জ্বলদর্চি

শিক্ষক দিবসের গল্প

তিন প্রজন্ম 
(অণুগল্প:শিক্ষক দিবসের জন্য)

গৌ ত ম  বা ড় ই 



সারাদিন পর মনে পড়ে এক একটা মুখ হামিদ,  কালাচাঁদ, বিনয়, আফজল, নরেন ইত্যাদি সব দশম শ্রেণির ছাত্রের নৌকাডুবির পর স্কুলে অনুপস্থিত থাকার আজ চারদিন হলো। তবে খবর পেয়েছেন জীবনহানি কারোর হয়নি। শ্যামলকে নিয়ে পরদিন নড়াইলের খালের ওপারে ডুমাইন গ্রামে গেলেন নড়াইল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বীরেশ্বর মিত্র।একে একে সব ছাত্রদের বাড়ি গেলেন। এদের অনেকের মনে আতঙ্ক,  কেউ কেউ আবার ভীষণ জ্বরে পড়ে শয্যাশায়ী। ভাদ্রের মাঝামাঝি। নদী খাল বিল সবই জলে টইটুম্বুর। রাশভারী জলদ গম্ভীর কন্ঠস্বরে ছাত্রদের গায়ে হাত বুলোচ্ছেন।কপালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা পরখ করছেন। সেদিনের সেইসব ছাত্ররা যারা বীরেশ্বর বাবু মানেই একটা তেল চকচকে বেতের লাঠি ভাবতেন তারা পিতৃতূল্য এই শিক্ষকের করতলের স্পর্শে ঐ রাত থেকেই সুস্থ হয়ে উঠলো। মাস্টারমশাই অনেক রাতে ঘরে ফিরলেন। দেখে এলেন ছাত্রদের। মনে একগাদা সন্তোষ।

প্রদীপ্ত স্যারের পাঠ্য পুস্তকের বাইরে গল্পকথায় সেই অসাধারণ পড়ানো, তার ভূগোল ইতিহাসের ক্লাস কোন ছাত্রই আর বাদ দিতেন না। অথচ প্রদীপ্ত বাবু স্যার কাউকেই লেখাপড়ার জন্য সামান্য একটি চড়ও মারেন নি। যেমন অনিমেষবাবুর নিষ্ঠুরতা আজও উচ্চ বালক বিদ্যালয়ের ছাত্রদের যেমন তার প্রতি একবিন্দু শ্রদ্ধা জাগায় না, তেমনি প্রদীপ্ত স্যারকে ছাত্ররা তাদের এ মনে খোঁজে বারবার।ইতিহাস আর ভূগোল তাদের কাছে অন্যতম প্রিয় বিষয় উঠেছিলো।


অর্কপ্রভ ছাত্রদের নিয়ে স্যোশাল সাইটে একটি গ্রুপ খুলেছে। প্রিয় কিছু ছাত্রদের নিয়ে এই তরুণ অধ্যাপক মাঝেমধ্যে মদ্যপানের আসর বসান। পৃথিবীর সব কথাই খোলামেলা বলেন।রাখঢাক নেই কোন। ব্লগ লেখেন। কবিতা। প্রবন্ধ। সব কিছু। ছাত্রীরাও স্যারের প্যাকেট থেকে সিগ্রেট চেয়ে খান। অল্প বয়সেই দামী গাড়ি, ফ্লাট আরও কতকিছু তার। আরও কত শরীর মনের ভালোবাসায় তার দিন কাটে। জীবনকে শুধুমাত্র নাকি একটি জীবনই দেখেন।

এক প্রজন্ম স্কুল ছেড়ে আসবার দিন চোখের জল আর চেপে রাখতে পারেনি। ছাতা মানপত্র গায়ে দেওয়ার শাল আর একগাদা দারিদ্র্য গায়ে মেখে সেদিন এক বিষাদ সন্ধ্যায় রঙচটা একটা বসতঘরে সাতজন প্রাণীর মাঝে এসে ঢুকেছিলেন।

আর এক প্রজন্ম একটা মোটামুটি ভদ্রস্থ একটা বসত বাড়ি বানিয়েছেন। যা পেনসন পান তা দিয়ে স্বামী স্ত্রীর খেয়েপড়ে ভালোমতন চলে যায়। নিজের লেখালেখি গভীর অধ্যয়নে সময় কেটে যায়। রাজনীতি করেননি কোনদিনও। আগে পাড়ার ক্লাব, লাইব্রেরী যেতেন।এখন সেখানে গেলেই গা গুলোতে থাকে। এক ছেলে আর এক মেয়ে উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত। ছেলে কলেজের অধ্যাপক আর মেয়ে ডাক্তার, বিদেশে থাকেন। সে সব নিয়ে ভাবেন না, দুজনেই নিজেদের জীবন কাটান নিজেদের মতন।

নতুন প্রজন্ম, এগিয়ে থাকা প্রজন্ম, নবীন ঝড়ে উড়ছে। পৃথিবী বদল গয়া। ঝক্কাস! এই তো সবে কদিন বা ক'মাস প্যান্ডেমিক আতঙ্কেই যা গৃহবন্দীর জীবন! দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলো না বা এমনি করে যায় যদি দিন যাক না।


(শিক্ষক দিবসে পৃথিবীর সমস্ত শিক্ষককেই আমার শ্রদ্ধা ও প্রণাম। আর অবনত মস্তকে শ্রদ্ধা ও প্রণাম সেই নমস্য শিক্ষক ডা. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন কে)।

Post a Comment

0 Comments