জ্বলদর্চি

দিল্লি দর্পণ - ৯

মাতৃমন্দিরের অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধেয় মান্না দে-র সাথে লেখক
    


দিল্লি দর্পণ  - ৯ 

কা লী প দ  চ ক্র ব র্ত্তী 

 সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে মন্দিরগুলোর অবদান
                        
দিল্লির যেসব বাঙালিরা পুলিশের সেবামূলক কাজের উচ্চপদে আছেন, তাঁদের সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে শ্রদ্ধেয়া কল্যাণী দত্ত জানালেন, একসময়ে আই বি-তে উচ্চপদে ছিলেন শ্রদ্ধেয় চ্যাটার্জী (সি আর পার্কে ‘এ’ ব্লক-এ থাকতেন) এবং অশোক ব্যানার্জী মহাশয় (এম ব্লকে থাকতেন) সি বি আই-এর ডেপুটি ডাইরেক্টর ছিলেন,খুবই সুনামের সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। বর্তমানে সি বি আই-এর ডেপুটি ডাইরেক্টর রূপক দত্ত বর্তমানে কর্ণাটকে আছেন। দিল্লির ড.অর্জুন সেনগুপ্ত বর্তমানে নেদারল্যান্ডে ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত আছেন। প্রত্যেকেই খুব সুনামের সাথে তাদের কাজ করে চলেছেন।

এবার দিল্লির কালীবাড়িগুলো নিয়ে লেখা শুরু করি। দিল্লির সব কালীবাড়িগুলো নিয়ে স্বল্প পরিসরে লেখা সম্ভব হবে না, তাই সংক্ষেপে মাত্র কয়েকটি কালীবাড়ির কথা এবং তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে শুধুমাত্র সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের কথাই উল্লেখ করবো।  
 
    মাতৃমন্দিরের লক্ষ্মী-নারায়নের বিগ্রহ

আমি দিল্লির সফদরজঙ্গ এনক্লেভ-এর মাতৃমন্দির কালীবাড়ির সাথে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত, তাই প্রথমে মাতৃমন্দির কালীবাড়ি নিয়েই আলোচনা শুরু করছি। বর্তমানে দিল্লির মাতৃমন্দির কালীবাড়ির নাম শুধুমাত্র ভারতবর্ষেই নয়, বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে এই কালীবাড়ির পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন মাতৃমন্দির সমিতি। মাতৃমন্দির সমিতি স্থাপিত হয়েছিল ১৯৬৬ সালে এবং ১৯৬৭ সালে সোসাইটি হিসেবে নথিভুক্ত হয়। ১৯৬৯ সালের অক্টোবর মাসে শ্যামাপুজোর দিন প্রথম সেখানে মা কালীর মূর্তি স্থাপিত হয় এবং পুজো শুরু হয়। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে ধর্মশালা নির্মাণের প্রচেষ্টা শুরু হয় এবং ১৯৭৪ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর প্রফেসর দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (মন্ত্রী) কে দিয়ে নতুন মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। পরমপূজ্য আনন্দময়ী মা এসে যেস্থানে বসেছিলেন সেইখানে মা-কালীর মূর্তি স্থাপন করা হয়। ১৯৭৮ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর ভারতের উপরাষ্ট্রপতি বি.ডি. জাত্তি বর্তমান কালীমন্দিরের উদ্বোধন করেন। প্রতি দু'বছর অন্তর নির্বাচনের মাধ্যমে এই কালীবাড়ির কার্যনির্বাহক কমিটি গঠন করা হয়। 

মাতৃমন্দির কালীবাড়ি থেকে বিগত ১৮ বছর ধরে “মাতৃমন্দির সংবাদ” নামে একটি সুপাঠ্য পারিবারিক ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে আসছে। শুরু থেকে অর্থাৎ ২০০২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে জুলাই ২০১৯ মাস পর্যন্ত  (১৮ বছর) আমি পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলাম। মাতৃমন্দির থেকে যখন প্রথম পত্রিকাটি শুরু হয় তখন মাতৃমন্দিরের সদস্যরা ছাড়াও পরিমল ভট্টাচার্য, ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য এবং শেখর চট্টোপাধ্যায় আমাকে প্রচুরভাবে উৎসাহিত করেছেন। ওনাদের অনুপ্রেরণাতেই প্রথম মাতৃমন্দির সংবাদ প্রকাশ পেতে থাকে। অবশ্য শেখর আজ আর এই পৃথিবীতে নেই। শেখরের অনুপস্থিতি সব সময় মনে পড়ে। মাতৃমন্দির সংবাদ বর্তমানে বেশ সুখ্যাতি অর্জন করেছে। এই পত্রিকায় শক্তিপদ রাজগুরু-র লেখা বহুবার প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, কবি অরুণ চক্রবর্তী, পি সি সরকার, সুস্মিতা নাথ, আইভি চট্টোপাধ্যায় এবং অদিতি ভট্টাচার্য-র মত আরও বহু নামী লেখক-লেখিকা ও কবিরা লিখে থাকেন।  অন্যান্যদের নাম দিতে গেলে লিস্ট অনেকে বড় হয়ে যাবে।
    
    মাতৃমন্দিরের মা কালীর বিগ্রহ

শুধুমাত্র পত্রিকা প্রকাশ করেই এরা থেমে থাকেননি। প্রতি মাসের প্রথম রবিবার “সৃষ্টি সাহিত্য আসর”-এর আয়োজন করা হয়। দিল্লির লেখক, লেখিকা ও কবিরা তাতে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও মাসের তৃতীয় রবিবার দিল্লির বঙ্গভাষী সমিতির তত্ত্বাবধানে মাতৃমন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আসর। প্রতি রবিবার বিনা-পয়সায় বাংলা শিক্ষার ক্লাসেরও আয়োজন করা হয়, বাংলা কবিতা প্রতিযোগিতা, ছোটদের অঙ্কন প্রতিযোগিতা, গানের ক্লাস এবং আঁকার ক্লাসেরও  আয়োজন করা হয়। মাতৃমন্দিরের মঞ্চটি বিনামূল্যে বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। 

    মাতৃমন্দিরের মিলন উৎসবে সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু            মুখোপাধ্যায়ের সাথে লেখক


এছাড়াও দুর্গাপূজা এবং বাঙালিদের বিভিন্ন পূজা এবং অনুষ্ঠানের দিনগুলোতে বাংলা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দিল্লির বাংলা পড়ানো হয় এমন কিছু বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের এবং দুঃস্থ ছাত্র-ছাত্রীদের আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. সিদ্ধার্থ     মুখোপাধ্যায় এবং তার পুরো পরিবার এই মন্দিরের আজীবন সদস্য। ওনার পিতৃদেব স্বর্গীয় শিবেশ্বর মুখোপাধ্যায় এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম।শিবেশ্বরবাবু খুবই উদার মানুষ ছিলেন।মাতৃমন্দিরের জন্য তাঁর অবদান কেউ কোনও দিনই ভুলতে পারবেননা।বর্তমানে মাতৃমন্দিরের এই বিরাট কর্মকাণ্ডের সাথে যারা জরিয়ে আছেন তাদের মধ্যে ভবতোষ মৈত্র এবং পরিমল ভট্টাচার্য, স্বপন চক্রবর্তী, অরুণ কুমার সেন, বিদ্যুৎ কুমার দে ইত্যাদির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু সদস্য এবং হিতৈষীরা মন্দিরের  ও বাঙালিদের বিভিন্ন সমাজ কল্যাণমূলক কাজে রাতদিন পরিশ্রম করে চলেছেন। এই মন্দিরে সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, ক্রিকেটার সৌরভ গাঙ্গুলি, চেতন চৌহান এবং বীরেন্দ্র শেহবাগ, সঙ্গীতজ্ঞ মান্না দে, রুনা লায়লা, ঊষা ঊত্থুপ, নচিকেতা, বাবুল সুপ্রিয়,  শিল্পী আনন্দ শঙ্কর, তনুশ্রী শঙ্কর, মমতা শঙ্কর, ইত্যাদিদের  আসতে দেখেছি। বলতে পারেন কোনও নামী শিল্পীই বাদ যাননি। তাই মাতৃমন্দিরকে এক কথায় সকলেই চেনেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে অটল বিহারী বাজপেয়ীর সাথেও আমার আলাপ হয় এই মন্দিরে। এই প্রসঙ্গে জানাই আমাদের সকলের প্রিয় সঙ্গীত শিল্পী মান্না দে-র সাথে আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা। আমি তখন মাতৃমন্দির সমিতির কালচারাল কমিটির চেয়ারম্যান এবং সেবার মাতৃমন্দিরের দুর্গাপূজার সময় শ্রদ্ধেয় মান্না দে-কে অনুষ্ঠানের জন্য বঙ্গভবনের স্বর্গীয় বাবুলদার (বাবুল বোস) মারফৎ আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হল আমাদের থেকে কোনও রকম অগ্রিম সম্মান দক্ষিণা না নিয়েই শ্রদ্ধেয় মান্না দে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন অনুষ্ঠান করতে। দ্বিতীয়ত: আমাদের যেদিন অনুষ্ঠান ছিল সেদিন নিউদিল্লি কালীবাড়িতেও ওনার অনুষ্ঠান ছিল। কিন্তু ওনার আসতে দেরী দেখে আমাদের হৃদস্পন্দন বাড়ছিল। অনেকেই ভেবেছিলেন যে যেহেতু আমরা অগ্রিম সম্মান দক্ষিণা দিয়ে বুকিং করিনি তাই আমাদের অনুষ্ঠানে না এলেও আমাদের কিছু বলার থাকবেনা। এমনকি দর্শকেরা যে উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারেন এমন সম্ভাবনাও উড়িয়েদিতে পারছিলামনা। কিন্তু আমাদের সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে আমাদের প্রিয় শিল্পী সেদিন এসেছিলেন এবং স্টেজে ওঠার আগে আমাকে বলেছিলেন, যেহেতু একটা অনুষ্ঠান থেকে গান গেয়ে আসছেন তাই দু'টোর বেশি গান গাইবেন না। আমরা তাতেই রাজী হয়ে যাই। ওনাকে গরম শাল এবং উত্তরীয় দিয়ে সম্মান জানানো হয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, বিশাল দর্শকদের অধীর আগ্রহে বসে থাকতে দেখে আমাকে বলেছিলেন – আমি এখন আর ডিনার করবো না। এতগুলো দর্শককে আমি বসিয়ে রাখতে পারবো না। তুমি বরং  আমার খাবারটা প্যাক করে দিও, সেটা হোটেলে ফিরে খেয়ে নেবো। তুমি শুধু অনুষ্ঠান চলাকালীন চা-টা সরবরাহ করতে বলবে। এখানেই শেষ নয়, যিনি আমাকে দু'টি গান গাইবেন বলেছিলেন, সেই মান্না দে সারারাত ধরে সূর্য উদয় না হওয়া পর্যন্ত  আমাদের সামনে গান গেয়ে গিয়েছিলেন। সেসময় দিল্লিতে সারারাত ধরে অনুষ্ঠান হত দুর্গাপুজোর সময়ে। শেষ পর্যন্ত আমাকে বলতে হয়েছিল - দাদা, সকাল হয়ে গেছে , এবার আমাদের যে থামতে হবেই কারণ দুর্গামায়ের পুজোর জোগাড় শুরু করতে হবে। অনুষ্ঠানের শেষে বলেছিলেন – আমি তোমাদের সামনে গান গেয়ে এত আনন্দ পেয়েছি যে আমার খিদে, তৃষ্ণা সব ভুলে গিয়েছিলাম। এই হল মান্না দে। এ থেকেই বুঝতে পারবেন তিনি কত বড় মাপের শিল্পী ছিলেন।  এটাই আমাদের কাছে ছিল খুব বড় পাওয়া এবং পুরস্কার। দিল্লির লোকেরা কি কখনও মান্না দের এই অনুষ্ঠানের কথা বা মান্না দে-কে  ভুলতে পারবেন? তাইতো আজও সেসব সুখ স্মৃতি মনকে নাড়া দিয়ে যায়। মনটা নস্টালজিক হয়ে ওঠে।  

তথ্যসূত্র –  আমার হিতৈষী বন্ধুরা   
         অন্যান্য স্থানীয় পত্র-পত্রিকা এবং ম্যাগাজিন।

Post a Comment

11 Comments

  1. সাহিত্যের পরিসরে লেখক দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা ও মননশীল লেখার সঙ্গে যুক্ত। দিল্লিবাসীর সাহিত্যচর্চা ও সংস্কৃতিতে মন্দির গুলির ভূমিকা অনস্বীকার্য। একেবারে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে।
    মহান শিল্পী মান্না দে সম্বন্ধে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতার কথা লেখক জানালেন।
    লেখককে ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  2. দারুণ কালীপদদা, খুব ভাল লাগলো। চালিয়ে যান

    ReplyDelete
  3. দারুণ কালীপদদা, খুব ভাল লাগলো। চালিয়ে যান

    ReplyDelete
  4. এই পর্বটি যেমন সুখপাঠ্য তেমন তথ্য সমৃদ্ধ। লেখককে বিনম্র শ্রদ্ধা।

    ReplyDelete
  5. একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে আসে আপনার লেখা । অভিনন্দন দাদা ।

    ReplyDelete
  6. হৃদয়গ্রাহী লেখা । মান্না দে সম্পর্কে জেনে খুব ভাল লাগল ।

    ReplyDelete
  7. দিল্লিতে বাংলা সংস্কৃতি প্রসারণে কালীবাড়িগুলোর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁরা আরো মানুষকে সুস্থ্য সংস্কৃতিচর্চায় অনুপ্রেরণা যোগান - এই কামনা করি। 👏👏💐

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। আপনাদের মন্তব্য আমাকে প্রেরণা দেয়।

      Delete
  8. অপূর্ব, একবার পড়তে শুরু করলে মনে হয়, আরও অনেক কিছু জানার রয়েছে । ধন্যবাদ দাদা, সুন্দর সমৃদ্ধ লেখার জন্য ।

    ReplyDelete
  9. খুব ভাল লাগল পড়ে। মাতৃমন্দির সম্বন্ধে এবং মাতৃমন্দিরে আপনার ভূমিকা এবং অবদান প্রসঙ্গেও অবগত হলাম। মান্না দের সঙ্গে আপনাকে চেনাই যাচ্ছে না! এটা কোন বছরের ছবি? ভালো থাকবেন।

    ReplyDelete
  10. নীলোত্পলSeptember 12, 2020 at 12:26 PM

    অসাধারণ তথ্য সমৃদ্ধ লেখা।অনেক কিছু জানা হলো।এরকম আরও লেখা চাই।

    ReplyDelete