভাবে কৃতিত্বের সাথে ব্যাখ্যা করতে পারছে
    বলেই এত মনোগ্রাহী হচ্ছে। তাকে ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  5. অনবদ্য বিশ্লেষণ। যা মনোমুগ্ধকর। কারণ এমন "সহজ করে সহজ কথা যায় না বলা"আবহমানের মিথ ভেঙে সহজ ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারছে শ্যামল জানা কৃতিত্বের সাথে।করতে পারছে বলেই এত মনোগ্রাহী হচ্ছে বলে আমার বিশ্বাস।
    তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  6. মিথ্যা--না।
    কথাটা হবে-- মিথ।
    মোবাইলের গোলযোগের জন্য হয়েছে। দুঃখিত। শুভেচ্ছা রইল।

    ReplyDelete
  7. প্রতিটি পর্ব অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়েছি এবং ঋদ্ধ হয়েছি এবং হচ্ছি। শিল্প নিয়ে এত মনোজ্ঞ এবং বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা আমার হৃদয় কেড়ে নিচ্ছে। শ্যামল জানা কে ধন্যবাদ।সেই সঙ্গে ধন্যবাদ জনাই জ্বলদর্চি সম্পাদক কে। এত মনোগ্রাহী একটা ওয়েবজিন উপহার দেওয়ার জন্য। আর্ভিং স্টোন পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম তা থেকেই উপ্ত থাকা অনুরাগ আজ ঝজড়িয়ে ধরছে প্রতিটি পর্বকে। ভাল থাকুন।


    প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়

    ReplyDelete