জ্বলদর্চি

সেমিকোলনের আত্মজীবনী -৭


সেমিকোলনের আত্মজীবনী- ৭ 


সা য় ন

'ছিঃ' আপনি বাংলায় কবিতা লেখেন?

আমি জানি না ঠিক কোথা থেকে একটি কবিতা টেক অফ করে আর কোথায় এর ল্যান্ডিং গ্রাউন্ড। এর থিয়োরি কি? কোনো থিওরির গেটকিপার হয়ে কবি হওয়া যায় না। ভাবছিলাম.. আবার দুদিন লকডাউন। ভাবছিলাম না .. অপেক্ষা করছিলাম। 

'অপেক্ষা' শব্দটা মাথায় আসতেই 'ভাষানগর'  সংখ্যা  ২০১২-১৩ সংখ্যায়, অদ্রীশ বিশ্বাসের কণ্ঠস্বর কানে এল। একটা - " কারো অপেক্ষা শেষ হয়, কারো শেষ হয় না। কফি শেষ হয়, অপেক্ষা শেষ হয় না। সিসিটিভি দেখছে কার কার অপেক্ষা শেষ হল, কার কার হল না। নথি রাখছে অপেক্ষার। বেশি অপেক্ষা করলে সিকিউরিটি এসে জিজ্ঞাসা করছে। অপেক্ষার ধর্ম-জাতি-গোত্র-পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে নোটবুকে। পাসপোর্ট চেক করছে। অপেক্ষা বড়ো সন্দেহের, অপেক্ষা বড়ো ভয়ের, অপেক্ষা বড়ো আশঙ্কার। " (অপেক্ষা মানে ওয়েটিং ফর নয়) 
আমার অপেক্ষা একটি জীবনের কাছে - যে জীবন দুটো নদী, দুটো দেশের বর্ডারের মাঝে খুঁজতে থাকা পাসপোর্ট। একটা জীবনের নাম পরিবার, একটা জীবন হল সেমিকোলন। এই দুটো জীবনের মাঝে একটা মাদুর পেতে বসে অপেক্ষা করছিলাম, একটা ফোন এল -
"আপনাকে আর ক্লাস করাতে হবেনা এখন থেকে। সামনে পরীক্ষাও নেই, কি হবে আর এই সময় পড়াশোনা করে। " 
আমি হাসতে হাসতে বললাম "আমি আপনাদের ফোনটার অপেক্ষাই করছিলাম। এই ফোনকলটার নাম দিলাম বর্তমান বাংলার সংস্কৃতি , বাংলার শিক্ষা কিংবা কবিতা ও রাজনীতি বলতে পারেন। "
- কি বললেন? 
- "কি" না বললাম "ছিঃ"! 
ছিঃ - ১

আমার ঘরের ভিতর দিয়ে হুরহুর করে জল ঢুকতে শুরু করল, ভেসে যেতে লাগল সব  বইপত্র । একটা, দুটো, তিনটে - আমি ভেসে যাওয়া জলের থেকে তুলে নিলাম একটা বই- "ছিঃ"। এই বেনোজল থেকে বইগুলো বাঁচাতে হবে, বাঁচাতে হবে অনেক কবি, সম্পাদক, ঔপন্যাসিক, গদ্যকার যারা ভেসে যাচ্ছে ওই জলে। এই জলটা ইংরেজি ভাষা হয়ে বিশ্বসাহিত্যের ঘরে ঢুকে পড়ছে - এ যেকোনো মুহূর্তে ভাসিয়ে দিতে পারে বোরো ভাষার একজন কবিকে, কিংবা আফ্রিকার কোনো লৌকিক প্রেম-পদাবলী। এই জলটা ব্যবধান বাড়িয়ে দিতে পারে বাংলা অকাদেমী বনাম কবিতা অকাদেমী। জলটা আরও ছড়িয়ে রবীন্দ্রসদন চত্বর এগিয়ে যাচ্ছে, আর এক ঘাটে দেখছি সাফাই কর্মী ও সাহিত্য কর্মী কিভাবে পান করছে বেনো জল। সে কি দৃশ্য রে বাবা! আমার মনে হয় " কিন্তু কবিরা ,  বিশেষ করে আধুনিক কবিরা একটু বেশি আশাবাদী তাদের ধারণা আগামী ৫০ বছরের মধ্যে চাঁদের মাটিতে ছোট ছোট স্কুল খোলা হবে, সেখানে তাদের কবিতা সিলেবাসে রাখা হবে চাঁদে কবি সম্মেলন হলে সেখানে তারা আমন্ত্রিত হয়ে কবিতা পড়তে যাবে  চাঁদে যারা কবিতা পড়তে যাবে তাদেরকে গালাগাল দেবে চাঁদ-বিরোধী লিটল ম্যাগাজিন " (চাঁদ)

ছিঃ ২

 এই কবিতার বইটা দিয়ে আমি ঘরে, সমাজের, দেশের থেকে নোংরা জল বার করব? যে কবিতার বইয়ের নাম "ছিঃ"! 
কি আর করা যায়, ১৭ বছর আগের একটি ইতিহাস কান ফিসফিস করে - " 'দেশ' পত্রিকায় প্রকাশিত ৫০ বছরের ১০টি শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থের তালিকায় সর্বকনিষ্ঠ বই হিসেবে উঠে আসে। প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে বিতর্ক শুরু হয় ।"
আসলে বাংলা কবিতা শুধু নয়, আপামর বিশ্বকবিতায় আমরা ডিগ্রিধারী শহুরে ভদ্রলোকেরা এমন একটা সাংস্কৃতিক ব্ল্যাকহোল তৈরি করেছি, যার বাইরে একটা তুকারাম কিংবা ওসিপ ম্যান্ডেলস্টাইন মৃত্যুর পাতা খুলে কবিতা লেখে, দেখা যায় না। এই তুকারামকে দেখি কলেজে বসে কবিতা লিখছে - বাংলার অধ্যাপিকা এসে বললেন -"তুমি কি সারাজীবন কবিতা লিখবে, তাও আবার বাংলায়! হুঁ, নেট দাও বুঝলে" তরুণ তুকারাম বললেন, নেট দিলে আমি জানতে পারব না - " যারা এক পেগ খেয়ে ডিনার পার্টিতে মেয়েদের কাঁধে হাত রাখে 
তারা একটা সন্ধ্যার জন্য অতিমানব হয়ে ওঠে। 
এই অতিমানবেরা দু'পেগ খেলে এরপর কোথায় হাত রাখবে আমরা জানি না। " (ছিঃ) 
কলেজ কিংবা কালিম্পং এ কোথাও অধ্যাপিকারা কবিতার বই পড়তে দেননা, কারণ তারা জেনে গেছেন " আমার মতো ছেলেটিও জানে প্রকাশ্যে বাইশটি/ কিন্তু আড়ালে, সভ্য সমাজে, আরও বাইশটি পদ্ধতি আছে/ মেয়েটিকে চুম্বন করার। " (বাইশটি পদ্ধতি) 

ছিঃ ৩

জল ভেজা একটা পাতা ভেসে যাচ্ছিল, সাবধানে হাতে তুলে নিয়ে আস্তে আস্তে পাঠ করছি - " এমন সমাজে ,  যেখানে ধরো পুরুষও মায়ের ভূমিকা নিতে পারে - তর্কটা মূল্যবোধের উপর স্থাপন করে আরও পরিষ্কার করি- যেখানে একটু উদ্ভট ভাষাই ব্যবহার করতে হচ্ছে , যেখানে নারীর 'স্বজ্ঞা' (intuition) পুরুষের 'জ্ঞান' (knowledge) এর মতো গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে কঠিন আর পোক্ত হওয়ার চেয়ে ভদ্র আর কোমল হওয়াটা ভালো, অন্য কথায় এমন এক সমাজ যেখানে প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা প্রত্যেকের সমতুল, সেখানে আপনা থেকেই সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় তার মানে অর্থনৈতিক সমতা। রাজনৈতিক সমতা এবং আরও কিছু। "
কবি বললেন- ওফ মাথা ধরে গেল। সিমোন দ্য বোভয়া ' মেয়েদের হার মেয়েদের জিত' । কিন্তু আমরা তো এমন একটা দেশে বাস করি যেখানে পরিযায়ী নারী শ্রমিক হাইওয়ে ট্রাক ড্রাইভারের সাথে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করে একটা রুটির পয়সা জোগাড় করতে হয় তার সন্তানের জন্য। তাদের কাছে সিমোন আসলে একটা ঝলসানো রুটি মাত্র। তার চেয়ে বরং যদি ওই ভাষার মিসাইলকে জীবনের চেনা নাম ও নিঃশ্বাসের ভাষায় বলি কেমন হবে - 
 " দু'হাজার বছর ছিল আমাদের
আগামী দু'হাজার তবে তোমাদের হোক 

হাতে একটাই রুটি 
অর্ধেক তোমার
অর্ধেক আমার
দ্বিতীয় রুটি না আসা পর্যন্ত এটাই নিয়ম। "(ফেমিনিস্টদের জন্য) 

ছিঃ ৪

ভারতবর্ষ এত কঠিন ভাষায় কথা বলে না। তারা হৃদয়ের ভাষা বোঝে। হাজার বছরের আবর্জনা যখন আমাদের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হয়, আমরা গঙ্গার মতো বুক পেতে তাকে গ্রহণ করি। এই আবর্জনাময়  গঙ্গাজলকে নিও-রিয়াল মানবগণ পোস্ট কলোনিয়াল লিটারেচার বলে। বিশুদ্ধ গঙ্গার হাওয়া ছেড়ে আমরা তবে 'এ কোন জগতে এসে পড়লাম, একটু ভালো ভাষায় কথা বলে না কেউ /১৯ বছরের ছেলেমেয়েরা কি একটা শব্দ শিখেছে, মাদারফাকার/ সেটাই যেখানে সেখানে বলছে, একজনকে যিশুর রক্তঝরা/ পায়ের নিচে দাঁড়িয়েও বলতে শুনলাম। " (মাদারফাকার)

ছিঃ ৫

রবীন্দ্রনাথকে আমরা বহিরাগত করে দিয়েছি শান্তিনিকেতনে, তার উন্মুক্ত মাঠের পাশে এখন পাঁচিল । একাদেমি চত্বরে কবিতা পাঠের নামে তোলাবাজী হয় , তরুণ কবির ঘরে থ্রেট কল আসে - যেন স্ট্যালিন রচিত মৃত্যুর মহাকাব্য পার্জ, - এই সবই জলে ভেসে যায় আমার ঘরের ভিতর থেকে। সাহিত্য কোনো স্বর্গ নয়, কবিতা আসলে বাংলার ঘরে ঘরে সেই সাধারণ মানুষগুলো, কিংবা রাষ্ট্রের দাঁত নখের বিরুদ্ধে লুক্কায়িত গেরিলা, আবার সারাদিন ভ্যানে ঘোরা সবজিওয়ালা বা মা বাবা স্ত্রী সন্তান নিয়ে চাকরি চলে যাওয়া ছেলেটা - এদের সবাইকে আমরা যিশু বানিয়েছি, বুদ্ধ, রাম বা কৃষ্ণের মতো সাজিয়ে দিয়েছি বৃন্দাবন। তবুও সত্যিটা হল - 
 "... সে বেচারা /আমাদেরই মতো পাঁচ-ছ'টা ভাইবোনের জোয়ান ঘাড়ে নিয়ে / সংসার চালিয়েছে, আর অন্যদিকে বড় বড় পন্ডিত পুরোহিতরা / লোকটাকে মারার জন্য ষড়যন্ত্র করত /এইসব পুরোহিতরা এখন আর বেঁচে নেই ভুলেও ভাববেন না/ এদের কেউ হয়েছে আমলা কেউ রাজনীতিবিদ কেউ ভাইস চান্সেলর/ যারা ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট লিখে দেয়। " (উপদেশ যা কিনা গির্জার দেওয়ালে লেখা থাকে না)
আপনি তো আবার লাইভে বসবেন,তাই না? বেশ ... তবে ভেবে দেখবেন, আমরা কবিতা পড়ে গেলাম দিন আর রাত, কিন্তু এই বেনো জলে ডুবে যাওয়া অবস্থায় একবারও বলতে পেরেছি - ছিঃ !

Post a Comment

0 Comments