শ্রীঅরবিন্দ : স্বামী ও আসামী
পর্ব- এক
মু ক্তি দা শ
“Who breathes must suffer and who thinks must mourn,
And he alone is blessed, who never was born.”
১৯০৮ সালের ২রা মে তারিখটি ছিল সম্ভবত বিগত শতাব্দীর সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর পুলিশী তৎপরতার দিন। একেবারে ভোররাত থেকে ব্রিটিশ পুলিশের পাতা জালে একের পর এক ধরা পড়তে শুরু করেছে স্বদেশী আন্দোলনের প্রধান প্রধান কুশীলবরা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত নড়িয়ে দেওয়া নেতারা। ৩২ নং মুরারীপুকুর রোডের বাগানবাড়ি সহ কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্বদেশীদের গোপন আস্তানাগুলি পুলিশী তান্ডবে লন্ডভন্ড। ব্যাপক খানাতল্লাশীর সুবাদে চিঠিপত্র, পত্র-পত্রিকা, বোমা ও বোমা তৈরির সাজসরঞ্জাম এবং বহু রা্জদ্রোহকর কাগজপত্র – যেখানে যা কিছু ছিল, নির্বিচারে সেগুলি বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ। হেটো-কবির দল তাৎক্ষণিক ছড়া ছাপিয়ে ট্যাবলয়েড আকারে বিলি করছেন পথচলতি মানুষজনের কাছে – “মাণিকতলায় ধরা পড়ে বোমার কারখানা / ইংরেজ কাঁপে ভয়ে কাঁপে রাঙা বুকখানা।/ ইংরেজ দালাল যত মুখ বুজে থাকে / কথা নাহি বলে কেউ, দরজা বন্ধ রাখে।” ইত্যাদি।
এর দিনদুয়েক আগে, ৩০শে এপ্রিল, বৃহস্পতিবার, মজঃফরপুরে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীর নিক্ষিপ্ত বোমাটি লক্ষ্যচ্যুত না হলেও, অ্ভীষ্টচ্যুত তো হয়েছেই – উদ্দিষ্ট ব্যক্তি কিংসফোর্ডের বদলে নিহত হতে হয়েছে দুই নিরীহ বিদেশিনীকে। পরের দিন, ১লা মে, প্রফুল্ল চাকী মোকামা স্টেশনে পুলিশের হাতে ধরা পড়াকালীন বিশেষ পরিস্থিতিতে মৃত্যুবরণ করেন এবং ক্ষুদিরাম ধরা পড়েছেন ওয়াইনি স্টেশনে। দাবাগ্নির মতো সেই খবর ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। আর সেই সূত্র ধরেই খোদ কলকাতা জুড়ে চলেছে স্বদেশী-পীড়ন উৎসব।
একে একে গোপীনাথ দত্ত লেন থেকে গ্রেপ্তার হলেন কানাইলাল দত্ত ও নির্মল রায়। ১৩৪ নং হ্যারিসন রোড থেকে কবিরাজ ধরণীধর গুপ্ত, নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, অশোক নন্দী। ৩৮/৪ রাজা নবকৃষ্ণ স্ত্রিট থেকে হেমচন্দ্র দাস। ৩২ নং মুরারীপুকুর রোডের বাগানবাড়ি থেকে বারীন ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, ইন্দুভূষণ রায়, শিশির ঘোষ, পরেশ মৌলিক, বিজয় নাগ, পূর্ণচন্দ্র সেন, বিভূতিভূষণ সরকার, শচীন সেন, কুঞ্জলাল সাহা প্রমুখ। এবং ৪৮ নং গ্রে স্ট্রিটের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হলো স্বয়ং অরবিন্দকে। অরবিন্দ তখন স্ত্রী মৃণালিনী সহ দোতলায় ছোট্ট আগোছালো অপরিসর একটি ঘরের মেঝেতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। পাশের ঘরে সরোজিনী, অরবিন্দের বোন। রাত তখনও বোধহয় ঘন্টাদুয়েক বাকি। সদর দরজায় ঘা পড়লো। এবং সেইসংগে হুংকার : “দরজা খুলুন…শুনতে পাচ্ছেন? দরজা খুলুন…খুলুন বলছি…নাহলে কিন্তু ভেঙে ঢুকবো…”
প্রথমে ঘুম ভাঙলো সরোজিনীর। দোতলা থেকে আধো অন্ধকারে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে ‘ব্যাপারখানা কী’ বোঝার জন্যে যেই দরজা খুলেছে, অমনি – “ওমা গো, এ যে সেপাই…” বলার সংগে সংগে একটা ভয়ার্ত চিৎকার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে গিয়েও গলার কাছে কেমন ডেলা পাকিয়ে গেল।
দরজা খোলা পেয়ে ততক্ষণে পুলিশবাহিনী সরোজিনীকে প্রায় ঠেলে সরিয়ে সোজা একেবারে দোতলায়। ঘুমভেঙে ততক্ষণে বাইরে বেরিয়ে এসেছে মৃণালিনীও। সার্জেন্ট ব্যাঘ্র-হুংকারে জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় মিঃ ঘোষ?”
নিরুপায় মৃণালিনী কোনো কথা বললো না।চোখের ইশারায় শুধু ঘরের ভেতরটা দেখিয়ে দিল।
অরবিন্দ তখন সবে চোখ মেলছেন। ব্যাপারটা যেন ঠিক বুঝেও বুঝে উঠতে পারছেন না। পুলিশরা প্রায় টেনে তুললো তাঁকে। বিছানাপত্র, বাক্স-প্যাঁটরা সব তছনছ করে দিল। একটা ছোট্ট বাক্সে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে মৃণালিনীকে লেখা অরবিন্দের বেশ কিছু চিঠিপত্রও বাদ গেল না। শেষকালে বাক্সটি ভেঙে দুমড়ে সেইসব চিঠিগুলোও হস্তগত করলো পুলিশ-পুঙ্গবের দল।
অবশেষে গ্রেপ্তারী পরোয়ানায় সই করলেন অরবিন্দ। তাঁর কোমরে দড়ি পরানো হলো। পুতুলের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে দেখলো মৃণালিনী। অদূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে কালো-মোষের মতো পুলিশভ্যান। ধীরপায়ে অরবিন্দ সেইদিকে নির্বিকার হেঁটে গেলেন। পুলিশভ্যানে ওঠার ঠিক পূর্বমুহূর্তে একবার পেছন ফিরে দেখলেন শুধু। একি! মৃণালিনীর বেতসলতার মতো শরীরটা অমন টলছে কেন? পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সরোজিনীর ওপর শরীরের যাবতীয় ভার ছেড়ে অমন নেতিয়ে পড়ছে কেন মৃণালিনী? সে কি এবার জ্ঞান হারাবে?
(পরের পর্বে অরবিন্দ-মৃণালিনীর দাম্পত্য জীবন)
_______________________________
আগামীকাল ২ পর্ব প্রকাশিত হবে।
www.jaladarchi.com
0 Comments