জ্বলদর্চি

হিমালয়ের পথে চলতে চলতে - ১০

 
হিমালয়ের পথে চলতে চলতে - ১০

 দে ব ব্র ত  ভ ট্টা চা র্য্য 

        
               
কেদারনাথ দর্শন

উত্তরাখণ্ডে দেবতাত্মা হিমালয়ের প্রতিটি কোনায় দেবতাদের বাস। সারা ভারতবর্ষ থেকে তীর্থযাত্রীরা হরিদ্বারে আসেন। সেখান থেকে যে যার মনস্কামনা অনুযায়ী তীর্থ দর্শনে বেরিয়ে পড়েন। কেউ যান চার ধাম দর্শনে। কারুর লক্ষ্য পঞ্চ কেদার। আবার কেউ পঞ্চ প্রয়াগে স্নান তর্পণ করে পূর্ব পুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা প্রণাম নিবেদন করেন। আমাদের লক্ষ্য যেমন চারধাম। সাধারন ভাবে চার ধাম ভ্রমণ শুরু হয় যমুনোত্রী থেকে। তারপর গঙ্গোত্রী, কেদারনাথ এবং বদ্রীনাথ দর্শন পরপর করতে হয়। আমরা তো ঠিক তীর্থযাত্রী নই। তীর্থ দর্শন আমাদের অবশ্য লক্ষ্য হলেও প্রকৃতিই হল আমাদের প্রথম প্রেম। প্রকৃতির মহা বিস্ময়ের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা ঈশ্বরকে অনুভব করতে চাই। 
         এখন আমরা কেদারনাথ তীর্থের পুণ্য ভূমিতে দাঁড়িয়ে। সারা অঙ্গে ঈশ্বরের স্পর্শ সুখ জড়িয়ে আছে। এবার তো আমাদের নীচে নেমে যেতে হবে। গৌরীকুণ্ডে রাত্রিবাস। কাল আবার যাত্রা শুরু হবে। লক্ষ্য বদ্রীবাশালের চরণ দর্শন। 
         দেবাদিদেবের অশেষ করুণায় আমরা সাধনবাবুর মত এক গুনী মানুষের দেখা পেয়েছি। অপার মমতার আধার মানুষটির কাছে এবার বিদায় নিতে হবে। এ কথা যখনই ভাবছিলাম ঠিক তখনই আমাদের পেছনে একটি ছেলে এসে দাঁড়ালো। ভবেশদা তাকাতেই সে বলল, 
  -সাব নীচে যায়েঙ্গে কেয়া? হামারা পাশ ঘোড়ে হ্যায়। 
  -দুটো ঘোড়া চাহিয়ে। 
  ভবেশদা কথা চালিয়ে যাচ্ছেন। 
  -হাঁ সাব, দো ঘোড়ে মিল যায়েগা। 
    ছেলেটি দেখতে যেন হীরুর দোসর। আমরা লড়াই চালিয়ে গেলাম। শেষে প্রতি ঘোড়া বারোশ টাকায় রফা হল। এতক্ষণ সাধনবাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললাম -
  -এবার তবে আমরা ফিরবো। বাবা কেদারনাথ আমাদের বাহুতে ধরা দিয়েছেন। হৃদয় পরিপূর্ণ। আপনার কাছে শিব মাহাত্ম্য শুনে আমরা কৃতার্থ। এবার অনুমতি দিন। 
     ছেলেটি পেছনেই দাঁড়িয়েছিল। সাধনবাবুর কাছে বিদায় নিয়ে ফিরে চললাম ওর পেছন পেছন। সময় দেখলাম দুটো চল্লিশ। হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। জুতো মোজা,মোটা উলের গেঞ্জি চাপিয়েও ঠান্ডা আটকানো যাচ্ছে না। 
     পেছন ফিরে আর একবার বাবার মন্দিরের চূড়া দর্শন করলাম। পেছনের পর্বত শ্রেণীর কোলে মন্দিরটি যেন হিমালয়ের ক্যানভাসে জীবন্ত ভাস্কর্য। স্থির হয়ে প্রণাম জানালাম। বিদায় চাইলাম এ অসীম বিস্ময় জাগানো প্রকৃতি মায়ের কাছে। মনে মনে বললাম, 
  -আসি তবে। এই অপার বিস্ময়ের কিছু স্মৃতি সাথে নিয়ে চললাম। এ আমার জীবন পাথেয়। 
          নীচে নামার জন্য আমাদের গতি এখন যথেষ্ট বেশী। মাঝে মাঝে দেখছি, মাথার উপর দিয়ে বিভিন্ন রঙের হেলিকপ্টার যাওয়া আসা করছে। ওদের তীব্র শব্দে শান্ত প্রকৃতি সচকিত হয়ে উঠছে। হয়তো বাবার ধ্যান ও বিঘ্নিত হচ্ছে। 
     নামার সময় ঘোড়ার প্রকৃত পরীক্ষা। ক্ষুর নড়বড়ে পাথরের উপর দিয়ে পিছলে যাচ্ছে। আমি পেছন থেকে স্পষ্ট দেখছি, ভবেশদার ঘোড়ার ক্ষুর পাথরের উপর দিয়ে পিছলে যাচ্ছে আর তার ঘর্ষণে স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হচ্ছে। একবার নয়, অনেক বার। ভীমবলি পর্যন্ত আমরা একনাগাড়ে নেমে এলাম। সময় বলছে, এখন চারটে তিরিশ। কিন্তু আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের চূড়ায় দিনমনি বাধা পেয়ে সন্ধ্যা কে দ্রুত আহ্বান করছে। মেঘেদের যাওয়া আসা এখন অনেকটা বেড়েছে। হয়তো এখনই বৃষ্টি শুরু হবে। ভীমবলি তে নদী পেরোলাম। আর নদীর এপার আসার সাথে সাথেই রিমঝিম বৃষ্টি নামলো। দুটো ঘোড়াকে জল খাওয়াতে নিয়ে গেল তাদের সহিস বন্ধু। আমরাও সামনের একটি বড় সেডওয়ালা দোকানে আশ্রয় নিলাম। বৃষ্টি এড়ানোর সঙ্গে চা -তৃষ্ণা নিবারণ ও আসু কর্তব্য। কুড়ি টাকা করে চা। তা হোক। মানব জাতির কাছে এ তো অমৃতের সমতুল্য পাণীয়। চেয়ার টেবিলে বসে চা সেবন, এ যেন কেউ বলছে, -
  -have a cup of tea please.
দেখছি, বাবার চরণ দর্শনে তৃপ্ত গৃহমুখী যাত্রীরা দ্রুত নেমে আসছে। কেউ ঘোড়ায় কেউ ডুলি-ডান্ডি তে। তবে পদযাত্রীদের সংখ্যাই বেশী। লাঠির ঠকঠক আওয়াজ তুলে পিঠে কাঁধে বোঁচকা নিয়ে একমনে হেঁটে চলেছে ওরা। আমাদের লাঠি তো এখন কেবল হাতের শোভা বর্ধক। বাবার কাছে এ যাত্রায় অপরাধী থেকে গেলাম। বয়স যদি দশটা বছর কম হত! যাকগে, বাবাকে স্পর্শ করেছি, তাঁর চরণ ছুঁয়েছি। এ তৃপ্তি তো কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। 
      ভবেশদার ডাকে হুঁশ এলো। ছেলে দুটি ঘোড়া নিয়ে তৈরী। সুতরাং পথে এবার নামো সাথী। গৌরীকুণ্ডের অনেকটা আগেই অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। পথের পাশে ছায়া জড়ানো বৈদ্যুতিক বাতিগুলো আবেশ মাখা শুভেচ্ছার পসরা নিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে যেন। যখন দীপক লজের নীচে এসে দাঁড়ালাম, মনে হল আজকের এই দিনটুকু জীবনের সঞ্চয় হয়ে থাক। কেউ জানবেনা এই গুপ্তধনের খোঁজ। 
         প্রতিটি অঙ্গ অবসাদে বিষন্ন। একটু বিশ্রাম। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ যেন দুর্লঙ্ঘ পর্বত শৃঙ্গ। ওপরে ওঠার আগেই নীচের দোকানে রুটী সবজির অর্ডার দিয়ে এসেছি। ব্যাগ রেখে সারাদিনের জামা জুতো খুলে একটু জল দিলাম হাতে পায়ে। কনকনে ঠান্ডা জল যেন শরীরটা জুড়িয়ে দিল। 
  -ভবেশদা, চলুন, নীচে থেকে আর এক কাপ চা এ চুমুক দিয়ে আসি। 
-  আমি বললাম ।আসলে আর একটা লুকোনো কারণ ছিল। কালকের অসমাপ্ত কাহিনীটা যদি একটু এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় !
    দু গেলাস ধুঁয়ো ওড়া চা নিয়ে বসলাম দুজনে। আজ দেখলাম দোকানীবাবু নিজের থেকেই কথা বললেন। 
  -বাবার দর্শন পেলেন? 
  ভবেশদা উত্তর দিলেন -
  -আপনার লাঠির জোর আছে। খুব কাজ দিয়েছে। বাবাকে স্পর্শ করেছি। তাঁর অশেষ করুণা লাভ করেছি আমরা। 
  -আমার তো ওতেই পুন্য। একবার ও বাবার দর্শন পেলাম না জীবনে। 
    দোকানীবাবুর অসমাপ্ত কাহিনী জানবো, আমি মনে মনে তৈরী। বললাম, 
  -এবার তবে" জয় কেদারনাথ" বলে বেরিয়ে পড়ুন ।
   দোকানী মশাই কোন কথা না বলে অন্য খদ্দেরদের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। 
-আপনার নামটাই এখনও শোনা হয়নি ।
  আবার বললাম আমি। 
  -সৃষ্টিধর মন্ডল। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কাকদ্বীপে বাড়ী ছিল। এখন খুব একটা মনে পড়ে না। 
   আমরা চুপচাপ বসে। সামনে খালি চায়ের গেলাস। সৃষ্টিধর বাবু বলেই চলছেন, -
  -আজ আমি একলাই জীবিত আছি। গত বাণের সময় আমার বাবা মা বউ আর সতের বছরের জোয়ান ছেলে হারিয়ে গেছে। বাবা কেদারনাথ আমাকে তাঁর চরণে ঠাঁই দেননি। সেদিন আমি গুপ্তকাশীতে ছিলাম। দোকানের জন্য মালপত্র আনতে গিয়েছিলাম। 
  সারা দোকান শব্দহীন। সৃষ্টিধরবাবু বাংলায় বলছেন,আমরা শুনছি। কিন্তু অন্যরা, যাঁরা বাংলা বোঝেন না তাঁরাও এ মৃত্যুর ছোঁয়া থেকে নিজেদের পৃথক করতে পারেন নি। সারাদিনের নিদারুণ ক্লান্তি অবসাদ সব ভুলে আমরা দুজন স্থির হয়ে বসে। সৃষ্টিধরবাবু হাত তুলে মন্দাকিনীর প্রবাহের দিকে দেখিয়ে বললেন ,
  -ঐখানে আমাদের দোকান আর পাশে একচালা একটা বাড়ী ছিল। 
      রাত্রির ঘন অন্ধকারে ঠিক  কোন্ স্থানটি সৃষ্টিধরবাবু নির্দেশ করছেন বোঝা গেল না। তবে সেই ধংস লীলার কথা স্মরণ করে আজ এই শান্ত রাত্রিও যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে। পাঁচ বছর আগের সে ভয়াল স্মৃতি এখানকার মানুষের মনে আজও সমান ভয়ঙ্কর! যেন এক মদমত্ত অসুর তার দুটি হাতে সমস্ত প্রকৃতিটাকে খেলাঘরের মত উপড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছে খেলার ছলেই। একই দিনে আমরা দুবার ঐ ভয়াবহ তান্ডবের কাহিনী শুনলাম। কেদারনাথের সেই নিঃসঙ্গ ছেলেটির যন্ত্রনা আর  গৌরীকুণ্ডে সৃষ্টিধরবাবুর দীর্ঘশ্বাস মিলেমিশে আমাদের বুকে জমা হয়ে রইলো। 
  সৃষ্টিধরবাবু নিজেকে সামলে নিয়েছেন। বললেন -
  -বাবুরা একটু বসে যান। একেবারে ডিনার করেই যাবেন। 
  -তাই হোক। তবে আর দু গেলাস চা দিয়ে দিন ভাই। 
    কাল ভোর থেকেই আবার পথে নামতে হবে। মনের মধ্যে যেন বদ্রীবিশালের ডাক অনুভব করছি। জয় বদ্রীবিশাল কি --।



Post a Comment

0 Comments