জ্বলদর্চি

মহালয়া / মুক্তি দাশ

   শিল্পী - রবীন্দ্রনাথ কপাট  



মহালয়া

মু ক্তি  দা শ

পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনা – এই মহালগ্নটি আমাদের কাছে ‘মহালয়া’ রূপে চিহ্নিত হয়ে আছে। যেন পিতৃপক্ষের অবসানকালে অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার অতিক্রম করে আমরা এবার প্রবেশ করবো আলোকোজ্জ্বল দেবীপক্ষের নান্দনিক পরিমন্ডলে, এক মহান আশ্রয়ে। মহালয়ায় দেবীপক্ষের সূচনায় মায়ের মহান আশ্রয়ে বা মহালয়ে (মহা + আলয় = মহালয়) সন্তানেরা প্রবেশ করে। আর তাই এই মহালয়ে প্রবেশের ক্ষণ বা তিথিই মহালয়া। অনেকে আবার ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁরা মনে করেন, আসলে সেই মহা আলয়টি হচ্ছে পিতৃলোক।

আপাতদৃষ্টিতে মহালয়ার সংগে দুর্গাপুজোর তেমন কোনো যোগ নেই বললেই চলে। যদিও এই দিনেই আনুষ্ঠানিকভাবে দেবীর চক্ষুদান পর্বটি পুরাণ-সমর্থিত। কিন্তু দিনটি আসলে পিতৃপক্ষের অবসানকে চিহ্নিত করে মাত্র। এই দিনে পিতৃপুরুষ ও পূর্বপুরুষদের স্মৃতির উদ্দেশে মানুষ তর্পণ করেন। তর্পণ মানে তো খুশি করা। পূর্বপুরুষের অতৃপ্ত বিদেহী আত্মাকে খুশি করার উদ্দেশ্যে পিন্ডদানও করা হয়। তারপর চলে দেবীপক্ষে প্রবেশের প্রস্তুতি। মোটকথা, আশ্বিনমাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যাকে আমরা সঙ্গত কারণেই ‘মহালয়া’ রূপে চিহ্নিত করে দিয়েছি – কারণ দিনটি হচ্ছে পিতৃপূজা ও মাতৃপূজার সন্ধিলগ্ন।

পুরাণমতে, এই মহালয়ার পুণ্যলগ্নে দেবতাদের সম্মিলিত বাসনা ও প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে নারীশক্তির প্রতীকী হয়ে দেবী মহামায়া রূপে প্রকটিত হন। তারপর দেবতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় অস্ত্রসজ্জিতা হয়ে প্রবল পরাক্রমশালী ক্ষমতালিপ্সু অশুভশক্তিরূপী মহিষাসুরকে যুদ্ধে পরাস্ত ও বধ করেন।

কিন্তু মহাভারতে আবার সম্পূর্ণ অন্য কাহিনী। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করে মহাবীর কর্ণের স্বর্গবাস হয়। সেখানে তাঁকে খাদ্যোপযোগী কোনোকিছুই দেওয়া হতো না। তার বদলে খাবার হিসেবে দেওয়া হতো সোনা-রূপো জাতীয় নানাবিধ মূল্যবান ধাতব সামগ্রী। ক্ষুণ্ণ হয়ে কর্ণ এর প্রতিবাদ করেন এবং কারণ জানতে চান। তাঁকে জানানো হয় যে, সারাজীবন তিনি কেবল শক্তির আরাধনাই করে গেছেন, কখনো তাঁর পূর্বপুরুষদের কথা স্মরণ করেননি, তাঁদের প্রয়াত আত্মাকে জলদান পর্যন্ত করেননি। এখন কর্ণ তাঁর স্বীয় কর্মফলে মৃত্যুর পর স্বর্গবাসী হতে পারলেও, উপযুক্ত খাদ্য-পানীয় পাবার যোগ্য বলে বিবেচিত হননি। অবাক হয়ে কর্ণ জানালেন, এতে তাঁর দোষটা কোথায়? তিনি তো জানতেনই না, কী তাঁর বংশ পরিচয়, কে তাঁর আসল বাবা-মা! তিনি সূত বংশজাত অধিরথ ও তাঁর স্ত্রীর নিকট প্রতিপালিত এবং দুর্যোধনের আশ্রয়ে বয়ঃপ্রাপ্ত হন। তারপর কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের একেবারে ঠিক আগের দিনটিতে তাঁর আপন মা কুন্তী এসে কর্ণের জন্মবৃত্তান্ত ও বংশপরিচয় জানিয়ে গেলেন। কিন্তু ততদিনে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। তারপর তো শুরু হয়ে গেল মহাযুদ্ধ। যুদ্ধচলাকালীন প্রাণ হারালেন কর্ণ। তাহলে আর পিতৃতর্পনের সময় বা সুযোগ কোথায়? কিন্তু তাহলে এখন উপায়? উপায় বার করলেন দেবরাজ ইন্দ্র। ইন্দ্রর নির্দেশে কর্ণ আবার মর্তে ফিরে এলেন তাঁর অসমাপ্ত কা্জ পূর্ণ করতে। ভাদ্রমাসের কৃষ্ণপ্রতিপদ তিথি থেকে শুরু করে অমাবস্যা পর্যন্ত একপক্ষকাল তিনি পিতৃপুরুষকে তিল-জল ও পিন্ডদান করে নিজের পাপস্খলন করলেন। এবং অমাবস্যা তিথিতে তিনি শেষবারের মতো জলদান করে যথারীতি স্বর্গে ফিরে যান। এই একপক্ষকালকেই বলা হয় পিতৃপক্ষ, যার শেষ দিনটি হলো মহালয়া।

আগেই বলেছি, মহালয়ার পর থেকেই আমাদের দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি পর্ব। মানে, মর্তে সপরিবারে দুর্গার আগমনটা এবার কনফার্ম হলো। অসুরনিধন পর্ব সমাপ্ত। এবার তাই বিজয়োৎসব। সেই বিজয়োৎসবের ভাগীদার শুধু স্বর্গের দেবতারাই নন, মর্তবাসীও তার সমান ভাগীদার। কৈলাসে পতিগৃহ ছেড়ে এই যে দুর্গা বা উমার পিতৃগৃহে আগমন 
– এ তো বিজয়ের আনন্দে। 

সবশেষে বলি, মহালয়ায় দেবীপক্ষে প্রবেশের এই বিশেষ পুণ্যলগ্নের আনন্দঘন ব্রাহ্মমুহূর্তটিকে ধরে রাখতে সেই ১৯৩১ সাল থেকে প্রায় নব্বই বৎসরকাল ধরে বহু স্বনামধন্য সঙ্গীতশিল্পী ও কলাকুশলী সহযোগে মহানশিল্পী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত গলায় রেডিও সম্প্রচারের মাধ্যমে যে চন্ডীপাঠের অনুষ্ঠান - তা আজও মানুষের, বিশেষ করে বাঙালিদের মনে দেবীর আগমনবার্তার আনন্দলহরী জাগিয়ে তোলে। আর কালক্রমে এই অনুষ্ঠান এতখানি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে, আমাদের কাছে মহালয়ার আরেক নামই যেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।

                


Post a Comment

1 Comments

  1. পুরনো কথা নতুন করে আবার জানার মধ্যে একটি আনন্দ থাকে। বিশেষ করে এই ধরনের বিষয়ে। পড়ে ভালো লাগলো।

    ReplyDelete