উপন্যাসের আয়নার -৮
হুমায়ুন আহমেদ : অবশিষ্ট উপন্যাস
প্র শা ন্ত ভৌ মি ক
হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’। ১৯৭২ সালে এই উপন্যাসটি প্রকাশের সাথে সাথেই পাঠক ও সমালোচক মহলে খুব আলোড়ন তুলে। কলকাতার বিখ্যাত ‘দেশ’ পত্রিকায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই উপন্যাসের সমালোচনা লিখেন ‘সনাতন পাঠক’ শিরোনামে। বাংলাদেশের অনেক সমালোচকও এই উপন্যাসের ভুয়সী প্রশংসা করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম আহমেদ শরীফ, আহমেদ ছফা।
এরপর শঙ্খনীল কারাগার, অচিনপুর, সবাই গেছে বনে থেকে শুরু করে শেষ দিকের উপন্যাসগুলো- হুমায়ূন যেন বারবার নিজেকেই ভেঙে ভেঙে গড়েছেন। হুমায়ূনের ‘ফেরা’ উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের একটি সম্পদ বলে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়। পাশাপাশি আরো অনেক উপন্যাসের নামই করা যায়। হুমায়ূনকে এক কথায় মধ্যবিত্তের জীবনীকার বলা যায়। গ্রামের পটভূমিতেই হোক, কিংবা শহরের পটভূমিতে- মধ্যবিত্তের জীবনের ছবিটাই সবচেয়ে সুন্দর চিত্রিত হয়েছে।
অনেকেই মধ্যবিত্ত জীবন নিয়ে লেখাটাকে হুমায়ূনের সীমাবদ্ধতা বললেও হুমায়ূন নিজেই এ ব্যাপারে আত্মপক্ষ সমর্থন করে গেছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, শেক্সপীয়র যদি সারা জীবন রাজা-রানীর গল্পই লিখে যেতে পারেন, তবে এটাও খুব ব্যতিক্রম কিছু নয়। হুমায়ূনের উপন্যাসে জীবন যেন ভিন্ন ভিন্ন ব্যপ্তিতে এসে হাজির হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ‘তেতুল বনে জোছনা’ উপন্যাসের চোর মতি মিয়ার কথা বলা যায়। মতি মিয়া চুরি করলেও কোথাও গিয়ে হুমায়ূন এমন একটা ধুম্রজাল সৃষ্টি করেছেন, এক সময়ে মতি মিয়ার জন্য মায়া না লেগে পারে না। কিংবা ‘জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাই স্কুল’-এর সেই প্রধান শিক্ষকের কথাও ভোলার নয়, যিনি জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও স্কুলের জন্য লড়তে চান।
হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ উপন্যাস কলেবরের দিক দিয়ে ছোট হলেও বেশ কিছু দীর্ঘ উপন্যাস তিনি লিখেছেন। আসলে লেখার ব্যাপারে বরাবরই তিনি পাঠক, সম্পাদক ও প্রকাশকদের চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর সর্বোচ্চ ক্ষমতার প্রকাশ বোধহয় তিনি সব ক্ষেত্রে করতে পারেন নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুব ছোট ছোট উপন্যাস লিখতে বাধ্য হয়েছেন।
হুমায়ূনের লেখা উপন্যাসগুলো থেকে টিভি নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে প্রচুর। বাংলাদেশের সরকারি টেলিভিশন বিটিভির জন্য নির্মিত হয়েছে ধারাবাহিক নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘বহুব্রীহি’। নিজের উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘আমার আছে জল’। আরো অনেক নির্মাতাই তাঁর কাহিনি নিয়ে টেলিভিশন নাটক এবং চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ২০০৭-০৮ এর দিকে বিটিভির জন্য তিনি নিজেই নির্মাণ করছিলেন নিজের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ নিয়ে ধারাবাহিক নাটক। সরকারি একটি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সেই নাটক নির্মাণ বন্ধ করে প্রতিবাদ জানান তিনি।
সমালোচিত হয়েছেন প্রচুর। একজন লেখক তো তাঁর উপন্যাসকে ‘অপন্যাস’ আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু কোন উত্তর না দিয়ে লিখে গেছেন নিজের মত করে। লেখার পরিমিতিবোধ জানতেন হুমায়ূন। কোথায় উইট আনতে হবে, কোথায় সিরিয়াস লিখতে হবে খেয়াল রাখতেন ব্যাপারটায়। ‘যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ’ বলে একটা উপন্যাসের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। কিংবা শেষ দিকে এসে লেখা ‘লীলাবতী’ কিংবা ‘কে কথা কয়’ এর কথাও তো ভোলার উপায় নেই।
তবে সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপারটি ঘটে উপন্যাস ‘’মেঘের ওপর বাড়ি’র ক্ষেত্রে। এই উপন্যাসটি ২০১১ সালের ‘প্রথম আলো ঈদ সংখ্যা’য় প্রকাশিত হয়। উপন্যাসের কাহিনিতে দেখা যায় এক কোলন ক্যানসারের রোগী মারা গেছেন। তার মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে এবং তার পরিবারের লোকজনের বিভিন্ন কাহিনি নিয়ে উপন্যাসটি এগিয়েছে। এই উপন্যাস প্রকাশের এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ব্যাংককে পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় হুমায়ূন নিজেও কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত। তিনি কি নিজের থেকেই জানতেন এরকম কোন একটি ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে? নাহলে কেন হঠাৎ কোলন ক্যান্সারের মত একটা বিষয় নিয়ে লিখতে যাবেন? সেই প্রশ্নের উত্তর জানার কোন উপায় নেই। কারণ সেই কোলন ক্যান্সারের কাছে হার মেনে ২০১২ সালের ১৯ জুলাই হুমায়ূন পাড়ি জমিয়েছেন অচিন কোন দেশে। তাঁর আত্মা চির শান্তিতে থাকুক চন্দ্র কারিগরের কাছে।
0 Comments