হাজার বছরের বাংলা গান ।। পর্ব-১২
তু ল সী দা স মা ই তি
বাংলায় উচ্চাঙ্গ সংগীত চর্চার ভূমিকা : ধ্রুপদ খেয়াল ঠুংরি ও অন্যান্য
"সংগীত সম্বন্ধেও তেমনি ছিল দুই ধারা। উচ্চ সংগীতের ব্যয়সাধ্য চর্চার ক্ষেত্র ছিল ধনশালীদের বৈঠকখানায়। সেই সংগীত সর্বদা কানে পৌঁছত চার দিকের লোকের, গানের সুরসেচনে বাতাস হত অভিষিক্ত। সংগীতে যার স্বাভাবিক অনুরাগ ও ক্ষমতা ছিল সে পেত প্রেরণা, তাতে তার শিক্ষার হত ভূমিকা। যে-সব ধনী দের ঘরে বৃত্তিভোগী গায়ক ছিল তাদের কাছে শিক্ষা পেত শুধু ঘরের লোক নয়, বাইরের লোকও। বস্তুত এইসকল জায়গা ছিল উচ্চ সংগীত শিক্ষার ছোটো ছোটো কলেজ।"
রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয় তখনকার দিনে রাজা জমিদারদের বাড়িতে যে উচ্চাঙ্গ সংগীতের চর্চা ও সাধনা হত তার প্রভাব আপামর বাঙালি
সঙ্গীত অনুরাগীদের মধ্যে পড়েছিল। এই আবহেই বঙ্গদেশে শাস্ত্রীয় সংগীতের তরঙ্গ আসে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকেই বাংলায় সংস্কৃতির বদল আসে। রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয়, সামাজিক সব ক্ষেত্রেই পরিবর্তন আসে। স্বাভাবিক ভাবেই বাংলার সাংগীতিক সংস্কৃতিও বদলে যায় অনেকখানি। ভারতচন্দ্র ও রামপ্রসাদের সময় বাংলা গানের যুগসন্ধিকাল। রাজা জমিদার দ্বারা উচ্চ সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রণও অনেকটা সেই সময় থেকেই। নগর ও শহরকেন্দ্রিক সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে তাকে গ্রামীণ ও পল্লীচর্চার প্রতি অবহেলার বিষয় করে তোলার চেষ্টাও সেই সময় থেকেই। বলা বাহুল্য এই সময়কাল থেকেই যেসব উচ্চাঙ্গ সংগীতের সৃষ্টি তার বিবর্তনেই পরবর্তী বাংলা গানের সূচনা। তবে তার আগেও যে উচ্চাঙ্গ সংগীত ছিল তাও আমাদের জানা। শুধু রূপের তফাৎ। যে অর্থে এখনকার ধ্রুপদ সংগীত তা হয়তো ছিল না, কিন্তু বাংলা গানের উদ্ভবের সময় থেকেই উচ্চ মানের প্রবন্ধ নিবন্ধ সংগীত ছিল স্বমহিমায়।
পঞ্চম শতক থেকেই বঙ্গদেশে আর্যসংস্কৃতি শাখাপ্রশাখা বিস্তার লাভ করে। তবে বঙ্গ জনপদের মানুষ এই আর্য্যিকরণ মেনে নেওয়ার ফলেই প্রবন্ধসংগীতেরও চল শুরু হয়। বাংলা, ত্রিপুরা সহ বাংলা ভাষাভাষী ভৌগোলিক অঞ্চলে সেই উচ্চাঙ্গ সংগীতের চর্চার সূত্রপাত। ভারতীয় সংগীত শাস্ত্র অনুযায়ী প্রবন্ধ সংগীত থেকেই ধ্রুপদ সংগীতের উদ্ভব। চর্যাপদকে বাংলাভাষার প্রাচীনতম গান বলে পন্ডিতরা গ্রহণ করেছেন। প্রত্যেকটি চর্যাগীতির সঙ্গে ভারতীয় রাগ রাগিনীর উল্লেখ থেকেই পন্ডিতগণ এই গানকে প্রবন্ধ গীতি বলেই মেনেছেন। সারঙ্গদেব 'সংগীত রত্নাকর' গ্রন্থে বিপ্রকীর্ণ প্রবন্ধ গনের আলোচনায় চর্যার উল্লেখ করেছেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাঙালি কবি জয়দেব তাঁর লেখা সংস্কৃত গ্রন্থ 'গীতগোবিন্দ"কে নিজেই প্রবন্ধ গীত বলেছেন। এই পথেই বৈষ্ণব সংগীতের বিবর্তন। ষোড়শ শতকে বৈষ্ণব সঙ্গীতজ্ঞ কৃষ্ণদাস তাঁর 'গীতপ্রকাশ' গ্রন্থে কীর্তনের কাঠামোতে প্রবন্ধ সংগীতের বিশেষ প্রভাবটিকে প্রকাশ করেন। নরহরি চক্রবর্তীর 'ভক্তি রত্নাকর' ও নরোত্তম দাসের 'প্রেম বিলাস' সংগীতের আকরগ্রন্থ। ধ্রুপদের আঙ্গিকে কীর্তন গানকে এক নতুন ধারায় প্রতিষ্ঠা করেন তাঁরা। গরাণহাটি কীর্তন যা খেতুরি মহোৎসবে গাওয়া হয়েছিল পরে শ্রীখণ্ড ও বঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে তার মধ্যেও ধ্রুপদের রূপ ছিল বলে মনে করা হয়। এই সব আলোচনায় উঠে আসে বঙ্গে ধ্রুপদ ঘুরপথে হলেও ছিলই। শুধু ভারতের অন্যত্র যে ধরণের ধ্রুপদ সংগীত রচনা ও গাওয়ার রীতির প্রচলন ছিল তা এখানে ছিল না। বিষ্ণুপুর রাজবাড়ির সংগীত চর্চায় অষ্টাদশ শতাব্দীতে যে বাইরের ধ্রুপদের অনুশীলন শুরু হয় তাকেই বঙ্গদেশে ধ্রুপদের পূর্ণাঙ্গ চর্চা বলে মনে করা হয়ে থাকে।
উনিশ শতকে বঙ্গদেশের সর্বত্র ধ্রুপদ সংগীত চর্চার অনেক আগেই বিষ্ণুপুরে এই গানের চর্চাকেন্দ্র গড়ে ওঠে। পরে পরে এই চর্চার কেন্দ্র ক্রমশ কৃষ্ণনগর, চুঁচুড়া,মুর্শিদাবাদ, প্রভৃতি বাংলার নানা স্থানে গড়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়াতে সংগীতমুখর ছিল বিষ্ণুপুর মল্লরাজার দরবার। সে আলোচনা অন্য পরিসরে করা যাবে। এই আলোচনায় বঙ্গের ধ্রুপদ চর্চার ভূমিকাটুকু তুলে ধরার জন্য এই প্রসঙ্গ। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোগল সাম্রাজ্য পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। ইতিমধ্যে ইংরেজরাও ভারত অধিকার করে। অবশিষ্ট মোগলেরা একে অপরের সাথে ক্ষমতা দখলের লড়াই শুরু করে। এই সময় দিল্লির দরবারে যে সমস্ত সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন তাঁরাও দেশীয় বিভিন্ন রাজদরবারে আশ্রয় লাভ করতে থাকেন। তানসেনের পুত্র বিলাস খাঁ এর বংশধর সঙ্গীতজ্ঞ বাহাদুর খাঁ দিল্লির দরবার থেকে বিষ্ণুপুরে আসেন। এবং মল্লরাজ দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ তাঁকে বিষ্ণুপুরে সংগীত শিক্ষার জন্য বেতন দিয়ে নিয়োগ করেন। সঙ্গে ছিলেন বিখ্যাত মৃদঙ্গ বাদক পীরবক্স। বাংলার সংগীতের ইতিহাসে এই ঘটনা যুগান্তকারী। তারপর থেকেই বিষ্ণুপুর ক্রমশ ধ্রুপদ চর্চার বড়ো কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। বাংলার একমাত্র সংগীত ঘরানা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। রাঢ়বঙ্গ সহ বাংলার সমস্ত রাজবাড়ি জমিদার বাড়িতে এই চর্চা ছড়িয়ে পড়ে। বহু সংগীত অনুরাগী নতুন গায়নরীতির ধ্রুপদ শিল্পী হয়ে গড়ে ওঠেন। বাহাদুর খাঁয়ের প্রথম ছাত্র ছিলেন বিষ্ণুপুরের রামশংকর ভট্টাচার্য ও গদাধর চক্রবর্তী। ধ্রুপদ গানের এই সমস্ত বিষয়ের বিশদ আলোচনা পরবর্তী পর্বে করবো।
বাংলাদেশে খেয়ালগানের চর্চার ইতিহাস খুব বড়ো হলেও বাংলাভাষায় খেয়ালচর্চার ক্ষেত্রটি খুব ছোটো। প্রকৃতপ্রস্তাবে ভারতের সর্বত্র খেয়াল গানের চর্চা ধ্রুপদ চর্চার সাথে সাথেই সূচনা হয়। অর্ধ ওস্তাদী টপ্পা গান তো ছিলই। টপ খেয়ালও ছিল। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি খেয়াল গানের চল তৈরি হয়। ভারতের অন্যত্র খেয়াল গান তখন ভীষণ ভাবে প্রচলিত। খেয়াল গানের প্রতিষ্ঠা নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে এই গানের সূচনায় মুসলিম প্রভাব বেশি বলে পন্ডিতগণ মনে করেন। কাওয়ালি ও রূপক এই দু প্রকার গানের মিশ্রনে খেয়াল গানের উদ্ভব। এই প্রকার সংগীত প্রথমে মধ্য ও দ্রুত লয়ে গাওয়া হতো। প্রায় দেড়শ বছর পরে জৌনপুরের সুলতান হোসেন শর্কি দেশীয় ছোটো গান 'চুটকল'কে ভিত্তি করে এবং প্রাচীন প্রবন্ধ গীতির গায়নরীতির প্রভাবে বিলম্বিত খেয়াল গড়ে তোলেন। আলাপ, তান বিস্তার বিভিন্ন সময়ে এই প্রকার গানের সাথে যুক্ত হয়। "খেয়াল গানের নানান অলংকার সন্নিবিষ্ট গায়নকৌশলকে মুসলিম গুণীরা 'ফিকরাবন্দ' বলতেন। এই ফিকরাবন্দ ই খেয়াল গানকে ধ্রুপদ গানের গায়ন ভঙ্গি থেকে পৃথক করেছে।" অনেকে মনে করেন খেয়াল গান প্রথম পর্যায়ে শাস্ত্রীয় সংগীতের মর্যাদা লাভ করেনি। সম্রাট শাজাহানের আমলে এই গান অভিজাত হয় ও শাস্ত্রীয় গানের সম্মান লাভ করে। পরে বিখ্যাত সংগীতশিল্পী সদারঙ্গ খেয়ালের ভাষা, বিষয়বস্তু ও গায়কী সহ বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে কলাবন্ত খেয়ালে রূপ দান করেন। মুক্ত প্রকৃতির খেয়াল গানে ধ্রুপদের মতো নিবিড় কাঠিন্য নেই। উনিশ শতক থেকেই বাংলা ভাষায় খেয়াল গান রচিত হতে থাকে। যদিও বাংলা ভাযায় খেয়ালের বন্দিশ পূর্ণাঙ্গরূপে গায়নে তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। তবে বাংলা গানে খেয়াল অঙ্গের গান তৈরি হয়েছে অনেক। ব্রহ্মসংগীত থেকে রবীন্দ্রগানে খেয়ালের রূপ প্রবেশ করেছে।
ঠুমরী বা ঠুংরি গান বঙ্গদেশে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। শাস্ত্রীয় সংগীতের উঠোনে এই গানের ধ্রুপদ খেয়ালের মতো আভিজাত্য নেই। এ প্রসঙ্গে জানা জরুরি ঠুমরী তাল ও আছে। অনেকটা স্বাধীনভাবে শিল্পীরা এই প্রকার সংগীত প্রকাশ করেন। পণ্ডিতগণ বলেন 'রঞ্জকত্ব ও নিত্য নতুনত্বই এই গানের বিশিষ্টতা।' আঞ্চলিকতার প্রভাবও এই গানে ভূমিকা গ্রহণ করে। তাই পাঞ্জাবি ঠুমরী, বেনারসী ঠুমরী,লখনৌ ঠুমরী ইত্যাদি। ঠুমরীর মধ্যে বারোয়া ঠুমরী জনপ্রিয় ছিল। দেশীয় ধুন কে কেন্দ্র করে এই প্রকার ঠুংরি গাওয়া হত। বারোয়া ঠুংরিতে একপ্রকার চপল কমনীয়তা ছিল বলেই দেশীয় বাঈজিরা এই প্রকার গান পছন্দ করতেন। বাংলায় ঠুমরীর প্রবর্তন করেন ওয়াজেদ আলী শাহ। লখনৌ থেকে নির্বাসিত নবাব কলকাতার মেটিয়া বুরুজে দরবারে ঠুংরি গানের চর্চা শুরু করেন। তিনিই সর্বপ্রথম খড়ি ঠুমরী কে গীতিনাট্য বা নৃত্যনাট্যে পরিণত করেন। পরে গোয়ালিয়রের গণপৎ রাও যে আধুনিক ঠুংরি গানের প্রবর্তন করেন বাংলায় তা জনপ্রিয় হয়। এই ধরণের গান অনুসরণ করেই রবীন্দ্রনাথ সহ অনেকেই ঠুংরী অঙ্গের গান রচনা করেন। লোকসংগীত চৈতি ও কাজরি ঠুংরী গানেরই রূপান্তর। ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী 'সংগীতসার' গ্রন্থে অবশ্য বলেছেন শোরী মিঞা ঠুংরি গানেরও সৃষ্টি করেছিলেন । কিন্তু অনেকেই এ কথা মানতে রাজি নন। গীতসূত্রসার গ্রন্থে আছে "এটা ঠিক যে শোরী যে অঞ্চলের লোক সেই লখনৌ অঞ্চলে ঠুংরি গানের আদর বেশি। কিন্তু শোরীকৃত টপ্পার থেকে ঠুমরী গানের রীতি অনেক পৃথক। তবে এটা হতে পারে যে শোরীর টপ্পা আরো সংক্ষেপ করে নেবার ফলে, তা থেকে ঠুংরি গানের উদ্ভব হয়েছে।"
(চলবে)
0 Comments