জ্বলদর্চি

অভিমানী ঈশরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

অভিমানী ঈশ্বরকে 
দ্বিশত জন্ম  বর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য 

অ মি ত  কু মা র   সা হু 

 নবজাগরণের অন্যতম পথপ্রদর্শক, অজেয় পৌরুষ , অক্ষয়  মনুষ্যত্বের  মূর্তিমান প্রতীক , করুনার সিন্ধু  মেদিনীপুরের ঈশ্বর বাংলা তথা ভারতবাসীর কাছে দ্বিশত বর্ষ পরেও ঘরে ঘরে সমাদৃত l
 শৈশবের কষ্টসহিষ্ণু জীবন,আপসহীন আত্মমর্যাদা ও  মানবতার লড়াই কিংবা ধর্মীয় - কপমুণ্ডুকতার বিরুদ্ধে  সজোরে  কুঠারাঘাত ও   রক্ষণশীল কুলিনদের "পরাশর সংহিতার " নীতিশিক্ষার পাঠ দ্বারা অশ্রুসিক্তা পতিহারাদের  সৃষ্টি সুখের পুনর্বাসন  দিয়েও নিজ গ্রামে থাকা অবস্থায় কথা দিয়েও  যখন অনৈতিক বিবাহ রোধ করতে পারলেন না তখন অভিমানী ঈশ্বর চিরতরে বীরসিংহ ত্যাগ করলেন l আমৃত্যু আর বীরসিংহে  কোনোদিন যাননি l ঘটনাটা হলো ১৮৬৯ সালের জুন - জুলাই মাসে l
উনপঞ্চাশঊর্ধ্ব মাতৃভক্ত  ঈশ্বর মাতা ভগবতীদেবীকে লিখলেন  " নানান কারণে আমার মনে সম্পূর্ণ বৈরাগ্য জন্মিয়াছে , আর ক্ষণকালের জন্যেও  সাংসারিক কোনো বিষয়ে লিপ্ত থাকিতে বা কাহারও সহিত কোনো সংশ্রব রাখিতে ইচ্ছা নাই - এজন্যে স্থির করিয়াছি যতদূরপারি নিশ্চিন্ত হইয়া জীবনের অবশিষ্টভাগ নিভৃত ভাবে অতিবাহিত  করিব  l "
কাশীবাসী পিতা ঠাকুরদাসকে  লিখলেন " সাংসারিক বিষয়ে আমার মতো হতভাগ্য আর দেখিতে পাওয়া যাইবেনা l সকলকে সন্তুষ্ট করার নিমিত্ত প্রানপনে যত্ন করিয়াছি , কিন্তু অবশেষে বুঝিতে পারিয়াছি , সে বিষয়ে কোনো অংশে কৃতকার্য হইতে পারিনাই l জীবনের অবশিষ্ট ভাগ নিভৃতে অতিবাহিত করিব l " 
কর্মজীবনের আয় , স্বরচিত গ্রন্থের বিক্রিত অর্থ অকৃপণ হাতে বিলিয়ে কিংবা ঋণ করে হাসি ফুটিয়েছেন অসংখ্য আত্মীয় ও স্মরণাপন্নর ম্লানমুখে l
  তথাপি তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের ও নিকট হিতাকাঙ্ক্ষী বন্ধু - বান্ধব  ও আত্মীয়- স্বজনদের পুনঃ পুনঃআঘাতে স্ব - ইচ্ছায় শিক্ষিত সমাজকে ছেড়ে অশিক্ষিত শীর্ণ বুভুক্ষুদের বাসস্থান  সাঁওতাল পরগনার ( বর্তমান ঝাড়খণ্ডের ) কার্মাটাঁড়ে গমন করলেন ঈশ্বর l
মানবতার সাগর - দয়ার সাগর , মানব সাধনায় ব্রত হয়ে নিজেই কখন যেন  জীবন্ত  ঈশ্বর হয়ে উঠেছিলেন কার্মাটাঁড়র অগণিত অনাহারকৃষ্টা সাঁওতালদের কাছেl
কার্মাটাঁড়ে ৩ একর ১৯ ডেসিমেল জায়গা কিনলেন স্বামীহারা স্বদেশে ফিরে যাওয়া এক ইংরেজ মহিলার কাছে l তিন কামরার বাড়ী বানালেন ( ভিন্নমতে বাড়ী সহ জায়গা কিনেছিলেন) l যার ভিতরে থাকলো স্কুল চালানোর জন্যে একটি হলঘর , একপাশে শোয়ার ঘর ও অন্যপাশে পড়ার ঘর , পিছনে থাকলো স্নানাগার ও শৌচাগার আর উন্মুক্ত বাগান বাড়ি l স্থানটির নাম রাখলেন নন্দনকানন l
 কার্মাটাঁড়ের যাওয়ার সময় নিয়ে ভিন্ন মত থাকলেও বহু তথ্য বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে  ১৮৭৩ সালটাই ব্যবহার  করাই যুক্তিযুক্ত l
কার্মাটাঁড়ের অকথিত ইতিহাস জানতে পারি পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর লেখনী থেকে l তার মতে কর্মা ও  টাঁড়  এই শব্দ যুগলের মিলনে কার্মাটাঁড় শব্দের উৎপত্তি l
করমা নামে এক সাঁওতাল মাঝি আর র্টাঁড় অর্থাৎ উঁচু জায়গা l যা বন্যায় ডুবে যায় না এমন  সাঁওতাল মাঝির এক উঁচু জায়গা l কার্মাটাঁড় স্টেশনটি  জামাতাড়া   ও মধুপুর স্টেশনের মাঝখানে অবস্থিত l ১৯৭৮ সালে এই স্টেশনটির নামকরণ হয় বিদ্যাসাগর স্টেশন l সাঁওতাল পরগনার সাঁওতালদের সহজ সরল জীবন যাপন সত্যবাদীতা ঈশ্বরকে মুগ্ধ করে l 
অশিক্ষিত আদিবাসীদের জন্যে স্থাপন করলেন অবৈতনিক বিদ্যালয় l খুললেন দাতব্য চিকিৎসালয় l
তখন ওখানে কেবল ভুট্টা চাষ হতো l চাষের অবিক্রিত ভুট্টা নিজেই কিনে নিতেন এবং দরিদ্রদের মধ্যে  বিনে পয়সায় বিলিয়ে দিতেন l  একদিন এক  বৃদ্ধা সাঁওতাল রমণী  ঈশ্বরের সম্মুখে এসে বললেন " কে তুই মহাপুরুষ আমাদের বল ! তুই আমাদের দুঃখ বুঝেছিস , তোকে আমরা ছাড়বো না l" গরীব অভাবী সাঁওতাল মেয়েরা শাড়ি চাইতে এলে  তাদের জন্যে কিনে রাখা পোশাক ভর্তি আলমারি খুলে দিতেন  নির্দ্বিধায় l দূরদূরান্তের  অসুস্থ মানুষজনের কথা শুনতে পেলে না খেয়েও ছুটে যেতেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ও  সেবার জন্যে l
একদিন সকালে এক মেথর কাদঁতে কাদঁতে এসে বললো - " আমার ঘরে মেথরানীর কলেরা হয়েছে l বাবা তুমি কিছু না করলে তো বাঁচার উপায় নেই l"  শোনামাত্র না খেয়ে ঔষধ  বাক্স নিয়ে রোগিণীর বাড়ী গেলেন এবং সারাদিন  সাধ্যমতো  চিকিৎসা ও সেবা করলেন l রোগিনী কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরে স্নানাহার করলেন l
  পেটভর্তি খাওয়ারও জুটত না , বড়োজোর জুটত পোয়াটাক ভুট্টার ছাতু  l বিষয়টি গোচরে এল যখন অসুস্থ ঈশ্বর  চিকিৎসার জন্যে কলকাতায় এলেন তখন কলকাতা হাইকোর্টের উকিল শিবপ্রসন্ন ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথোপকথন কালে  নিরন্ন সাঁওতালদের কথা বলতে বলতে আকুল হয়ে কেঁদে ফেললেন l
কার্মাটাঁড় সাঁওতালদের খাদ্য - বস্ত্র ও বাসস্থান এই তিনটি মৌলিক চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি অবৈতনিক শিক্ষাদান  আর অবসর সময়ে  নিজের পড়াও লেখা চালিয়ে যেতেন ধারাবাহিক ভাবে l 
যে  বর্ণপরিচয় থেকে আমাদের হাতে খড়ি হয়েছে l সেই বর্ণপরিচয়ের  ' জল  পড়িতেছে , ' পাতা নড়িতেছে ,   পাঠ করে বিশ্বকবি  রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন " আমার জীবনে এটাই আদি কবির প্রথম কবিতা l  সেই বর্ণপরিচায় এর ষষ্টিতম সংস্করণটিও  করেছিলেন ১৮৭৫  সালে কার্মাটাঁড়ে বসে l বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশায় বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগের  মোট  ১৫২টি  সংস্করণে ৩৩ লক্ষ ৬০ হাজার কপি ও বর্ণপরিচয়ের দ্বিতীয় ভাগের  ১৪০ টি সংস্করণে  ১৫ লক্ষ ৯০ হাজার কপি ছাপা হয় l যা তখনকার দিনে ছিল অকল্পনীয় l
পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি নিজ কাজ নিজে করার শিক্ষা  দেওয়ার উপলব্ধি করলেন l
কার্মাটাঁড় স্টেশনে এক ভদ্রলোক ব্যাগ হাতে  ট্রেন থেকে নামলেন l তারপর  তাঁর ব্যবহার্য্য সামগ্রীর ব্যাগ বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে কুলি খুঁজাখুঁজি ও ডাকাডাকি করতে করতে ক্লান্ত  l ঈশ্বর ভদ্রলোকের সামনে হাজির হয়ে হলেন তারপর  ভদ্রলোকের ছোট্ট  ব্যাগটি তুলে নিয়ে প্লাটফর্মের বাইরে  অপেক্ষারত  পলকিতে  তুলে  দিলেন l মজুরি  বাবদ  ভদ্রলোক দুটি পয়সা  দিতে চাইলে  ঈশ্বর বললেন "ছোট্ট ব্যাগটি  নিয়ে এতটাই চিন্তিত ছিলেন যে আপনাকে সাহায্য না করে পারলাম না l" ভদ্রলোক জোরাজুরি করতে নিজের পরিচয়  দিলেন l ভদ্রলোক খুবই লজ্জিত  হলেন l ভদ্রলোক নিজের কাজ নিজে করার শিক্ষা ভালোই পেলেন l এই রকম বহু ঘটনা ঈশ্বরের  কাছ থেকে আমাদের শিক্ষণীয় l 
শিক্ষা বিস্তারের জন্যে ঈশ্বর সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শকের কাজ  নিয়েছিলেন l ১৮৬৬ সালে ১৬ ডিসেম্বর হুগলির  উত্তরপাড়া থেকে বিদ্যালয় পরিদর্শন করে ফেরার সময় ঘোড়ার গাড়ি দুর্ঘটনার ফলে  যকৃতে  খুব আঘাত পেয়েছিলেন l  সাত দশকের ঈশ্বরের  শরীর পুরানো আঘাতের আর ভার বহন করতে অস্বীকার করলো l চিকিৎসা চলছে কলকাতায় ডা: মহেন্দ্র লাল সরকারের অধীনে l ইংরোজী সালের ১৮৯১এর  ২৯ জুলাই (১৩ শ্রাবণ, ১২৯৮ ) রাত্রি ২ টা ১৮ মিনিট  লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার বাদুড় বাগানের বাড়ী থেকে  ঈশ্বর চললেন চিরনিদ্রার দেশে l খবর আছড়ে  পড়লো কার্মাটাঁড়ে l জীবন্ত দেবতাকে হারিয়ে নন্দন কাননের  চারপাশের হতদরিদ্র সাঁওতালদের মন বিষাদে ভরে গেলো l  বালিকা বিদ্যালয় , নৈশ বিদ্যালয় , দাতব্য  হোমিও চিকিৎসালয় সবই নিমিষে স্তব্ধ হলো l কিছু ঘটনায় ব্যথিত পুত্রের সংস্রব ত্যাগ করা ও পুত্রকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিলেনl তাঁর মৃত্যুর পর  পুত্র নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় ( ঈশ্বরের কথায় যথেচ্ছাচারী কুলাচারি)  কেসে জিতে  উত্তরাধিকারী লাভ করেন l ১৮৯৯ সালে পাথুরিঘাটার মল্লিক পরিবারকে কার্মাটাঁড়ের  সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে দিলেন l
শেষ হলো প্রায় ১৭ বছরের স্বপ্নের নন্দন কানন  কার্মাটাঁড়ের  ইতিহাস l
সত্যি কি শেষ হলো কার্মাটাঁড়ের ইতিহাস۔۔۔!
প্রবাসী বাঙ্গালীদের সংস্থা 'বিহারী  বাঙ্গালী এসোসিয়েশন ' কার্মাটাঁড়ের নন্দন কাননের বাড়ী সহ 
৩ একর ১৯ ডেসিমেল জায়গা  ২৯  মার্চ ১৯৭৪ সালে  কালকাতা নিবাসী ধীরেন্দ্রনাথ মল্লিক ও জিতেন্দ্রনাথ মল্লিকদের কাছ থেকে ২৪,০০০ টাকায় পুনরায় ক্রয় করলেন l তদানীন্তন সমিতির সম্পাদক দীপেন্দ্রনাথ সরকার কলকাতায় এই হস্তান্তর চুক্তি স্বাক্ষর করে বাড়ীর স্বত্ব গ্রহণ করেছিলেন l
প্রতিবছর  ইংরেজি মাসের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখ ধরে উৎসব আকারে ঈশ্বরের জন্মদিন পালন করেন l
২০০ তম জন্ম দিবসটিও বিহারী ও ঝাড়খন্ড বাঙ্গালী এসোসিয়েশন যৌথ ভাবে পালন করেছেন l
প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে মাথায় নিয়ে চলতি বছর বিদ্যাসাগরের আত্মজীবনীতে লেখা ১২ আশ্বিন তারিখটি ধরে ২০০ জন্মদিবসটিও পালন করলেন  মেদিনীপুর থেকে যাওয়া প্রতিবেদক সহ  ৩ জনের প্রতিনিধি দল l প্রথমে নন্দন কাননের আবক্ষ মূর্ত্তি দুটিতে  ও পরে অনতিদূরে ঝুমাদেবী মধ্যেবিদ্যালয় প্রাঙ্গনে l
ছাত্র-ছাত্রী  , শিক্ষক শিক্ষিকাদের সামনে ঈশ্বরের জীবনী - বাণী ও সমাজের প্রতি তাঁর অমূল্য অবদান  তুলে ধরা হয় এবং  মিষ্টি মুখও  ( মেদিনীপুর থেকে নিয়ে যাওয়া ) করানো হয় l স্মৃতি রক্ষা কমিটির  কোষাধ্যক্ষ সশরীরে উপস্থিত থেকে পূর্ণ সহযোগিতা করেন l সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক জরুরী কাজে অন্যত্র থাকলেও মেদিনীপুরের প্রতিনিধি দলকে দুরাভাষ-এর মাধ্যমে  পূর্ণ সহযোগিতা করেন l
ঐদিন 'ক্যুইজে  বিদ্যাসাগর' বইটিই আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশিত হয়  l 
সবশেষে বলি ঈশ্বর , স্বয়ং রামকৃষ্ণদেবও তোমার  নোনা  জল পান করতেও দ্বিধা করেননি l আর রামকৃষ্ণের ভাবশিষ্য বিবেকেও তো দিয়েছেলে কর্মজীবনে শিক্ষকতার পেশা l আমার দৃঢ়  বিশ্বাস রামকৃষ্ণের পাশাপাশি তোমার দেখানো মানব সেবাকেও বিবেক গ্রহণ করেছিলেন আমৃত্যু !
তাই আমার গৃহের দেবালয়ে তুমি স্বমহিমায়  সমাদৃত l
একসময়ে ঈশ্বরের  সহকর্মী ও মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক(১৮৫১- '৬৬) ও স্বাধীনতা আন্দোলনের পিতামহ ঋষি রাজনারায়ণ বসুর কথায়  শেষ করি "আপনি যদি , ধৰ্ম প্রচারক হতেন তাহলে মহামঙ্গল সাধিত হতে পারতো l"

Post a Comment

0 Comments