জ্বলদর্চি

আজ,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন

সন্দীপ কাঞ্জিলাল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়,শ্যামলকান্তি দাশ     

আজ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন   

তিনি ছিলেন এক বিদ্রোহী 

স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল

'এসেছি জলের কাছে পীড়িত খরার দেশ থেকে।'-- বীতশোক ভট্টাচার্য। 

'চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয় ' সেই অবিস্মরণীয় পঙক্তি এখনো শূন্য থেকে ভেসে এসে কানে বাজে। হাজার চেষ্টা করেও এ লাইন ভুলে থাকা যায় না। 'চে' মারা গেছে তার জন্য আমি অপরাধী হবো কেন? আমি তো তাকে মেরে ফেলিনি। তাহলে আমার অপরাধ কোথায়? অপরাধ অবশ্যই আছে। তাকে মেরেছে মানুষ! যে মানুষের অংশ আমি! তাই তিনি লজ্জা পেয়েছিলেন। কারণ তিনি সব চাইতে বেশি জোর দিতেন সততার ওপরে। নিজের কাছে সৎ হতে হবে অনুভবে, চিন্তায়, বিশ্বাসে, লেখায়,আচরণে। সমগ্র মানব সমাজ এক নৈতিকতায় বাঁধা এটাই ছিল তাঁর আদর্শ। তাই তাঁর লেখায় বা জীবনে কোনও অস্পষ্টতা ছিল না। তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা -- ন্যায় ও সাম্যের পক্ষে। যে সম্পর্ক, নীতি নিয়ম, আচার আচরণ স্বাধীনতাকে সঙ্কুচিত করে, যা অত্যাচার ও শোষণের সহায়ক, যা বেশির ভাগ মানুষকে বঞ্চিত করে, অল্প মানুষকে স্বাচ্ছন্দ্য দেয়, তার বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি। আর তাই নিয়ে লড়াই ছিল 'চে গুয়েভারার'। তাই তিনি তাঁকে রক্ষা করতে পারেননি, বাঁচাতে পারেননি, তার ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি তাঁর সহযাত্রী হতে পারেননি। সেই দুঃখ চিরকাল তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে৷ তাই তো তিনি লিখলেন 'চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।'  কবিতা কার জন্য? বইয়ের (২০১২) তৃতীয় সাক্ষাৎকারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, "পৃথিবীর যাবতীয় কবি, যাঁরা নিপীড়িত, তাদের হয়েও প্রতিশোধ নিতে এক কবি হিসেবে আমার উঠে দাঁড়ানো। জীবনানন্দ যাদের সম্বন্ধে বলেছিলেন, 'শ্লেষ্মারক্তে মাখামাখি ' সেইসব কবিদের যন্ত্রণা-অবহেলার প্রতিশোধ নেবে পরবর্তী কবিরাই।'
তিনি ছিলেন অসামান্য মানুষ!  শ্রেষ্ঠ হৃদয়বান, শান্ত, সুস্থিত, প্রাণবন্ত। সেলাম জানাতে হয় তাঁর নিরপেক্ষতাকে। সমস্ত প্রকার কুসংস্কার, অনুশাসনের ধুলাঘর ভেঙ্গে তছনছ করে দিয়েছেন সংসারের প্রবীণের মতো। তবে তাকে বিদ্রোহী, rebel, বলা ছাড়া আর আমার উপায় থাকে না। এক সাক্ষাৎকারে উনাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আপনার এই সুবিদিত ভদ্রতাবোধ কি করে সম্ভব হল? উনি বললেন "আলেকজান্ডারকেও এই প্রশ্ন করা হয়েছিল, আলেকজান্ডার বলেছিলেন, অসভ্যদের দেখে আমি মনে মনে স্থির করেছিলাম, আমি ওদের মতো হবো না।"
সম্ভবত তিনি জীবনের শেষ সংবর্ধনা পেয়েছিলেন "পিণাক" পত্রিকা থেকে। তখন পত্রিকাটি নিয়মিত বেরুতো। পত্রিকাসম্পাদক হিসাবে আমি তুলে দিয়েছিলাম তাঁর হাতে সম্মান, এক আলোকোজ্জ্বল সন্ধ্যায় বাংলা একাডেমির সভাঘরে ২০১২ সালে জুন মাসে। আমি তাঁর বাড়িতে যেতাম। অবশ্য শুরু হয়েছিল শ্রদ্ধেয় কবি 'শ্যামলকান্তি দাশ' এর অকুণ্ঠ ভালোবাসায়। উনি না থাকলে হয়তো আমার সঙ্গে যোগাযোগই হতো না। যেদিন অনুষ্ঠান ছিল, বৌদি স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় এবং কবিকে তাঁর বাড়ি থেকে গাড়ি করে নিয়ে এসেছিলাম, তখন সঙ্গে ছিল আর এক শ্রদ্ধেয় কবি স্বর্গগত 'কার্তিক মোদক'। স্পষ্ট মনে আছে তিনি মঞ্চে উঠে বসার আগে, হাত জোড় করে, ঘাড়টা ঈষৎ বেঁকিয়ে বললেন, "এখানে উপস্থিত সবাইকে আমি প্রণাম জানাচ্ছি।" সেখানে যত জন বয়সে কি সম্মানে ছোট কি বড়ো, কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে প্রণাম জানিয়েছিলেন। দর্শক ভর্তি হলঘরে এ দৃশ্য দেখে নির্বাক নিস্তব্ধ। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে আমি গাড়ি করে একা গিয়েছিলাম ছাড়তে। গাড়িতে বসে বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার সংসার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। 
একটা কথা আজও মনে আছে, "শোনো কবিতার ওপর জোর খাটাবে না। কবিতা একদম পছন্দ করে না। যখন দেখছো কিছু লাইন লেখার পর আর কবিতাটা আসছে না ফেলে রাখো, কিছুদিন পরে আবার ওটাকে নামিয়ে চেষ্টা করো দেখবে হয়তো হয়ে গেছে।" কথাগুলো বলেছিলেন একদম ঘরোয়া ভাবে, কোনো পাণ্ডিত্য ভাব তাঁর মধ্যে ছিল না। সবশেষে বলেছিলেন, পুজোর পর দীঘা এলে আমার বাড়িতে ফেরার পথে দু'একদিন থাকবেন। সে আর হয়ে উঠেনি। আসলে উনি তো বলেছেন "কেউ কথা রাখেনি"। তাছাড়া উনি জানতেন এই পৃথিবীতে কোনও কিছু চিরসত্য নয়। 'আমি কীরকম বেঁচে আছি' কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় এক মারাত্মক কথা লিখেছিলেন। "আমি কবিতায় সত্য কথা লিখতে গিয়ে দেখেছি, কবিতার সত্য প্রতি মুহূর্তে বদলে যায়।' আবার অন্য জায়গায় অনেকটা এইভাবে বলেছেন, বয়স বাড়লে বোঝা যায়, কবিতা লেখাটা ছেলেখেলা নয়, তখন ভয় করে। যেন একটু ভুল হলেই আঙুল ঝলসে যাবে বা তুষার ক্ষত হবে। এক জায়গায় লিখেছিলেন, কবিতা ব্রহ্মেরই মতন অনুচ্ছিষ্ট।
তার জন্ম বাংলা মতে ২১শে ভাদ্র, ৬ই সেপ্টেম্বর। আর জন্মদিন পালিত হয় ইংরেজি মতে ৭ তারিখ। তাই আজ তার জন্মদিন। উনার কম বয়সে লেখা কবিতা 'স্বপ্ন একুশে ভাদ্র' এক অসামান্য কবিতা। তার একটি লাইন আজও কানে বাজে, " পথেই নামলুম, কেননা 'পথিক' এই সুন্দর শব্দটি বড়ই রোমাঞ্চকর।" আর শতায়ু কামনা করবো না। আজকে তার পা ছুঁয়ে প্রণাম করছি আমাদের ভেতর দিয়ে নিরন্তর বয়ে যাবে তাঁর বাকি, "অর্ধেক জীবন।"


Post a Comment

1 Comments

  1. খুব সুন্দর লেখা। কবি লেখক সুনীলের ভক্ত সবাই। শ্রদ্ধা জানাই তাঁকে।

    ReplyDelete