জ্বলদর্চি

দীর্ঘ কবিতা / তসলিমা নাসরিন

এক অপ্রেমিকের জন্য

 ত স লি মা  না স রি ন

এই শহরেই তুমি বাস করবে, কাজে অকাজে দৌড়ােবে এদিক ওদিক 
কোথাও আড্ডা দেবে অবসরে, মদ খাবে, তুমুল হৈ চৈ করবে, 
রাত ঘুমিয়ে যাবে, তুমি ঘুমোবে না। 
ফাঁক পেলে কোনও কোনও সন্ধেয় এ বাড়ি ও বাড়ি খেতে যাবে, 
খেলতে যাবে,

কে জানে হয়তাে খুলতেই যাবে আলগোছে কারও শাড়ি 
আমার আঙিনা পেরিয়েই কোনও বাড়িতেই হয়তাে।
এ পাড়াতেই হয়তাে দু'বেলা হাঁটাহাটি করবে, হাতের নাগালেই থাকবে
হয়ত কখনও জানিয়েও দেবে আমাকে যে, কাছেই আছো,
কুঁকড়ে যেতে থাকবাে, কুচি কুচি করে নিজেকে কাটতে থাকবাে 
দেখা না হওয়ার যন্ত্রণায়, তবু বলবো না, এসাে। বলবাে না, 
তােমাকে সুযােগ দেব না বলার যে তােমার সময় নেই, বা
    ভীষণ ব্যস্ত তুমি ইদানিং
তােমার অপ্রেম থেকে নিজেকে বাঁচাবাে আমি 
তােমার সঙ্গে আমার দেখা হবে না।

বছর পেরােবে, তােমার সঙ্গে দেখা হবে না আমার 
দেখা না হতে না হতে ভুলতে থাকবাে তােমার সঙ্গে দেখা
    হওয়াটা ঠিক কেমন ছিল 
কী রঙের শার্ট পরতে তুমি, হাসলে তােমাকে ঠিক কেমন দেখাতাে,
কথা বলার সময় নখ খুঁটতে, চোখের দিকে নাকি অন্য কোথাও তাকাতে, 
পা নাড়তে, ঘন ঘন চেয়ার ছেড়ে উঠতে, জল খেতে কিনা ভুলতে থাকবাে। 
দেখা না হতে না হতে ভুলতে থাকবাে তুমি ঠিক দেখতে কেমন ছিলে, 
তিলগুলাে মুখের ঠিক কোথায় কোথায় ছিল, অথবা আদৌ ছিল কিনা 
তােমার চুমু খাওয়াগুলাে ঠিক যেমন, জড়িয়ে পেঁচিয়ে চুলে বা বুকে মুখ গোঁজাগুলাে
ঠিক কেমন, ভুলতে থাকবাে।

অনেকগুলাে বছর পেরিয়ে যাবে, তােমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। 
এক শহরেই, অথচ দেখা হবে না।
পথ ভুলেও কেউ কারও পথের দিকে হাঁটবো না, 
আমাদের অসুখবিসুখ হবে, দেখা হবে না।
কোনও রাস্তার মােড়ে কিংবা পেট্রোল পাম্পে কিংবা মাছের 
দোকানে, বইমেলায়, রেস্তোরাঁয়, কোথাও দেখা হবে না।

আরও অনেকগুলাে বছর পর, ভেবে রেখেছি, যেদিন হুড়মুড় করে
একঝাঁক আলাে নিয়ে সন্ধে ঢুকতে থাকবে আমার নির্জন ঘরে, 
যেদিন বারান্দায় দাঁড়ালে আমার আঁচল উড়িয়ে নিতে থাকবে বুনাে বৈশাখী
এক আকাশ চাঁদের সঙ্গে কথা বলবাে যে রাতে সারারাত... 
তােমাকে মনে মনে বলবোই সেদিন, কী এমন হয় দেখা না হলে,
দেখা না হলে মনে হতাে বুঝি বেঁচে থাকা যায় না, 
কে বলেছে যায় না, দেখ, দিব্যি যায়!
তােমার সঙ্গে দেখা হয়নি কয়েক হাজার বছর। তাই বলে কি
আর বেঁচে ছিলাম না ?
দিব্যি ছিলাম! 
ভেবেছি বলবো,
তুমি তাে আসলে একটা কিছুই-না ধরনের কিছু
আমার আকাঙ্ক্ষা দিয়ে এঁকেছিলাম তােমাকে, 
আমার আকাঙ্ক্ষা দিয়ে তােমাকে প্রেমিক করেছিলাম,
আমার আকাঙ্ক্ষা দিয়ে তােমাকে অপ্রেমিকও করেছি
তোমাকে না দেখে লক্ষ বছরও বেঁচে থাকতে পারি! 
অপ্রেমিককে না ছুঁয়ে, অনন্তকাল।
এক ফোঁটা চোখের জল বর্ষার জলের মতাে ঝরে ধুয়ে নিতে পারে
এতকালের আঁকা সবগুলাে ছবি, তােমার নাম ধাম দ্রুত মুছে
দিতে পারে চোখের জল।
তােমাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে।

আমাকে একা বলে ভেবো না কখনো, তােমার অপ্রেম
    আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে।

Post a Comment

7 Comments

  1. এক কথায় দুর্দান্ত।

    ReplyDelete
  2. আহ! কী অদ্ভুত লেখা ৷ অনেকদিন পরেও মনে পড়বে / পড়ে ৷ - অমিতরূপ চক্রবর্তী

    ReplyDelete
  3. ভালো লাগলো / পার্থপ্রতিম আচার্য

    ReplyDelete