জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -১১


আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -১১

শ্যা ম ল  জা না

ফভইজম(দ্বিতীয় অংশ)—

এই যে, মাত্র ৫ থেকে ৬ বছরের স্বল্প মেয়াদী ফভইজমকেই শিল্পক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করা হয় কেন ? এর কারণ কিন্তু ঐতিহাসিক ৷ এই জন্য যে, বিশ শতকের শুরুই হচ্ছে আধুনিক চিত্রকলার সূত্রপাতের শীর্ষ সময় ৷ পাশাপাশি, ওই একই সময়ে ঐতিহ্যবাহী নিয়মতান্ত্রিক আকাদেমিক রীতিরও বাড়-বাড়ন্তের সময় ৷ এই দুই পরস্পরবিরোধী ধারণা ও দর্শন   সম-উচ্চতায় একই সময়ে পাশাপাশি অবস্থান করায় ঐতিহাসিকভবে একটি নির্দিষ্ট কন্ডিশন তৈরি হয়েছিল ৷ এ জন্যই, তৎকালীন শক্তিশালী চিত্রশিল্পীদের অধিকাংশই একসাথে একই সময়ে এই “ফভইজম” আন্দোলনে কেন্দ্রীভুত হয়েছিলেন, ৷ তাঁরা এই একই সময়ে এক জায়গায় একসাথে জড়ো হয়ে আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন বলেই এত দিনের জগদ্দল পাথরটা ভাঙতে পেরেছিলেন ৷ আর, এই পাথরটি ভাঙার পর, বা আন্দোলনে সফল হওয়ার পর তাঁদের সামনে আর আদর্শগত তেমন কোনো উদ্দেশ্য থাকল না ! এটাই হল ফভইজম-এর স্বল্প স্থায়িত্বের কারণ ৷
আমার নিজস্ব মতামত হল— এই যে, ১৮৭৪ সালে ইম্প্রেশনিস্টরা ঐতিহ্যবাহী নিয়মতান্ত্রিক আকাদেমিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে প্রথম আঘাত হানল নতুন ধারার তুলির পোঁচকে হাতিয়ার করে, তখন থেকেই শুরু হয়েছিল আধুনিক চিত্রশিল্পের আন্দোলনটি ৷ এবং এটি ছেদহীন ধারাবাহিকভাবে বিবর্তিত হতে হতে, ফভইজম-এ এসে ১৯১০ সালে, ৩৬ বছরের পরিক্রমাশেষে, সফলভাবে সমাপ্ত হল ৷ এবং দেখা গেল তুলির পোঁচ নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষারও অবসান ঘটল ৷ অর্থাৎ, একে আমরা বলতে পারি আধুনিক চিত্রশিল্পের একটি অখণ্ড ও পথিকৃত আন্দোলন, যা তুলির পোঁচকে হাতিয়ার করে ৩৬ বছর ধরে ঘটেছিল, এবং এর ভেতরে বহু বা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইজম-এর জন্ম হয়েছিল এই কারণেই ৷ যার শেষতম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইজমটির নাম হল— ফভইজম ৷ কারণ, ছবিতে, প্রকৃতিকে অনুকরণ করার যত রকম বাধ্যবাধকতা ছিল, সবকটি থেকে সৃষ্টিশীল মানসিকতাকে মুক্ত করেছিল এই ফভইজম(ছবি-১)। 

আবার এটাও ঠিক, যে, হঠাৎ করে ফভইজম গড়ে উঠল, আর, তাঁরা এই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটিয়ে ফেললেন, তা একেবারেই নয় ! ৩৬ বছর ধরে আধুনিক চিত্রশিল্পের আন্দোলনটি সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী শিল্পীদের মেধা ত্যাগ মদত সাহচর্য পেতে পেতে ক্রমশ পুষ্টিলাভ করতে করতে ধাপে ধাপে একটার পর একটা ইজম-এর জন্ম দিতে দিতে এই ফভইজম-এ এসে চূড়ান্ত রুপ পায় ৷ তাই, এই ফভইজম-এর সাফল্য আসলে আধুনিক চিত্রশিল্প আন্দোলনের ছেদহনি পরিক্রমার সাফল্য ৷ বিশেষ করে, জর্জেস স্যুরা, পল সেজান, ভিনসেন্ট ভ্যান গখ, পল গগ্যাঁর মতো প্রবাদপ্রতিম শিল্পীরা তাঁদের মেধা দিয়ে দীর্ঘ দিনের প্রচলিত রীতি-নীতিকে ভেঙে তছনছ করে অভিনব উদ্ভাবনীর স্বাক্ষর রেখেছিলেন বলেই, তাঁদের অনুসরণ করেছিল বলেই, ফভিস্টরা এত শক্তিশালী! বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় ভ্যান গখ ও পল গগ্যাঁর কথা ৷ দুঃসাসিক তুলির পোঁচ ও মৌলিক চড়া রঙের প্রয়োগ কিন্তু এঁরাই প্রথম করেন ৷ ফভিস্টরা এঁদেরই অনুসরণ করেছিলেন আরও দুঃসাহসিকভাবে ৷ এখানে উদাহরণ হিসেবে একটি ঘটনা আপনিই চলে আসে ৷ আমরা পর্ব-৯ শুরু করেছিলাম “দ্য নবিস”-এর প্রতিষ্ঠাতা শিল্পী সেরুসিয়ের-এর একটি ঘটনা থেকে ৷
পল সেরুসিয়ের ১৮৮৮ সালে একবার পন্ত অ্যাঁভে স্কুলে গিয়েছিলেন ৷ ওখানে পল গগ্যাঁর ঘনিষ্ট তত্ত্বাবধানে(Guidance) তিনি বন্দরের একটি অদ্ভুত ছবি এঁকেছিলেন ৷ ছবিটির নাম— “দ্য তালিস্মান” (পর্ব-৯, ছবি-১)৷ এই ছবিটি থেকেই “দ্য নবিস”-এর যাত্রা শুরু হয় ৷ এই ছবিটি আঁকার সময়ে পল গগ্যাঁ সেরুসিয়েরকে কীভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তার সামান্য একটুখানি এখানে তুলে ধরলাম ৷ “দূরের ওই গাছগুলোকে তুমি কীভাবে দেখছো ? না, ওইভাবে অত ডিটেলে নয়, সামগ্রিকভাবে কী দেখছো বলো ৷ কী, হলুদ তো ? তাহলে কোনো ডিটেল নয়, যতটুকু অংশ হলুদ দেখতে পাচ্ছো, ততটুকু শুধু হলুদ রং লেপে দাও ৷ পাশে ছায়ার অংশটা দ্যাখো ৷ ওটা বরং নীল ৷ পিওর আলট্রামেরিন ব্লু দিয়ে ছায়াটা করো ৷ আর, ওই যে লাল পাতাগুলো দেখছো ? যতটা অংশ আছে, পুরোটা ভারমিলিয়ন রেড করে দাও ৷” এই যে ছবির এক-একটি অংশ তুলির আঁচড়ে শুধুমাত্র মৌলিক রং দিয়ে ভরে দেওয়ার দুঃসাহসিকতা, গগ্যাঁ নিজে তো দেখিয়েছেনই, বিশেষ করে শেষ বয়েসে যখন তাহিতি দ্বীপে থাকতেন, আর পরবর্তী প্রজন্মের মানসিকতাতেও ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন ওই দুঃসাহসিকতা ৷ ভ্যান গখ-এর ওই জোরালো তুলির আঁচড়, পল গগ্যাঁর ডিটেলে না গিয়ে চড়া মৌলিক রংকে সরাসরি ক্যানভাসে তুলির আঁচড়ে প্রয়োগ করা... ... এ সবের ভেতরেই পরবর্তীকালের “ফভইজম” ও “অ্যাবস্ট্রাক্ট” আর্টের বীজ বপন হয়ে গেছিল ৷
আরও একটা কথা না বললেই নয় ৷ এই যে প্রায় চল্লিশ বছর ধরে ক্যানভাসে তুলির আঁচড়, মৌলিক রঙের সরাসরি প্রয়োগ, ছবির সরলীকরণ ইত্যাদি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো গুরুত্বই ছিল না তৎকালীন সমাজে ৷ গোঁড়া(Orthodox) আকাদেমিশিয়ানদেরই ছিল জয়জয়কার ৷ একমাত্র তারাঁই শিল্পী হিসেবে গুরুত্ব পেতেন ৷ তাঁদের ছবিই সবচেয়ে বেশি দামে স্যাঁলো থেকে বিক্রী হত ৷ স্যুরা, সেজান, ভ্যান গখ, গগ্যাঁদের এত নতুন নতুন ভাবনা-চিন্তা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এত কিছু অবদান থাকা সত্বেও তাঁদের গুরুত্ব দেওয়া তো দূরের কথা, চিনতই না তাঁদের কেউ ৷ তাঁরা ছিলেন অবজ্ঞার শিকার ৷ কিন্তু তিরিশ বছরের অধিক পরিক্রমাশেষে এই ফভিস্টদের চড়া রঙে আঁকা ছবিগুলি কিন্তু গুরুত্ব পেতে শুরু করল ৷ দর্শক, সমালোচক, ডিলাররা, ফভিস্টদের ছবির প্রতি উৎসাহ দেখাল ৷ বাজারে চাহিদা তৈরি হল।  অথচ, তিন-চার বছর যেতে না যেতেই, এই সাফল্যের মুখে অধিকাংশ শিল্পীই “ফভ” ত্যাগ করেন ৷ থেকে যান একমাত্র হোতা মাতিস ৷      
      (ক্রমশ)

Post a Comment

3 Comments

  1. ফ্যাভিস্টদের সৃষ্টি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অ্যাবস্ট্রাকট আর্ট পর্যন্ত পৌঁছনোর ৩৬ বছরের ইতিহাস
    পরিক্রমা ঝলমল করছে।কত
    অজানাকে যে পাঠক ও আগ্রহী
    মানুষ জানছেন,তা অবিশ্বাস্য।
    আবারও বলি ছবির জগত সম্পর্কে এক্কেবারে কিচ্ছু না জানা আমিও
    যেন মোহাবিষ্ট হয়ে পাঠ করছি।
    আর অপেক্ষা করছি পরের কিস্তির
    জন্য। এটাই এই রচনার সার্থকতা।
    সাবাশ!

    ReplyDelete
  2. অত্যন্ত মনোগ্রাহী ও গুরুত্বপূর্ণ রচনা, প্রতিটি পর্বের জন্য অপেক্ষা করে থাকি/ পার্থপ্রতিম আচার্য

    ReplyDelete
  3. অত্যন্ত মনোগ্রাহী ও গুরুত্বপূর্ণ রচনা, প্রতিটি পর্বের জন্য অপেক্ষা করে থাকি/ পার্থপ্রতিম আচার্য

    ReplyDelete