জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস- ১২ / শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -১২

শ্যা ম ল  জা না

এক্সপ্রেশনিজম—

একজন চিত্রকর যখন ছবি আঁকেন, তখন দুটি বিষয় কাজ করে ৷ এক— ছবির দর্শনগত দিক ৷ দুই— ছবি আঁকার প্রকরণ-পদ্ধতির দিক ৷ ইম্প্রেশনিজম-এর সূত্রপাত হওয়ার পর থেকে ছত্রিশ বছর অতিক্রম করে ফভইজম পর্যন্ত, আমরা একটু লক্ষ করলে বুঝতে পারব— মতবিরোধের বেশিরভাগটা ছিল—“কী আঁকব”-র চেয়ে শিল্পীরা একটু বেশি জোর দিয়েছিলেন, “কীভাবে আঁকব”, তার ওপর ৷ অর্থাৎ, তাঁদের দৃষ্টিকোণ সাবজেক্টিভ-এর তুলনায় একটু বেশি ছিল অবজেক্টিভ ৷ এক্সপ্রেশনিজম ঠিক এই জায়গাটায় আঘাত হানল ৷ কীভাবে ? এটা বলার আগে, আমরা একটি অন্য আলোচনা সেরে নেব ৷
পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে দেখা গেল, তারা কেউই একা বাস করছে না ৷ তারা একসঙ্গে অনেকে মিলে বাস করছে ৷ বিশেষ করে মানুষের ক্ষেত্রে ৷ প্রথমে গোষ্ঠী, পরে সমাজ ৷ এই যে এরা একসঙ্গে থাকছে ৷ এই একসঙ্গে থাকা তখনই সম্ভব হয়, যখন একজন আর একজনকে বুঝতে পারে ৷ তাই, প্রকৃতিগতভাবেই একজন মানুষ কিছু আচরণ-সংকেত নিয়েই জন্মায় ৷ যাকে এক কথায় বলে অভিব্যক্তি(Expression)৷ ধরা যাক— কেউ একজন শারীরিক বা মানসিকভাবে খুব আঘাত পেয়েছে ৷ তখন, সে কাঁদলে, তার চোখ দিয়ে জল পড়ে ৷ তখন আমরা তার অভিব্যক্তি ও চোখের জল দেখে বুঝতে পারি সে খুব দুঃখ পেয়েছে ৷ একে আমরা বলি— Natural Communication বা অভিব্যক্তি(Expression)৷ শুধু দুঃখ নয়, রাগ, অভিমান, দুশ্চিন্তা, আনন্দ, ব্যথা, বিষণ্ণতা ইত্যাদি যত রকমের অনুভূতি আছে, প্রতিটির এক-একটি নিজস্ব অভিব্যক্তি আছে, যেটা দেখে আমরা সহজে অনুমান করতে পারি, কোনো মানুষের সেই সমযের মানসিক (কিছু কিছু ক্ষেত্রে শারীরিকও বটে)অবস্থা কী রকম ৷ এই অভিব্যক্তি শিখে অর্জন করা যায় না ৷ প্রকৃতিগতভাবে প্রতিটি মানুষই এই যোগ্যতা নিয়ে জন্মায় ৷
ইম্প্রেশেনিস্টরা সূর্যের আলো-ছায়া সময় অনুযায়ী ধরতে গিয়ে ক্যানভাসে বেছে নিয়েছিলেন মূলত প্রাকৃতিক দৃশ্য ৷ গাছপালা, বাড়িঘর, নদী, সমুদ্র, এইসব ৷ তাতে কোনো মানুষ বা প্রাণী থাকলেও তারা ছিল গৌন ৷ এক্সপ্রেশনিস্টরা সরাসরি এর বিরোধিতা করল ৷ শুধু তাইই নয়, এরা প্রাচীনপন্থী “অ্যাকাডেমিক আর্ট”-এর গোঁড়ামীরও বিরোধিতা করল ৷
আপনারা জানেন, ঠিক যখন বিশ শতক শুরু হচ্ছে, সারা পৃথিবীতে তখন আধুনিকতার পাশাপাশি শোষণেরও পাকাপাকি ব্যবস্থা শুরু হচ্ছে ৷ আর, বিশৃংঙ্খলায় ভরে গেছিল বিশ্ব ! সারা পৃথিবী জুড়ে মানবতার সংকট দেখা দিয়েছিল ৷ দেশে দেশে মানুষে মানুষে বিভিন্ন ধরনের বিবাদ ক্রমশ বাড়ছিল ৷ সেই সঙ্গে দ্রুত বিস্তার লাভ করছিল সততা ও মনের বিশুদ্ধতার(Spirituality) সংকট ৷ তৈরি হচ্ছিল যুদ্ধ পরিস্থিতি ৷ ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা ভীষণভাবে বেড়ে যাচ্ছিল ! ঠিক এই সময়েই ঐতিহাসিক কারণেই পরিস্থিতি (Condition) জন্ম দিল এক্সপ্রেশনিজম-এর ৷ তাই, জার্মানি থেকে শুরু হলেও, একই সঙ্গে ইয়োরোপের বিভিন্ন শহর থেকে মাথা তুলে দাঁড়াল এক্সপ্রেশনিজম ! এই এক্সপ্রেশনিজম-এর পূর্বসূরি হল সিম্বলিজম ৷ সিম্বলিজম-এর দ্বারা সাংঘাতিকভাবে অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত ছিল এই এক্সপ্রেশনিজম ৷ আমরা পর্ব-৭-এ সিম্বলিজম নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি ৷ তাই, এখানে তার পুনরাবৃত্তি করলাম না ৷ দ্বিতীয়ত— পর্ব-৪-এ “পোস্ট ইম্প্রেশেনিজম ও তার জন্ম”— এই শিরোনামে যে লেখাটি ছিল, তাতে কয়েকজন চিত্রশিল্পীর ইম্প্রেশেনিজম-বিরোধী কয়েকটি উক্তির ব্যবহার ছিল ৷ তার থেকে তিন জনের তিনিটি উক্তি এখানে আবার পেশ করলাম ৷ সেগুলি হল— 
এডভার্ড মুঙ্খ বললেন— প্রকৃতির সব কিছুই কিন্তু চোখে দেখা যায় না ৷ আমাদের আত্মার ভেতরেও ছবি তৈরি হয়, সেটাও প্রকৃতি ৷
পল গঁগ্যা বললেন— আমার যখন দেখতে ইচ্ছে করে, দেখার জন্য আমি চোখ বন্ধ করি ৷
ভিনসেন্ট ভ্যান গখ বললেন— আমি ছবির স্বপ্ন দেখি এবং আমার স্বপ্নের ছবি আঁকি ৷
এই তিন জনের তিনটি উক্তিই কিন্তু সেদিন অদৃশ্যভাবে সবার অজান্তে এক্সপ্রেশনিজম-এর বীজ বপন করেছিল ৷ সেটা ছিল উনিশ শতকের শেষের দিক ৷ প্রায় তিন দশক পেরিয়ে বিশ শতকের গোড়ায় এসে এই তিন জনই এক্সপ্রেশনিজম-এর জন্ম দিলেন।  যদিও এঁদের সঙ্গে আরও কেউ কেউ ছিলেন, বিশেষ করে জেমস এনসোর-এর নাম না বললেই নয় ৷ ফলে, এই তিনজন এতদিন ধরে বিভিন্ন ইজম-এর ভেতর দিয়ে ছবি আঁকার যে পদ্ধতি-প্রকরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলি করে এসেছিলেন, যেমন— যে বস্তু দৃশ্যত যেরকম দেখা যায়, তাকে সরলীকরণ করার জন্য বিকৃত করা, স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট তুলির আঁচড়, চড়া রং ইত্যাদি স্বাভাবিকভাবেই বজায় থাকল ৷ কিন্তু, তাঁরা এই পদ্ধতি-প্রকরণের সাহায্যে যে ছবিগুলি আঁকলেন, সেগুলি দর্শনগত দিক থেকে ছবিতে যুক্ত করল এক নতুন কনসেপ্ট (ছবি-১)। 

 অবজেক্টিভ থেকে সাবজেক্টিভ হল ছবির বিষয় ৷ মানুষের আত্মা থেকে উৎসারিত হয় যে অনুভূতির প্রকাশ, বিশেষ করে তৎকালীন সময়ের মানবতার যে সংকট, তার থেকে উৎপন্ন যে উদ্বেগ, দুঃশ্চিন্তা, ভয়, চিৎকার ; বা চরম লিপ্সা বা আকূল আকাঙ্ক্ষা, এই অভিব্যক্তিগুলিই(Expressions) তাঁরা যুক্ত করলেন মনুষ্যশরীরে(ওপরের ছবি)৷
জন্ম নিল আর একটি নতুন ইজম— এক্সপ্রেশনিজম ৷ যার শীর্ষ সময় হল— ১৯০৫ থেকে ১৯২০ সাল ৷ আর অন্য ইজম-এর থেকে এটি স্বতন্ত্র এই কারণে, যে, সেই সময়ের ইয়োরোপের সাধারণ মানুষ একে সর্বান্তকরণে গ্রহণ করেছিলেন ৷ কারণ, তাঁরা স্পষ্ট বুঝেছিলেন— এই চিত্রশিল্পীরা তাদের সংকটের কথাই ক্যানভাসে তুলে ধরছে ৷ আর সেই জন্যই এটি দ্রুত সারা ইয়োরোপে ছড়িয়ে গেছিল শুধু নয়, পরবর্তীকালে এর দ্বারা সাংঘাতিকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল বহু বিশ্ববন্দিত চিত্রশিল্পী, এবং এর প্রভাবে সৃষ্টি হয়েছিল বহু গুরুত্বপূর্ণ ইজম-এর ৷ যেমন— অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম, নিও এক্সপ্রেশনিজম, দ্য স্কুল অফ লন্ডন ইত্যাদি ৷                                                   (ক্রমশ)

Post a Comment

1 Comments

  1. এক্সপ্রেশনিজম এর পর্যায়টিও চমৎকার। কিভাবে নানা পর্যায় অতিক্রম করে অবজেক্টিভ থেকে
    সাবজেক্টিভ হয়ে উঠে ছবি মানবিক
    অনুভূতি ও আবেদনের বিষয় হয়ে
    এক্সপ্রেশনিজম-এর জন্ম দিচ্ছে,তা
    সাবলীল কলমে বিধৃত।ধন্যবাদ।

    ReplyDelete