জ্বলদর্চি

রঙ/ জ য় তী ধ র পা ল

   ফোটোগ্রাফি- সৈয়দ স্নেহাংশু   


রঙ

জ য় তী  ধ র  পা ল


তন্ময় হয়ে রঙমাখা তুলিটা নিয়ে কাজ করছিলেন সত্তর বছরের বৃদ্ধ গোবিন্দ পাল , দুর্গামূর্তির অঙ্গে রঙ লাগাচ্ছিলেন। এই কুমোরটুলি পাড়ায় সবাই একডাকে চেনে মৃৎশিল্পী গোবিন্দ পালকে। তাঁর তৈরি প্রতিমা নিতে হলে এক বছর আগে থেকে বায়না করতে হয়। রাজ্য সরকার তাঁকে শ্রেষ্ঠ মৃৎশিল্পীর সম্মান দিয়েছেন। অনেক পুরস্কার আর সম্মানে ভরা তাঁর জীবন। তাঁর বাবাও ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিখ্যাত মৃৎশিল্পী গোকুল পাল । প্রথমদিকে কুমোরটুলি পাড়ায় গোবিন্দ পরিচিত হয়েছিলেন গোপালের উত্তরাধিকারী হিসেবে। কিন্তু গোবিন্দর কাজে ক্রমশ যে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠতে লাগলো , সেই স্বকীয়তার শিক্ষাগুরু ছিলেন তার মা মৃন্ময়ী। গোপালের এই শিল্পে হাতেখড়ি হয়েছিল সবার চোখের আড়ালে তার মা'র কাছে । ছোটবেলায় ছেলের খেলার জন্য মাটি দিয়ে ছোট ছোট পুতুল... জোকার সৈনিক সারদা রামকৃষ্ণ বানাতেন মৃন্ময়ী। মা'র তৈরি সেই মাটির পুতুলগুলো দেখে মনে হতো এক্ষুনি যেন কথা বলে উঠবে , এত জীবন্ত হতো সেগুলো। মাটির দলায় ওরকম প্রাণ প্রতিষ্ঠার শিল্প আজ অব্দি আর কোথাও দেখেননি গোবিন্দ পাল। তাঁর তৈরি দেবীমূর্তির মধ্যে ভক্ত জীবন্ত মা'কে খুঁজে পায় ... স্নেহঝরা দুই নয়ন ... ঠোঁটের মধুর হাসি ... সব যেন সত্যি ... কিছুক্ষণের জন্য ভ্রম হয় ভক্তমনে ... এই মা মৃন্ময়ী নাকি চিন্ময়ী ! মাটির মূর্তির মধ্যে এই প্রাণ প্রতিষ্ঠার মন্ত্র তো তাকে শিখিয়েছেন তাঁর গর্ভধারিণী।

অথচ তাঁর এই আশ্চর্য প্রতিভাময়ী মা'কে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সবার চোখের সামনে গুরুদক্ষিণা দিয়ে সম্মান জানাতে পারলেন না। মৃন্ময়ীর গাত্রবর্ণ ছিল ঘোরকৃষ্ণ। শুধু এই জন্য এত গুণের অধিকারী তাঁর মা'কে চিরকাল সংসারে সকলের অবহেলা আর অবজ্ঞার পাত্রী হয়ে থাকতে হয়েছে। কালো মেয়ে মৃন্ময়ীর বাবা টাকার জোরে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন গোকুল পালের সঙ্গে। কিন্তু টাকার আলোয় গায়ের কালো ঢাকলো না । বিয়ের কিছুদিন পরেই মৃন্ময়ীর কালো রূপ সবার চোখের সামনে থাকলো, তার বাবার টাকাটা আড়ালে চলে গেল। উঠতে-বসতে গায়ের রঙ নিয়ে ব্যঙ্গ শুনতে শুনতে মৃন্ময়ী নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। গোকুল পালও কোন অনুষ্ঠানে সস্ত্রীক যেতেন না । লোকচক্ষুর আড়ালে তিনি রাখলেন স্ত্রীকে, স্ত্রীর প্রতিভাকে। মৃন্ময়ীর হয়ে কথা বলার,  প্রতিবাদ করার কেউ ছিল না। গোবিন্দ যখন কৈশোর ছেড়ে যৌবনে দিকে এগোচ্ছেন , নিজস্ব মতামত প্রতিবাদী সত্তা তৈরি হচ্ছে, যখন তিনি তাঁর শিক্ষাগুরু পরমবন্ধু গর্ভধারিণীর যথাযোগ্য সম্মানের জন্য কথা বলতে শুরু করলেন ... সেই সময় মৃন্ময়ী এই নশ্বর পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অনন্তলোকে যাত্রা করলেন। মাতৃহারা পনের বছরের গোবিন্দ তাঁর কালো মায়ের অপমানের জ্বালা বুকে নিয়ে ধীরে ধীরে বড় হলেন।

দুর্গামূর্তি রঙ করতে করতে বড্ড আনমনা হয়ে পড়েছিলেন গোবিন্দ পাল। সচেতন হয়ে চমকে উঠলেন,  এ কি করেছেন তিনি ! দুর্গা মা'কে কালো রঙে রাঙিয়ে তুলেছেন ! নিজের অজান্তে কখন তিনি গৌরীকে শ্যামা করে দিলেন ! এবার কি হবে ? একটি বড় বারোয়ারি পুজো নির্মাল্য সংগঠনের জন্য তিনি এই মাতৃপ্রতিমা করছেন। আর এই সংগঠন পুরোপুরি সাবেকি ধাঁচের প্রতিমার আরাধনা করে প্রতি বছর। রঙের এই ভুল কিভাবে শোধরাবেন ?‌ হাতে তো আর সময়ও বেশি নেই। আর আজকেই নির্মাল্যর সদস্যদের একবার মূর্তি দেখতে আসার কথা।

নির্মাল্য সংগঠনের সদস্যরা ... শুভ , শাওন , রূপ এরা সবাই অবাক হয়ে গেল বিখ্যাত মৃৎশিল্পী গোবিন্দ পালের তৈরি দুর্গাপ্রতিমা দেখে ... ঘোর কৃষ্ণবর্ণের দুর্গা প্রতিমা তাদের দিকে তাকিয়ে মধুর হাসি হাসছেন। প্রতিমার পায়ের কাছে বসে আছেন শিল্পী বৃদ্ধ গোবিন্দ পাল । তিনি জানিয়েছেন নির্মাল্য সংগঠনের এই মূর্তি পছন্দ হলে নিয়ে যাবে,  অন্যথায় অপরাগ তিনি ... বায়না টাকা ফেরত দিয়ে দেবেন। কিন্তু নির্মাল্যর সদস্যরা টাকা ফেরত নিতে চায় না।  তারা বুঝেছে শিল্পী এই অপূর্ব কালো দুর্গা মূর্তির মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন এক ব্যঞ্জনা এক রূপক ... বাইরের রঙ আলাদা হলেও সব মাতৃমূর্তি একম্ অদ্বিতীয়ম্ । আর এবার এই ব্যতিক্রমী দুর্গাপ্রতিমা প্রথা ভেঙে নির্মাল্য সংগঠনের মাতৃ আরাধনার একম্ অদ্বিতীয়ম্ সম্পদ হবে। তারা গোবিন্দ পালকে প্রশংসা ও শ্রদ্ধা জানিয়ে চলে যায়।

গোবিন্দ পাল তাকিয়ে থাকেন তাঁর সৃষ্ট মাতৃ প্রতিমা দিকে।  চিন্ময়ী আর মৃন্ময়ী মা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে এই মূর্তিতে ... স্নেহভরা মধুর হাসি মূর্তির দুই চোখে। গোবিন্দ পালের ঠোঁটদুটি নড়ে ওঠে গভীর আকুতিতে , "এতদিনে ... এতদিনে আমার বুকের জ্বালা একটু জুড়ালো মা ... ! "কোথা থেকে ভেসে আসা এক গানে ভ'রে উঠছে প্রাঙ্গণ , " ... ওই কালো রূপে দিগম্বরী হৃদিপদ্ম করে মোর আলো রে।..."

Post a Comment

1 Comments