জ্বলদর্চি

দিল্লি দর্পণ - ৮



দিল্লি দর্পণ  ৮ম পর্ব

দিল্লিতে বাঙালিদের মন্দির 


কা লী প দ  চ ক্র ব র্ত্তী 

আমাদের প্রাক্তণ রাষ্ট্রপতি এবং প্রিয় প্রণব মুখার্জ্জী আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। দিল্লিতে থাকাকালীন দিল্লির সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং মন্দিরগুলোর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। দক্ষিণ দিল্লি কালীবাড়ির সর্বাঙ্গীন উন্নতির জন্য প্রচুর পরিমাণে সাহায্য করেছেন একথা দিল্লির মানুষেরা সকলেই জানেন। আজ  তাঁকে হারিয়ে আমাদের সকলের মনই খুব ভারাক্রান্ত। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।  

এর আগের পর্বে কৃতি বাঙালিদের কথা লিখতে গিয়ে অনেকের নামই জায়গার অভাবে লেখা হয়নি। চিত্তরঞ্জন পাকড়াশী মহাশয় আইফ্যাক্স-এর আজীবন সদস্য ছিলেন এবং অফিসের বাইরে নিজের শিল্পচর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন।দিল্লি এবং কলকাতায় তাঁর একক চিত্র প্রদর্শনী হয় এবং উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, ১৯৫৬ সাল থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে তিনি ভারত, মরিশাস এবং রিপাব্লিক অফ লাও-র জন্য মোট ৫৬টি ডাকটিকিটের ডিজাইন করে দেন। তাঁর বানানো ১৯৫৬ সালে বুদ্ধ জয়ন্তী, ১৯৬৯ সালে গান্ধী জয়ন্তী এবং ১৯৭২ সালে ভারতের স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী উপলক্ষে তৈরি ডিজাইনগুলো রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়। এছাড়াও চিত্তরঞ্জনবাবুর করা ডিজাইনে জয় বাংলা, ইউ পি ইউ শতাব্দী, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, কংগ্রেস শতাব্দী, নেহেরু জন্ম শতাব্দী, স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো ভাষণ শতাব্দী, জে আর ডি টাটা সংযুক্ত রাষ্ট্র অর্ধ শতাব্দী, শিরডি সাঁই বাবা এবং ওস্তাদ বিসমিল্লা খান ডাকটিকিটগুলো উল্লেখযোগ্য।ছবি আঁকার পাশাপাশি বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নিয়মিতভাবে লিখতেন। নন্দন দাসগুপ্ত এবং তাঁর কিছু সহযোগীর প্রচেষ্টায় ‘হিন্দোল’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করেন। তাঁর লেখা বই ‘A Stamp is Born’ একটি মূল্যবান গ্রন্থ। বর্তমান-এ এই হিন্দোল পত্রিকার সম্পাদনার দ্বায়িতে আছেন নন্দন দাসগুপ্ত মহাশয়।পত্রিকা প্রকাশের প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, বর্তমানে করোনা এবং লকডাউনের বাধা উপেক্ষা করেও দিল্লির বাঙালিরা ‘কলমের সাত রঙ’ নামে একটি নতুন সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করতে চলেছেন এবছর শারদীয়ার সময় । এই পত্রিকায় লিখেছেন দিল্লি এবং কলকাতার অনেক প্রসিদ্ধ সাহিত্যিকেরা। তারমধ্যে কলকাতার তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুস্মিতা নাথ, কবি অরুণ চক্রবর্তী, দিল্লির জয়ন্ত ঘোষাল ও আরও  অনেকে আছেন।আশাকরি পত্রিকাটি আপনাদের সকলের মন জয় করতে পারবে।  
  
আগের পর্বে প্রফেসর আশিস দত্ত-র কথা লিখেছিলাম। আশিসবাবু পদ্মশ্রী এবং পদ্মভূষণ দুটোই পেয়েছিলেন। পদ্মশ্রী পেয়েছিলেন উৎপল সেনগুপ্ত, ডাঃ শ্যামাপ্রসাদ মণ্ডল, ইনকাম ট্যাক্স কমিশনার হয়েছিলেন অরবিন্দ ব্যানার্জী, শান্তিস্বরূপ পুরষ্কার পেয়েছেন ডাঃ অমিত ব্যানার্জী। ডাঃ প্রফেসর অনিন্দিতা মণ্ডল ও একজন কৃতি বাঙালি।পুলিশ বিভাগেও বাঙালিরা পিছিয়ে নেই। দিল্লিতে বাঙালি এ সি পি ,রজত কুমার নিয়োগী (আই  পি এস)-কে এক কথায় সবাই চেনেন।  রজতবাবুর সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় আছে। বর্তমানে তিনি অবসরপ্রাপ্ত। রজতবাবুর কথা বলতে গিয়ে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। মাতৃমন্দিরের দুর্গাপুজোর অনুষ্ঠানে একবার উষা উত্থুপ গান গাইতে আসবেন। আমি সেবার অনুষ্ঠান পরিচালনা এবং সঞ্চালনের দায়িত্বে ছিলাম। দিল্লিতে বিশেষ কোনও অসুবিধের জন্য সেদিন পুলিশের সিক্যুরিটি পাচ্ছিলামনা। সেদিন রজতবাবুকে সমস্যা বলাতেই সাথে সাথে সিক্যুরিটির ব্যবস্থা তিনি করে দিয়েছিলেন।এভাবে রজতবাবুকে বিভিন্নসময়ে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে দেখেছি। দিল্লিতে আমার পরিচিত আরও দুজন কৃতি বাঙালি হলেন রথিন মুখার্জী এবং দেবাশীষ বাগচী মহাশয়।এরা সকলেই আমাদের কাছে শ্রদ্ধার এবং গর্বের পাত্র।   
   
একবার ভেবে দেখুনতো বাঙালিরা প্রবাসে থাকবে অথচ সেখানে মন্দির থাকবেনা বা দুর্গাপুজো হবেনা এরকম আদৌ কি ভাবা যায়! আপনি ঠিকই ভেবেছেন এটা একেবারে  অসম্ভব । বাঙালি বাংলা থেকে যত দূরেই থাকুক-না কেন মন্দির থাকবেনা বা সেখানে দুর্গাপুজো হবে না এটা আমাদের চিন্তার বাইরে।বাংলার সাহিত্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সে কখনওই ভোলেনি এবং ভুলতেও পারবেনা। আমাদের যত মতবিরোধই থাকুক-না কেন, আমরা বাংলার জন্য সবসময়ই গর্ব অনুভব করি। আপনি পৃথিবীর যেখানেই যাবেন, দেখবেন বাঙালি মন্দির বানাতে না পারলেও দুর্গাপুজো ঠিকই করে। তাইতো মজা করে অনেকে বলেন, দশজন বাঙালি একসাথে হলেই মন্দির বানাবে, নয়তো দুর্গাপুজো করবে। দিল্লিও এর ব্যতিক্রম নয়। দিল্লিতেও অনেক মন্দির আছে এবং বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এর অবদান প্রচুর। দিল্লিতে মন্দিরগুলো বাঙালিদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে বললে ভুল হবেনা।
দিল্লিতে বাঙালিরা প্রায় বাইশ লক্ষের মত (এ নিয়ে দ্বিমত আছে। কেউ বলেন কুড়ি লক্ষ, আবার কেউ বলেন পঁচিশ লক্ষ) হলেও তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন, তাই তাদের একসাথে মিলিত হওয়ার জায়গা বা মিলনস্থল হল এই মন্দিরগুলো এবং বেঙ্গল অ্যাসোশিয়সনের মত কয়েকটি বাঙালি প্রতিষ্ঠান। দিল্লির কয়েকটি মন্দিরের নাম উল্লেখ করছি। এরমধ্যে বেশির ভাগ মন্দিরগুলোতেই থাকা,খাওয়ার এবং পর্যটকদের জন্য ভ্রমণের সুবন্দোবস্ত আছে। এখানে পর্যটকেরা এসে স্বল্প খরচে থাকতে পারেন। যে সব কালীবাড়িগুলোর নাম উল্লেখ না করলেই নয়, সেগুলো হল –  

১) ত্রিশ হাজারী কালীবাড়ি, ২) নিউ দিল্লি কালীবাড়ি, ৩) গ্রেটার কৈলাসের দুর্গাবাড়ি, ৪) সফদরজঙ্গ এনক্লেভের মাতৃমন্দির কালীবাড়ি।৫) চিত্তরঞ্জন পার্ক কালীবাড়ি, ৬) মহামায়া কালীবাড়ি, সাকেত, ৭) দক্ষিণ দিল্লি কালীবাড়ি, রামকৃষ্ণ পুরম, ৮) পশ্চিম দিল্লি কালীবাড়ি,জনক-পুরী, তিলক নগর, ৯) পশ্চিম বিহার কালীবাড়ি, ১০) নিবেদিতা কালীবাড়ি, পশ্চিম বিহার, ১১) বিকাশপুরী  কালীমন্দির, ১২) রোহিনী সেক্টর কালীবাড়ি, ১৩) রোহিনী সেক্টর – ১১ এবং সেক্টর ১৩ কালীবাড়ি, ১৪) পীতমপুরা কালীমন্দির, পুষ্পাঞ্জলি এনক্লেভ, ১৫) করমপুরা  কালীমন্দির, ১৬) অশোক বিহার দুর্গাবাড়ি, ১৭) শালিমার বাগ কালীমন্দির, ১৮) আয়ানগর কালীবাড়ি, ১৯) মিন্টোরোড কালীবাড়ি, ২০) বেয়ার্ড রোড কালীবাড়ি, ২১) কেশব পুরম কালীবাড়ি, লরেন্স রোড, ২২) বসন্তকুঞ্জ কালীবাড়ি, ২৩) সরোজিনী নগর কালীবাড়ি, ২৪) লক্ষ্মীবাই নগর শিবশক্তি মন্দির, ২৫) কালীকৃষ্ণ মন্দির, চিত্তরঞ্জন পার্ক, ২৬) দক্ষিণপুরী কালীমন্দির,খানপুর, ২৭) লোদী রোড কালীবাড়ি, লোদী কলোনি, ২৮) ময়ূর বিহার ফেজ – ১ কালীমন্দির, ২৯) পূর্বদিল্লি দুর্গাবাড়ি, ফেজ – ২, ৩০) গণেশ নগর কালীবাড়ি, পাণ্ডব নগর, ৩১) পূর্বাশা কালীবাড়ি, পটপরগঞ্জ, ৩২) চন্দ্রবিহার কালীবাড়ি, পটপরগঞ্জ, ৩৩) ঝিলমিল কালীবাড়ি, ৩৪) ময়ূরবিহার, ফেজ – ৩ কালীবাড়ি, ৩৫) দিলশাদ গার্ডেন কালীবাড়ি ‘জে’ ও ‘কে’ ব্লক, ৩৬) সিলমপুর কালীবাড়ি, ৩৭) অশোক নগর কালীবাড়ি, ৩৮) জয়দেব চ্যাটার্জীর কালীবাড়ি, লক্ষ্মীনগর, ৩৯) চিত্তরঞ্জন পার্ক ১ নম্বর মার্কেট, ৪০) চিত্তরঞ্জন পার্ক পকেট ৪০ শিবমন্দির, ৪১) মহাবীর এনক্লেভ কালীবাড়ি ইত্যাদি। ইতিমধ্যে আরও কিছু কালীমন্দির হয়তো স্থাপিত হয়ে থাকবে যেগুলো সম্পর্কে এখনও জানতে পারিনি। 

দিল্লির আশেপাশে অর্থাৎ নয়ডা, ফরিদাবাদ এবং গাজিয়াবাদেও বেশকিছু কালীবাড়ি গড়ে উঠেছে তারমধ্যে নয়ডার সেক্টর ২৬-এর নয়ডা কালীবাড়ি, ফরিদাবাদের কালীবাড়ি এবং গাজিয়াবাদের ইন্দিরাপুরমের কালীবাড়ি উল্লেখযোগ্য। তবে একটা কথা স্পষ্ট যে এইসব কালীবাড়িগুলো বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রচার এবং প্রসারে যেভাবে কাজ করে চলেছে তা এককথায় অতুলনীয়। এমনকি বহু মন্দিরেই বাঙালি পর্যটকদের জন্য স্বল্পমূল্যে থাকা, খাওয়া এবং ভ্রমণের সুবন্দোবস্তও করে থাকেন। 

তথ্যসূত্র –  দিল্লির বাঙালি – চিত্তরঞ্জন পাকড়াশী 
         কৃতজ্ঞতা স্বীকার – রণজিৎ চট্টোপাধ্যায়  
         অন্যান্য স্থানীয় পত্র-পত্রিকা এবং ম্যাগাজিন।

Post a Comment

6 Comments

  1. এক কথায় অপূর্ব

    ReplyDelete
  2. এক কথায় অপূর্ব

    ReplyDelete
  3. সমৃদ্ধ হচ্ছি প্রতিনিয়ত। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই দাদা।

    ReplyDelete
  4. অতি সুন্দর সমস্ত তথ্যাদি সমৃদ্ধ লেখা গুলো পড়ে খুব ভাল লাগছে এবং আরও জানবার ইচ্ছা বাড়ছে ,
    ধন্যবাদ দাদা।

    ReplyDelete
  5. অসাধারণ লাগলো,খুব তথ্য সমৃদ্ধ লেখা।অনেক কিছু জানলাম।প্রণাম দাদা ।

    ReplyDelete
  6. দিল্লি তে থাকি কিন্তু অনেক কিছু ই জানিনা । আপনার প্রবন্ধ পড়ে অনেক কিছু জানতে পারছি ।ভাল লাগছে ।

    ReplyDelete