জ্বলদর্চি

সেমিকোলনের আত্মজীবনী - ৫


সেমিকোলনের আত্মজীবনী  

সা য় ন 


আড়াই হাত দিয়ে লেখা আমার ভাষাবুলেট

“OUR SWEETEST SONGS  ARE THOSE, THAT FELL OF SADDEST THOUGHT” শেলীর এই লাইনটা পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গে আমি হাত থেকে খাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। জানালার বাইরে তখন রাত ফেনার মত মনে হচ্ছে। 
-“একি! খাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলে? আমি তোমার চেয়ে বয়সে কতটা বড় জানো?”
-“তো কী হয়েছে! আপনি এই লাইনটা লিখে কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে মাউথ অর্গান বাজাবেন, আর সবটা চুপ করে আমরা মেনে নেব। এতো Romantic Silence আমার মধ্যে নেই। তার বিনিময়ে লাইনটা হওয়া উচিত এমন- “OUR SADDEST SONGS  ARE THOSE, THAT FELL OF SWEETEST THOUGHT”- কী ? হাঁ করে কী দেখছেন! আমার নাম ভারতবর্ষ, আমার গায়ে ধারাভির মল- মূত্র, আমার পিঠে শত শত হাইরাইজ, আমার পায়ের তলায় গলা চাপা দেওয়া, গলা কাটা মানুষ যারা প্রতিদিন কুড়ি টাকার জন্য রক্ত বেচে দিয়ে আসে, আমার হাঁটুতে মুখ ডুবিয়ে দেয় নম্বরকামী ছাত্র - ছাত্রী, আমার কোমর জড়িয়ে থাকে সেই মানুষ, যার কোমরে গোঁজা ছুরিতে লেগে আছে বন্ধুর পেট চেরা রক্তের দাগ, আমার নাভির অন্ধকারে লেগে আছে পদোন্নতির জন্য অমেরুদণ্ডী প্রাণীর কঙ্কাল, আমার বুকের বামপাশে করোনা, ডানপাশে কেন্দ্রীয় সরকার, কণ্ঠনালী দিয়ে যাতায়াত করে কর্মসংস্থানহীন যুবক ও মধ্যবয়স্ক, পরিযায়ী শ্রমিক, আমার হাঁ মুখ দিয়ে ঢুকে যায় ঘরে ঘরে ভায়োলেন্স, সন্ত্রাস আর আমি কামড়ে ধরি ঘড়ির এক একটা কাঁটা। রুটির জন্য যে নারী ফেলে দিল আঁচল, তার হাওয়ায় লাগা নিঃশ্বাস এখন শপিং মলের শীততাপ প্রেম আর সেলফির এক একটা স্ন্যাপ। আমার এক চোখে গৌরি লংকেশের মৃতদেহ, আর এক চোখে অভিজিৎ সেনের অন্ধকূপ যাপন। এই সবই আস্তে আস্তে জড়িয়ে ধরে ঢুকে পড়েছে করোটির গোলঘরে যেখানে নিউরোন আর শব্দেরা মেনে নিতে পারছে না একে অপরকে, যেখানে হিংসা আর হিমেনেস, সংকট আর শঙ্খ ঘোষের ডায়লেক্টিকসে একটা একটা দরজা ভেঙে পড়ছে। সেই দু’পাল্লার দরজার নাম বাংলা কবিতা। এর নাম ভারতবর্ষ, বুঝলেন কবিবর। তবে সুবোধ সরকার আমাকে ‘আড়াই হাত মানুষ’ বলে ডাকে। আমি ‘সূর্য সেন স্ট্রীটের ‘ভোজপুরী বালক’ যে ‘রুটি বানিয়ে, রুটি বানিয়ে/ শেয়ালদাগামী দুঃখী মানুষের জন্য তুমি যা করছ/ প্রেসিডেন্ট বুশ তোমার পায়েরও যোগ্য নয়, জেনো।’ (রুটি) 
আপনারা অনেকদিন ধরে বাকিংহাম থেকে বজবজ, স্ট্র্যাট ফোর্ডের জলবাতাসা দিয়ে শান্তিনিকেতন শাসন করে এলাম। এবার পালা আমার। এখন “কিন্তু তুমি আমার কেউ না, এই আমার হাত/ এই হাতদুটো আমি বিশ্বাস করি/ আমি বিগ্রহ বিশ্বাস করি না।” (বিগ্রহ) 
এই ‘আমি’ কে সুবোধ সরকার কোলে করে, খাতায় মুড়ে নিয়ে এলেন, যখন "ভারত ভবনে গিয়ে দেখলাম মারাঠি, তামিল, অসমীয়া বিভিন্ন ভাষার কবিদের সমাবেশ। মনে হল, আমার সামনে যেন একটা বিস্ময়কর ভারতবর্ষ দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার যে একটা দেশ আছে, এটা যেন আমার মাথাতেই ছিল না। এদের কবিতা শুনতে শুনতে মনে হল, আমার একটা দেশ আছে, যেখানে এতগুলো ভাষার অস্তিত্ব। আশ্চর্য হয়ে গেলাম যে, এইসব ভাষাতেও আমাদের মতো কবিতা লেখা হয়।” (আমার কবিতা, আমার জীবন, পৃঃ- ১৮০-৮১)। আমরা সারা জীবন সিলেবাস দিয়ে এলাম, কিন্তু আমরা সনেটটা শিখতে পারলাম না। আমরা প্রেম করতে ভুলে গেলাম, কিন্তু একটা প্রেমিকের N-95 মাস্ক পরে নিলাম। গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলাম- “কে বেশি সুন্দর, সে না আমি?/ কে বেশি নিষ্ঠুর, সে না আমি?” (বউয়ের প্রেমিক) 

“তুমি কী সত্যিই দু হাজার বছর নেবে পৃথিবীতে পৌঁছতে?
তার পর কবে তুমি ভারত মহাসাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে ডাকবে আমাকে
ডাকলেই তো হল না, আমাকে তো শুনতে হয়?
আমি শুনতে পাব, আলো, তোমার ডাক, এই একজীবনে?” (আলো)

সরাসরি একটা জীবনকে ডেকে সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলা একজন কবির আসল হিম্মত। কবিতার মধ্যে দিয়ে তার সচল সংলাপ তার আধুনিকতা। আমরা থিয়োরির মধ্যে দিয়ে অ্যাখ্যান রচনা করি, আর পাশে পড়ে থাকে জীবনের গায়ে ফুটে যাওয়া কাঁটার চাবুক। একটা পারটিকুলারকে বড় নিবিড় ভাবে কবি দেখেছেন- যেভাবে সমুদ্র দেখে শিশু। সুবোধ সরকার বললেন,- কবিতার ব্যাখ্যা করে কবিতার হাত-পা ধরে টানাটানি করা আমাদের একটা রোগ। “দুঃখকে ছুঁতে পারা যেমন আধুনিকতা, দুঃখকে বালিশের নীচে চাপা দিয়ে রাখা আরও বড় আধুনিকতা।” (ভূমিকার বিরুদ্ধে ভূমিকা- কবিতাসংগ্রহ ১, সুবোধ সরকার)।

আমি জীবনের পাশে দাঁড়িয়ে কোমরজলের ইতিহাস লিখব। ভাইরাসের মরণগাথা দিয়ে ছেঁকে তুলে নেব পরবর্তী পৃথিবীর গণ সংসিতের ইস্তেহার। 
“শত্রু বন্ধু
নিন্দা অপমান
সবাইকে ডেকে আন
আমরা একসঙ্গে বসে খাব 
আমরা বহুদিন একসঙ্গে বসে খাইনি  
দাদা, এই দাদা, আমার থালা থেকে তোকে একটু ভাত তুলে 
দিই?”
(সরস্বতীর হাত)
একটা খবর রাতের দরজা ভেদ করে সামনে এসে দাঁড়ায়। ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৫ সাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্বে জার্মানির স্টুটথর্প কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে রক্ষী হিসেবে কাজ করা ৯৩ বছর বয়সী  ব্রুনো ডে- কে ওই ক্যাম্পে ৫২৩২ জনের মৃত্যুর ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে হামবুর্গের একটি আদালত ২ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করল। তাহলে সময় ঘুরতে ঘুরতে বারবার একই জায়গায় এনে দাঁড় করায়। নাকি সময় এমন একটা প্রশ্নপত্র যার উত্তর দিতে আমাকে হামবুর্গ থেকে হাওড়া ছুটে আসতেই হয়। উপকূলে বসে আছি, অনেক শব্দেরা শব, সন্তান, প্রেম, আদর, দেশ নিয়ে ভেসে যায় চোখের সামনে। আবর্তনে তার ফিরে আসা “আমাকে অসম্ভব ভয় দেখায়/ আমাকে সেই বীভৎস এক 
  পা- ওয়ালা নাবিকের কথা মনে করিয়ে
  দেয়/ ভাবতে বলে তার ধৈর্য্য, তার অপরাধ।”
(পা)

নাবিকের একটা পা খুঁজতে খুঁজতে একটা বই হয়ে যায় কখন অজান্তেই, তখন ‘দু’চোখে তার শুকিয়ে গেছে জল’ সময় পেরিয়ে “এখন তার বৃহত্তর দুঃখে চলাচল।” পাথক আপনিই তো দেশ, তোমার হাতে থালা আর তোমার হাতে ছুরি। ভেবে দেখবেন বর্ডার আর রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন আপনি অনেক বছর। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভুলে যান- “৩৬৪ দিন আমরা খুব ছোট হয়ে বেঁচে থাকি/ একে ধাক্কা দিয়ে ওকে চিমটি কেটে তাকে থাপ্পড় মেরে/ কুৎসা রটিয়ে, ভয় দেখে এবং ভয় দেখিয়ে/ আমরা মাত্র আড়াই হাত হয়ে বেঁচে থাকি ৩৬৪ দিন।” (আড়াই হাত মানুষ)

Post a Comment

0 Comments