জ্বলদর্চি

মল্লিকা বাসন্তী রাও / গৌতম বাড়ই


ফোটোগ্রাফি - সৈয়দ স্নেহাংশু  

মল্লিকা বাসন্তী রাও


গৌ ত ম  বা ড় ই

মাউন্ট হ্যারিয়েট এর সূর্য বিধ্বস্ত সবুজ শিখর তলে
আন্দামানের সুনীল সাগরে
রূপকথার লাইট হাউস যেখানে, 
মায়াবী আলো ফেলে রাতের কালাপাণিতে।
সুনামির মহা প্রলয়ের অনেক অনেক আগে,
দিকচক্রবাল রেখায় বিন্দী টিপের মতন
অস্তায়মান সূর্য ,তোমাকে আজও মনে পড়ে,
মল্লিকা বাসন্তী রাও।
গলা ছেড়ে এখনো কি পল রোবসন গাও?
রস্ আইল্যান্ড এখনো রসাতলে যায়নি,
বুঝিবা গেছে কিছু কিছু।
চিড়িয়াটাপ্পুর সেই নির্জন বন জঙ্গল আদিম
পাহাড়ে সাগরের প্রান্তে----
তুমি মানুষকে ভালবেসে কাজ করতে মানুষের।

প্রচার মাধ্যম ছিল নাম কা ওয়াস্তে 
ছিল না যোগাযোগের এই অভূতপূর্ব সাফল্যের
অন্তর্জাল বিপ্লব।
ছিল শুধু নিষ্ঠা সহকারে মানুষকে ভালবেসে
যাওয়া কিছু কিছু নিবেদিত প্রাণ।
মল্লিকা বাসন্তী রাও তাদেরই একজন।

কি তাদের দোষ? জানেনা  কিছুই
এক মানুষজন্মে ভিটে মাটি বাস্তুচূত বারবার।
কাদের আঙ্গুলের ঈশারায় পাল্টে যায় 
চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটির দেশ 
এ পৃথিবীটা কবে সবারই নিরাপদ দেশ হবে?
সাগরের জঙ্গল ঘেরা গ্রামে বসতি তাদের
তার মাঝে কঠিন স্বপ্ন দেখে বারবার বাঁচবার।
মল্লিকা বাসন্তী রাও তাদেরই  
আলোর পথের দিশারী তখন। সরকারী মাধ্যমগুলো আজকের মতন 
এতটা প্রচার মূলক নয়
ওটা ছিলো প্রাক দূরদর্শন যুগ।

সে ছিলো তাদের মাদার টেরিজা। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল আরও কত কি!
মায়াবন্দর, বাম্বুফ্ল্যাট,ডিগলীপুর ঘুরে ঘুরে 
যখন আমি ক্লান্ত শ্রান্ত।তখন বোঝানো হতো
কালকে আমাদের করণীয় কী?কী?
তার ছিলো অফুরন্ত জীবনীশক্তি।

সেলুলার জেল তখন অবারিত দ্বার, বারবার সুযোগ পেলে দাঁড়াতাম বীর সাভারকার এর বন্দী কুঠুরি আর ফাঁসি ঘরে।সুনীল সাগরে চেয়ে  চেয়ে
দুরে সমুদ্র পারে নিশ্চিহ্ন হতে যাওয়া 
রস আইল্যান্ড এর নাচ ঘরের ঝলকানি শুনতাম কান পেতে।

------ কি এতো ভাবেন বলুন তো? বাঙালীরা বড্ডো ভাববিলাসী হয় ।সাগর সৌন্দর্য তো অনেক দেখেছেন,দেখবেন আরো কত শত!

সমুদ্র নীল শাড়ি আর সাদা স্লীভলেসে, দূরন্ত ঘূর্ণির সেই সিন্ধুপারে মায়াবী জগতে
উড়ন্ত এলোমেলো চুলে আর এক বঙ্গোপসাগর
দাঁড়িয়ে সামনে আমার। অপরূপা তার দীপ্তিতে। সৌন্দর্যে! দৃষ্টি ঘোরালাম।
------- না,না,আমাকে দেখুন।নারীর রূপের তারিফ করতেই হয়।না হলে পুরুষ জন্ম বৃথা!এক সমুদ্র দুরেই থাকনা।এক সমুদ্র কাছে।

জাপানী বাঙ্কারগুলো তখনো অক্ষত
দিলথামান ট্যাঙ্কের কাছে।
মল্লিকা বাসন্তী রাও আমায় প্রশ্ন করেছিলেন,
জারোয়া,সেন্টীনেলীরা এখনও অসভ্য 
না আমরা কতটা সভ্য?
উত্তর খুঁজে পাইনি। জাপানী বাঙ্কারতলে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে যাচ্ছে, হিরোশিমা আর নাগাসাকির কথা। টেকনোলজি আর বিজ্ঞান এগোলেও, মানবিক সভ্যতা এক লহমায় হাজার বছর পেছনে।
মল্লিকা বাসন্তী রাও,দুর্মর,দূর্জয়,গুটিকতক হয়।
নারীশক্তির  কৃত সংকল্পে অশ্বশক্তি ও হার মানে বারবার।
নারী নির্বাসিত হয়, শুধু নারীর জন্যে একগাদা
নিয়মাবলী বিধিনিষেধের যোগাড়।

আন্দামানের সুনীল সাগর
মল্লিকা বাসন্তী  রাও
উড়ুক্কু মাছ ডলফিন
হ্যারিয়েট পাহাড়ের সেই রূপকথার লাইট হাউস
সব ছেড়েছুড়ে একদিন মেইনল্যান্ডে ফেরা।

আমার কিছু কিছু নিজস্ব জীবনের দায়বদ্ধতার কাছে। চাথ্থাম জেটীতে আন্দামান জাহাজে
তুলে দিতে এসেছিলেন।
---এই চাথ্থাম নিয়ে ভূগোলে পড়ো। অস্ফুট কন্ঠস্বর।
তখন তো গুগল্ আসেনি। সবজান্তা হয়ে উঠিনি 
এত কেউ।

-----যদি ভালোলাগে, ঈশ্বরের মতন ভালোবাসতে পারবে নিশ্চয় পৃথিবীর মানুষগুলোকে।তবে এসো আবার সুনীল সাগরের সবুজদ্বীপে।বৃহতের সাথে মেলাতে নিজের ক্ষুদ্রকে বিসর্জন দিতেই হয়।
ভেঁপু ছেড়ে জাহাজ ধীরে ধীরে দূরত্ব তৈরী
করে বন্দরের সাথে।
অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে 
মল্লিকা বাসন্তী রাও।
সেই সমুদ্র নীল শাড়ি পরনে।এক সময় ক্রমাগত ক্ষীণ চোখ মুখ অবয়ব অদৃশ্য।

তারপর কিছুদিন চিঠিপত্রে যোগাযোগ
আছে সময়ের স্রোত।সুর তুলে কেটে গেছে তার।
ধূলি ধূসরিত এককোণে  দাঁড়িয়ে ছিন্ন বীণাও। আমার গভীর সমুদ্রে এখনো দাঁড়িয়ে 
মল্লিকা বাসন্তী রাও। 
ফোটোগ্রাফি - সৈয়দ স্নেহাংশু  

Post a Comment

0 Comments