পরনিন্দা ও পরচর্চা-র সাতকাহন
সূ র্য কা ন্ত মা হা তো
বউমা গেছেন বাপের বাড়ি। শাশুড়ি বৌমার অনুপস্থিতির সেই সুবর্ণ সুযোগকে টুক করে গ্রহণ করলেন। অনেকটা ফাঁকা মাঠে দ্রুত গোল দেওয়ার মতো। ছেলের কাছে বৌমার (প্রিয় নাকি অপ্রিয়) সম্পর্কে বেশ কিছুক্ষণ তার আচার আচরণের নানান অভাব অভিযোগের গল্প শোনালেন। মানে পরনিন্দা পরচর্চাকে একটু খানি ঝালাই করে নিলেন, ওই আর কি ! গৃহমধ্যে, বাড়ির অন্দরমহলে কিংবা উঠোনে, হরিমন্দিরে, অলিতে-গলিতে, পাড়ার মোড়ে যত্রতত্র একটু খানি চোখ কান খোলা রাখলেই এমন পরনিন্দা পরচর্চার অজস্র আসর লক্ষ্য করা যায়। কখনো সেসব বেশ জমাটি, কখনো বা হালকা হয়ে থাকে।
পরনিন্দা ও পরচর্চার এই আলোচনা ক্ষেত্র বা আসরগুলোতে একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় যে, মূলত কোনও একজনকে টার্গেট করে আলোচনা শুরু হয়। উপস্থিত সকলেই কমবেশি সমানভাবে অংশগ্রহণ করেন। কেউ কেউ আবার প্রবল কৌতূহলে সেটা শুনে বেশ আত্মতৃপ্তিও বোধ করেন। কেউ বা বিস্মিত হয়ে অজান্তেই বলে উঠেন, "তাই নাকি! জানতাম না তো?" কেউ কেউ আবার এর ওজন বৃদ্ধি করতে, বা উৎসাহ দিতে, নয়তো তাতে অতিরিক্ত একটু বারুদ যোগ করে বেশ অতিরঞ্জিত সুরে বলে উঠেন, "ঠিক কথায় বলেছেন!" "জানেন তো আমিও একবার দেখেছি!" " হ্যাঁ, আমিও শুনেছি," "আমাকেও একবার বলেছেন!" "জানেন, আমারও মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়।"
------- এই হল বাঙালির পরনিন্দা আর পরচর্চার একটুখানি ঝলক।
সাহিত্যে পরনিন্দা ও পরচর্চার ইতিহাস বলতে গেলে সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণ ও মহাভারতকেই এর আঁতুড় ঘর বলা যেতে পারে। রাজা দশরথের রাণীদের অন্দরমহল থেকে শুরু করে রাবণের রাজ অন্তঃপুর, পাণ্ডবদের রাজপ্রাসাদ থেকে কৌরবদের অন্দরমহল সর্বত্রই এই চর্চা বিরাজমান। তবে বাংলা সাহিত্যে চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বড়াই চরিত্রের মধ্য দিয়েই পরনিন্দা পরচর্চার হাঁটি হাঁটি, পা-পা। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। শাক্ত পদাবলীতে মেনকা ও গিরিরাজের শিব নিন্দা তো সর্বজন বিদিত। সে তো এক অন্য মাত্রা যোগ করেছে বাঙালির মন ও মননে। পরবর্তীকালে আধুনিক কথা সাহিত্যেও পরনিন্দা পরচর্চা ব্যতীত কাহিনী তো একরকম গড়ে উঠতেই পারে না। ছোটগল্প ও উপন্যাসের কাহিনী বুননে পরনিন্দা পরচর্চা তো সূঁচ সুতোর ভূমিকা গ্রহণ করে।
সিনেমা সিরিয়ালও কোনও অংশে পিছিয়ে নেই। যে যে সিরিয়ালের পাত্রপাত্রী এই চর্চায় যত বেশি ধুরন্ধর বা দড় তার টি আর পি তত বেশি। এই একটি মাত্র ইস্যু নিয়েই সিরিয়ালগুলো দিনের পর দিন বাঙালির বিনোদন জুগিয়ে চলেছে। সিনেমার ক্ষেত্রেও তাই, 'বউ' সিরিজের যেমন, "বড় বউ," "মেজ বউ," "ছোট বউ" সিনেমাগুলো তো পরনিন্দা পরচর্চার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে রেখেছে।
বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডারেও মুন্ডমাল শব্দ হিসাবে অন্যতম জায়গা করে নিয়েছে এই পরনিন্দা পরচর্চা। হয়ে উঠেছে বাঙালির পি. এন.পি.সি.।
পরনিন্দা আর পরচর্চা কী? দুটোই বিশেষ্য শব্দ। দুটোরই অর্থ হল--- অপরের কুৎসা বা নিন্দা। কিংবা পরের সম্বন্ধে(প্রধানত বিরুদ্ধে) আলোচনা। সহজ কথায়, অন্যকে নিয়ে নিন্দাসূচক আলোচনায় হল পরনিন্দা বা পরচর্চা। অন্য ভাবে বললে, কোনও ব্যক্তি সম্পর্কে ইচ্ছাকৃত নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করাই হল পরনিন্দা ও পরচর্চা।
পরনিন্দা আর পরচর্চায় নিন্দুক বা চর্চাকারীদের সর্বদায় উজ্জ্বল উপস্থিতি থাকে। কিন্তু নিন্দিত বা চর্চিত ব্যক্তির উপস্থিতি সব ক্ষেত্রে থাকে না। সর্বদা কেন, প্রায় সময়ই অনুপস্থিত থাকে। তার কারণ এ ক্ষেত্রে চর্চিত বা নিন্দিত ব্যক্তির প্রতি বিরুদ্ধাচরণ ঘটে। তাই চর্চিত বা নিন্দিত ব্যক্তি সম্পর্কে আক্রান্ত হওয়ার একটা আত্মভয় কাজ করে, নিন্দুক ও চর্চাকারীদের মনে। এই কারনে এমন নিন্দা বা চর্চা সেরকমভাবে প্রকাশ্যে হয় না। কিছুটা গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়। স্বর যতটা সম্ভব নিচু রাখার চেষ্টা করা হয়, অনেক সময় আড়ালও বজায় রাখা হয়। এই জন্য একে গ্রামীণ ভাষায় "গুজগুজ" আর "ফুসফুস" করাও বলা হয়ে থাকে।
কেন আমরা অন্যের নিন্দা বা চর্চা করি? করতে হয় বলেই করি, নাকি এর পিছনে আদৌ কোনও কারণ থাকে?
আসলে পরনিন্দা ও পরচর্চার ফলে যে রসটুকু আমরা পাই, সেটা আস্বাদন করে নিজেকে আত্মতৃপ্তি দিই, বা একটু ঘুরিয়ে বলা হলে, একপ্রকারের আত্মতুষ্টি লাভ করি। শুধুই কি আত্মতুষ্টি লাভ? নাকি আরও কিছু কারণ আছে? প্রথমেই বলা শাশুড়ির কথায় ধরা যাক, শাশুড়ি বৌমার আচার আচরণে অসন্তুষ্ট। আপাত দৃষ্টিতে এটা শাশুড়ির একান্তই নিজস্ব মানসিক চিন্তা-ভাবনার ব্যাপার। এটা তার একান্তই ব্যক্তিগত ভাবে খারাপ লাগা এক অনুভূতি। যদিও অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে সেটা নাও হতে পারে। যাই হোক, শাশুড়ির প্রত্যাশিত মানসিক চাহিদার ছন্দপতন ঘটেছে বলে, জন্ম নেওয়া অসন্তুষ্টিটাই পরনিন্দা ও পরচর্চার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চলুন এই পরনিন্দা ও পরচর্চার কারণগুলোর একটু গভীরে গিয়ে অনুসন্ধান করা যাক। পূর্বেই বলেছি, এটা পুরোটাই মানসিক ব্যাপার। একটা মানসিক বিশৃঙ্খলা থেকে এর জন্ম। সেটা আবার কেমন? 1) ধরুণ, কোনও কাছের মানুষ বা পাড়া প্রতিবেশী সম্পর্কে কোনও কারণে আপনি একটা অজানা ভয়ে ভয়ে আছেন। সরাসরি সেই ভয়টার মোকাবিলা তেমন করে করতে পারছেন না, তখন সেই ভয়টা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য, বা কিছু জনের সাপোর্ট পাওয়ার জন্য আপনি সেই ব্যক্তির একটু নিন্দা বা চর্চা করবেনই করবেন।
2) কারও প্রতি আপনি প্রচণ্ড রেগে আছেন বা ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন, অথচ সামনা সামনি সেই সমস্যা মেটাতে পারছেন না,বা কোনও এক দুর্বলতার কারণে আপনি প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না। তখন অন্যের কাছে তার নামে যত খুশি পারবেন নিন্দা আর চর্চা করবেনই,গেরেন্টি।
3) কারও উন্নতি দেখে, নিজে সেটা করতে না পারলেও সেই অক্ষমতা থেকে আপনি তার সম্পর্কে নিন্দা বা চর্চা করবেন।
4) অন্যের সাফল্য দেখে নিজের ব্যর্থতা ঢাকতেও গাত্র জ্বালায় অনেক সময় এমনটা আপনি করে থাকেন।
5) অন্যের তুলনায় নিজেকে অক্ষম, ব্যর্থ এমনকি হীনমন্য ভাবলেও একরকম মনের ঝাল মেটাতে আপনি পরনিন্দা ও পরচর্চা করেন।
6) আপনার অহংকারে কেউ আঘাত করলেও, এমনটা আপনি করে থাকেন।
এতে লাভ কী হয়? ওই গরম জলে ঘর পোড়ানোর মতো। কিংবা অনেকটা দুধের স্বাদ, ঘোলে মেটানোর মতো। তার বেশি কিছু নয়। কারও আচার আচরণে আমাদের অহং বা আমিত্বে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়, তাতে পরনিন্দা আর পরচর্চার একটুখানি মলম লাগিয়ে কেবল মনের একরকম প্রশান্তি লাভ ছাড়া আর বেশি কিছু লাভ হয় বলে মনে হয় না। তবে মানসিক চাপ মুক্তি ছাড়া আর কোনও উপকার হয় কিনা তা স্বয়ং পরনিন্দুক আর পরচর্চাকারীরাই ভালো বলতে পারবেন সেটা আমার নাগালের বাইরে। তবে একথা বলতে পারি যে, পরনিন্দা আর পরচর্চার এক বিরাট মাকড়সার জাল থেকে আমি আপনি কেউ মুক্ত নই। তাই, সাধু সাবধান!
0 Comments