জ্বলদর্চি

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত - ৯



পর্ব-৯   

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত  

সু দ র্শ ন  ন ন্দী

১৮৮৩, ১লা জানুয়ারি। ইংরেজির আরেকটি নতুন বছর। শীতের সকাল। ঠাকুর নিজের ঘরে ভক্তদের নিয়ে বসে আছেন। কথা প্রসঙ্গে বললেন,“আমি যন্ত্র, তিনি যন্ত্রী। তিনি যেমন করান, তেমনি করি। যেমন বলান, তেমনি বলি।
এই বলে ধরলেন গান-
“প্রসাদ বলে ভবসাগরে, বসে আছি ভাসিয়ে ভেলা।
জোয়ার এলে উজিয়ে যাব, ভাটিয়ে যাব ভাটার বেলা৷
এবার ঠাকুর বললেন, “ঝড়ের এঁটো পাতা কখনও উড়ে ভাল জায়গায় গিয়ে পড়ল, কখন বা ঝড়ে নর্দমায় গিয়ে পড়ল — ঝড় যেদিকে লয়ে যায়।
এদিন  ঠাকুর হাসতে হাসতে প্রাণকৃষ্ণকে বলছেন -হাজরা একটি কম নয়। যদি এখানে বড় দরগা হয়, তবে হাজরা ছোট দরগা।এরপর বিষয়বুদ্ধি নিয়ে আলোচনায় ঠাকুর বললেন- বিষয় বুদ্ধি ত্যাগ না করলে চৈতন্য হয় না ভগবান লাভ হয় না। এই বলে কবীরের “হরিষে লাগি রহরে ভাই,তেরা বনত বনত বনি যাই...”  গান থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন। 
কবীরের উপরোক্ত গানটি পরে দুবার গেয়েছেন ঠাকুর তার উল্লেখ পাই কথমৃতে।একবার দক্ষিণেশ্বরে, আরেকবার বড়বাজারে মাড়োয়াড়ি ভক্তদের অন্নকূট উৎসবে।   
 
ঐ দিন অর্থাৎ ১লা জানুয়ারি, ১৮৮৩ দক্ষিণেশ্বরে। বেলা সাড়ে ন’টা। প্রাণকৃষ্ণ প্রণাম করে বিদায় নিলেন।
একজন বৈরাগী গোপীযন্ত্রে ঠাকুরের ঘরে গান করছেন:
পরপর তিনটি গান গাইলেন তিনিঃ 
১) নিত্যানন্দের জাহাজ এসেছে।
তোরা পারে যাবি তো ধর এসে ......
 
২)    এই বেলা নে ঘর ছেয়ে।
এবারে বর্ষা ভারি, হও হুঁশিয়ারি, লাগো আদা জল খেয়ে......
 
৩)   কার ভাবে নদে এসে, কাঙাল বেশে, হরি হয়ে বলছি হরি।
কার ভাবে ধরেছ ভাব, এমন স্বভাব, তাও তো কিছু বুঝতে নারি।

ঠাকুর গান শুনছেন, এমন সময় কেদার চাটুজ্যে এসে প্রণাম করলেন। কেদারকে দেখে ঠাকুরের একেবারে শ্রীবৃন্দাবনলীলা উদ্দীপন হল। প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে দাঁড়ালেন ও কেদারকে সম্বোধন করে গান গাইলেন:
সখি, সে বন কতদূর।
(যথা আমার শ্যামসুন্দর) (আর চলিতে যে নারি)
শ্রীরাধার ভাবে গান গাইতে গাইতে ঠাকুর সমাধিস্থ হলেন। এই গানটি ঠাকুর কয়েকবার ভক্তদের উল্লেখ করেছেন।  
১৮৮৩, ১৮ই ফেব্রুয়ারি। শ্রীরামকৃষ্ণ বেলঘরে শ্রীযুক্ত গোবিন্দ মুখুজ্জের বাড়িতে শুভাগমন করেছেন। বেলা ১টা নাগাদ বৈঠকখানাবাড়ির দোতলা ঘরের বারান্দায় ঠাকুর ভক্তসঙ্গে প্রসাদ নিয়েছেন; প্রসাদ সেবা  শেষ হলে নিচের প্রাঙ্গণে একটি ভক্ত গান ধরলেন:

জাগ জাগ জননি,
মূলাধারে নিদ্রাগত কতদিন গত হল কুলকুণ্ডলিনী......
 
ঠাকুর গান শুনে সমাধিস্থ হয়েছিলেন। 
গানটির রচয়িতা দাশরথি রায়। ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে বেলঘরিয়ার গায়ককে আরেকবার গানটি গাইতে বলেছিলেন বলে উল্লেখ পাই। 
 পরের রবিবার ২৫শে ফেব্রুয়ারি ১৮৮৩। দক্ষিণেশ্বরে দুপুরের খাওয়া হলে রাখাল, লাটু, হাজরা, রাম, কেদার মাস্টার এবং আরও অনেকে উপস্থিত ঠাকুরের ঘরে। জনৈক ভক্ত চৌধুরীর সঙ্গে ঠাকুর কথাপ্রসঙ্গে  বলছেন তাঁকে ( ইশ্বরকে) দেখা যায় যদি তিনি দিব্যচক্ষু দেন। ...অনুরাগের সাথে ভক্তি – তাহলে তিনি স্থির থাকতে পারেন না। 
 এই বলে ঠাকুর গান শুরু করলেন:

আমি মুক্তি দিতে কাতর নই
শুদ্ধাভক্তি দিতে কাতর হই......
 
ঠাকুর বোঝাতে চেয়েছেন , মূলকথা ঈশ্বরে রাগানুগা ভক্তি। আর বিবেক বৈরাগ্য।
গানটির রচয়িতা অজ্ঞাত। কথামৃতে ঠাকুরকে দুবার এবং রামলালকে একবার গানটি গাইতে দেখি। 
১৮৮৩, ১১ই মার্চে গাওয়া গানের উল্লেখ করব কালীবাড়িতে। এদিন শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মমহোৎসব, ফাল্গুন শুক্লা দ্বিতীয়া।  
সকাল থেকে ভক্তেরা একে একে জুটছেন। সামনে মা ভবতারিণীর মন্দির। চারদিকে আনন্দের হাট বসেছে। ঈশ্বরের কথা হচ্ছে।  
সেই আনন্দ হাটে গান গাইছেন ভবনাথ ও কালীকৃষ্ণ:
ধন্য ধন্য ধন্য আজি দিন আনন্দকারী,
সব মিলে তব সত্যধর্ম ভারতে প্রচারি।
হৃদয়ে হৃদয়ে তোমারি ধাম, দিশি দিশি তব পুণ্য নাম;
ভক্তজনসমাজ আজি স্তুতি করে তোমারি।...।
 
(গানটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা) 

এছাড়াও ভক্তরা গাইলেনঃ
 
১)শ্যামাপদ-আকাশেতে মন ঘুড়িখান উড়তেছিল৷
কলুষের কুবাতাস পেয়ে গোপ্তা খেয়ে পড়ে গেল।৷ ...
 
২)মজলো আমার মনভ্রমরা শ্যামাপদ নীলকমলে ৷
(শ্যামাপদ নীলকমলে, কালীপদ নীলকমলে!)...
 
    ৩) শ্যামা মা কি এক কল করেছে।
(কালী মা কি এক কল করেছে)...
 ( এই গান তিনটি পূর্বে উল্লেখিত)

এছাড়াও ভক্তরা নীচের গানটি গেয়েছিলেন। 
        ভবে আসা খেলতে পাশা কত আশা করেছিলাম।
আশার আশা ভাঙা দশা প্রথমে পঞ্জুড়ি পেলাম ......
রামপ্রসাদের এই গানটি এখানে ভক্তরা গাইলেও ঠাকুর নিজেও একবার ( ২৫শে মে ১৮৮৪) দক্ষিণেশ্বরে গেয়েছিলেন।

Post a Comment

0 Comments