জ্বলদর্চি

বিবমিষা /বনমালী মাল

ফোটোগ্রাফি- সৈয়দ স্নেহাংশু 


বিবমিষা 

ব ন মা লী  মা ল 


শুক্লপক্ষ গড়াতে গড়াতে আজ তৃতীয় দিন। এত পরিশ্রমে ক্লান্তি ক্ষয় তাকে পেয়ে বসছে যেন। কালো কাপড় ঢেকে চাঁদ ঘুম নিচ্ছে আলো আটকে। অন্ধকার চৌকাঠ আজও মেয়েলী ছোঁয়ার নেশায় দৃঢ়বদ্ধ বুনো লতার বিরোধীতায় সজাগ। কালের বিধান দূরে ঠেলে কি নির্বিকার বসে আছে কবি সেই সৃষ্টির মুহূর্ত থেকে! তার কাছে আলো আসে পুঁথি কিংবা পাণ্ডুলিপির বর্ণ সাজিয়ে। আঁধার আসে একপাল ভাবনার এলোমেলো অস্পষ্ট দুধপথ ঘিরে। আঁধার ঘনীভূত হলে সে খুঁজে নেয় অরুন্ধতী, মায় তার প্রতিবেশীদেরও। 

      চৌকাঠের অন্দরে কবির স্থিতি। চোখটুকু মেলে এরপর সব আলো নিভিয়ে বর্ণ হয় ছবি -- ছবি হয়ে ওঠে বর্ণ। সোনাব্যাঙ পথিকের চেনা ছন্দে তাল মিলিয়ে কেমন লাফায়, গরাদের আড়ালে চেনা চোখ কীভাবে ছন্দ ভেঙে গদ্য হয় -- শুধু লেগে থাকে মায়াখানি শিল্পের কুটিরে -- এইসব কথা জাতে ওঠে ঘূর্ণির মোহে যেন শুধু নির্বাক চেয়ে থাকার আলেয়ায়। 

       কত যুগ আগে দিব্যতা আর জাদুকাঠি হাতে কবি গিয়েছিল খসে পড়া সভ্যতার হাটে। দরদাম, কেনাবেচা শেষে বসে ছিল রুগ্ন রক্তিম স্তনের বৃদ্ধার কোলে, যার চার সন্তান পেছন ফিরে বিক্রি করছে নানা ফলের বীজ। শূন্য কোল দখল ক'রে নিল সে। শূন্যতা ঠেলে। জাদুকাঠি দিয়ে সে এঁকে এসেছিল সন্তানহীন শেষ হরিণীর আনন্দ যাপনের চিত্র। এরপর আরো কটা বছর রোগ ভয়ানক হ'লে সভ্যতা যখন শয্যায়, তারপর মৃত্যুতে। তখনও নাকি হাসি মুখে বৃদ্ধা। সভ্যতার গোটা গায়ে কাপড় ঢেকে মায়া-হাসির প্রলেপ দিয়ে দীর্ঘজীবি করে রেখেছিল।

       আজ তেইশে শ্রাবণ। অন্ধকার চৌকাঠের এপারে কোন্ দুঃস্থ ভাবনায় মনোযোগী হওয়ার চেষ্টায় কবি। বাইরের কালো কালো গাছের পাতা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির বিলাসী ছোঁয়ায় অবিরাম দুলছে। মাঝে মাঝে বাজের জেদী শাসন মিথ্যে করে তুলছে চরাচরের তান। স্তব্ধতার সঙ্গীতে ভাবনার রেওয়াজ যার মজ্জাগত, তার মুদ্রায় দুর্বল ছবি এখন বেশ স্পষ্ট। ক্ষণিক বিরতির পর চোখ বন্ধ করে কবি পা রাখল ভাবনার খেয়ায়। ধ্রুবতারা থেকে স্বপ্ন ঝরছে অবিরাম। স্পর্শ ক'রে তার গতিপথ রুগ্ন শিশুটার দিকে ফেরাতে গিয়ে মাঝপথে হোঁচট খেল সে। অজস্র শিশুর লাশ জমে আছে নির্বাক স্থাপত্য যেন। তার গলা রুদ্ধ হয়েছে অযুত রক্ত আর হাড়ের নির্মম পেষণে। এমন অন্ধকারে বমি বমি ভাব লুকোতে পারে না সে। হ্যাঁচকা টান দিয়ে বেরিয়ে আসে ধ্রুবতারা থেকে। 

       চৌকাঠের সামনে চোখ পড়ে কবির। দুর্বল আলোয় সে দেখে অসহায় দাঁড়াহীন কাঁকড়ার মত শুধু একদলা মাংস নিয়ে টেনে বেড়ানো অজস্র শরীর বুক দিয়ে বুকে গুঁতো দিচ্ছে। ছিঁড়ে আনছে মখমল আবরণ আনাড়ির হাতে কমজোরি একতারা যেন। তাদের অন্তহীন চিৎকার কবির মনে শিহরণ জাগায়। একটু অবসর পেলে সে বমি করতে পারে। এতদিনের সঞ্চিত জোরালো শব্দবন্ধ ছন্দ ভেঙে বুকে চেপে বসেছে। ভিড় করে আছে তারা উদ্গীরণের পথে। চোখ বুজে থিতু হয়ে বসে সে। শক্ত হাতে লাটাই ধরতে গিয়ে পিছলে যায় হাত। অবশেষে সুতো কাটে -- কল্পনার রেশ যেন ভেঙে পড়ে প'ড়ে থাকা পচা ফলের মিলিয়ে যাওয়ার শব্দে। 

       ওরা সবাই মানুষ। শুধু লড়ছে না, দেওয়া- নেওয়া করছে হিংসা আর ক্রূর দৃষ্টি। সন্তান পালন করছে সবাই পেছনে ফেলে আসা দাগ ধরে হাঁটিয়ে। আকাশ ওখানে ছোটো তাই তাকে ছোঁয়ার নেশায় মেতেছে ওরা। সদ্যোজাতের অবুঝ সন্ত্রস্ত কান্না উদগ্রীব করে রেখেছে শত শত পায়রাকে। কেবল নখের তীব্র ধারালো ঝলসানি তাদের দিগভ্রান্ত করছে বারে বারে। 

      ওদের অনর্গল ঘাম, চির অম্লান বীর্য, অবিরাম রক্তের ছিঁটে এসে পড়ছে কবির গালে-মুখে। অসহায় চোখ মেলে - মেপে ধরেনি সে ছবি হৃদয়ের চিলেকোঠায় - বিবেকের আঙিনায়। তবুও হৃদয় কাঁদে শেষ শিখার দুঃস্থ ইচ্ছের মত। চৌকাঠের এপারে দাঁড়িয়ে পড়ে কবি। পা বাড়ায় ওপারের লাল বন্ধুর পথে। অথচ। চৌকাঠের সীমানা ঘোচে না। ঊন পলকে চৌকাঠ হয়ে যায় বর্ষার দুরন্ত বাসনার খাল। বয়ে যায় শ'য়ে শ'য়ে অক্ষত মুখোশ। শিশুদেরও লাশ। নৈতিকতা আর সবশেষে দোমড়ানো ছন্দ। খোঁড়া পদ। ছিন্ন বিবর্ণ পাতা। পায়ে টান পড়ে এপার থেকে। 

      বেখেয়ালী অবশ হাতে পুঁথি সরিয়ে শাদা পাতা আসে সামনে। একটা দীর্ঘ বমি হল পাতা জুড়ে। ধারালো নখের মত খোঁচা খোঁচা ভাত। হিংসা জমাট বেঁধেছে চিটচিটে রুমালের দুর্গন্ধে। পাতার বাকি শাদা শূন্য অংশে নির্মল বাতাস, যা সহজে চোখ এড়ায়। যা সহজে ঘর হয়ে ওঠে গন্ধরাজের। এখানেই সেই খসে পড়া সভ্যতার বৃদ্ধা যষ্ঠি ফেলে হেঁটে বেড়ায় বাতাসের স্রোত ঠেলে।

Post a Comment

0 Comments