নিও-রিয়েল কবিতা : একটি মরুভূমি নাকি ফুটন্ত গোলাপ
সা য় ন
সেপ্টেম্বর আমার কাছে খুব প্রিয় একটি মাস। আমার জীবনের তিনটি প্রধান নক্ষত্র এই একটি মাসেই জন্মগ্রহণ করেন। তারিখক্রম অনুসারে ৭ই সেপ্টেম্বর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ৯ই সেপ্টেম্বর আমার মা এবং ১০ই সেপ্টেম্বর চিন্ময় গুহ। প্রথমজন শিল্পের অনুপ্রেরণা, দ্বিতীয়জন আমার জন্ম ও জীবনের অনুপ্রেরণা এবং তৃতীয়জন চিন্তা ও বোধের অনুপ্রেরণা।
নিজের সঙ্গে একান্ত বন্দি দুপুরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পড়ছি- “এক মায়ের সন্তানকে অন্য মা যদি বুকের বাঁ দিকে চেপে ধরে, তাহলেও কী শিশুটি একই রকম স্বস্তিবোধ করবে? কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ, ককেশিয়ান ও নিগ্রোবটু, ধনী ও দরিদ্র- সব মায়েদেরই কী হৃৎস্পন্দনের শব্দ একই রকম?” (‘বিজনে নিজের সঙ্গে’, পৃঃ ২০)
আজ সুনীল দা’র জন্মদিন। এমন একজন শিল্পীর পায়ের কাছে বসে শিষ্যত্ব লাভের জন্য আমার বৃদ্ধাংগুষ্ঠ কেটে দিতেও এক মুহূর্ত দ্বিধা হবে না।
কবিতার কোনো অভিভাবক হয় না :
গোটা পৃথিবীর মায়ের হৃৎস্পন্দনের মতো সমস্ত কবির কবিতাই আসলে আমার। এই কবিতাগুলোই এক একটা বৈচিত্র্যময় ডি.এন.এ.- মননের অপত্যজন্মের প্রতীক । কী রকম হবে সেই সৃষ্টি? এর মধ্যে মন, সমাজ আর ইতিহাসের তিনটি জন্ম, তিনটি চোখ, তিনটি হাত, তিনটি পা সমানতালে এগিয়ে যাবে একটিমাত্র হৃৎপিণ্ড ভিতরে নিয়ে- “আপনি আমার হাত থেকে/ তিনটে আঙুল কেটে নিন/ ভাতে মারবেন না/ যে লেখে, যে সত্যিই লেখে তার কাছে/ তিনটি আঙুল তিন জন্মের সমান।” (তিন জন্ম, তিন আঙুল) ‘যে সত্যিই লেখে’, তার জীবন একটা সেমিকোলন, মরুভূমি আর রাজভবনের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকে; হাতে একটি বই ‘মরুভূমির গোলাপ’, সুবোধ সরকার। এই সত্য কথা বলতে, লিখতে, চলতে, ফিরতে সুবোধ সরকার ১৯৯১ সালে মরুভূমির গোলাপ তুলে দিচ্ছেন হিন্দুত্ববাদের হাতে, জ্যোতি বসুর হাতে, আদবানীজির হাতে এবং সেই সঙ্গে “বলা যায়, এই বই থেকেই সুবোধের কবিতায় রাজনীতির প্রবেশ।” (কবিতা সমগ্র/ সুবোধ সরকার/ পৃঃ ৫১৬)
কবিতাই একটা গোটা বিশ্বমানচিত্র :
“এ বাড়ি না দিলে ও বাড়ি
জীবন কাটল রাস্তায়
এখনও আমার বিশ্বাস
পৃথিবী হাজারদুয়ারী” (ধম্মের ষাঁড় কীরকম হবে?)
কিভাবে একটা জীবন অনেকগুলো জীবন নিয়ে পথ হাঁটে, তার একটা মানচিত্র তৈরি করে কবিতা। আবহমান এই শহরের ভিতরে যে ভাঙচুর, তার ইতিহাস কোন্ বুক- পকেটে রাখব? আমি অনেকগুলো কবিতার বইয়ের পাতার আশ্রয় নিয়েছি। হাঁটতে হাঁটতে গড়িয়া থেকে পৌঁছে গেছি কলেজ স্ট্রিট, আর আমার-
“উদর বেড়েই চলেছে
উদর একটা পৃথিবী
খোকন চেয়েছে বেরুতে
পুরো পৃথিবী কাঁপিয়ে”। (খোকন কীরকম হবে)
১৯৯১ সাল থেকে এই নির্দিষ্ট যাত্রাপথ। যখন আমার প্রাক্তন প্রেমিকার ‘তিনভাগ দেখা যায় না’ – তখনও আমি খেয়াল করে গেছি ‘তৃতীয় পায়ে’ হাঁটা ‘বিকেলে ভোটের বাক্স’। একদিন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু সোভিয়েত ভেঙে যাওয়া মানেই তো আর মানবমেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়া নয়! চৌরঙ্গি মোড়ে একটি গাড়ি এসে দাঁড়াল আমার সামনে- কালো কাচ নামিয়ে জ্যোতিবাবু বললেন-
“লোকে যা বলছে বলুক
কুহক চলেছে কুপথে
পাড়ায় পাড়ায় ক্যাডার
যেভাবে চলছে চলুক।” (জ্যোতিবাবুর কথা কীরকম হবে)
গেরিলা আর পরিযাযী় শ্রমিকের জন্য কবিতা :
আজ শুধু নিজের সঙ্গে কথা বলা- এত পোস্টারের মতো মেলে ধরা জীবন আর ভালো লাগে না। মানুষ ভুলে যায় পোস্টারে শ্রাবণের বৃষ্টির ছোঁয়া শুধু লাগে না কাকের বিষ্ঠা দিয়েও ঢেকে যায় মুখ। আমরা ভাবি কোনো এক উঁচু গলা জিরাফ এসে চেটে মুখ মুছে দেবে- কিন্তু না হে গণতান্ত্রিক জনমানবগণ- আপনার পিছন থেকে জ্যা'তে যে টান পড়েছে রক্তলোভী তীরের রামচন্দ্রের নির্দেশে! একটু মুখ ফিরিয়ে দেখুন। এদেশে আর কেউ কোনোদিন মেলাতে পারবে না কোরানের শাস্তি আর উপনিষদের প্রেম-
“চাবুক থাকে দেয়ালে
বাইরে আছে কামান
যেভাবে হোক এখনই
আদবানিকে থামান।” (চাবুক কীরকম হবে)
আমার জীবন নিয়ে আপনি পাতার পর পাতা লিখে গেছেন। তাই এই সমস্ত কবিতা আমি নিজের জন্য বাজেয়াপ্ত করছি। কবি হাসে, কবি কাঁদে- “সেটা হয় না/ একটা সীমা আছে।”- এই সীমাটার নাম পৃথিবী। তাহলে পৃথিবী বাড়তে থাকে জীবনের স্তরে। কেন এই পচনশীল ভণ্ডামি আর স্তাবকতার শীতল বরফ দিয়ে হেঁটে চলা? -
“তার আছে তিনটি শর্ত
এক- বিছানার পাশে দুটি মেষশাবক থাকবে
দুই- কোনওদিন যেন নগ্ন না দেখি
তিন- মধু ও গোলাপফুল হবে আমার খাদ্য।” (পরস্ত্রী কীরকম হবে)
আমার আর কবিতার মাঝে কোনো হাইফেন নেই :
জীবন ও কবিতার মাঝে একটা হাইফেন সরিয়ে নিতে জানতে হয়। বরং উল্টোটাই হয়ে থাকে, একটা অদৃশ্য হাইফেন আমাদের কাঁধের ঝোলা বানিয়ে দেওয়া হয়। ‘কবি কীরকম হবে’ তাহলে জানতে চান-
“পাপ তো করেছ অনেকে
ময়ূর, মাদক, গন্ধে
কবিকে কী দেখে চিনব?
চোখের জলই চিহ্ন।”
অনেকটা পথ হাঁটলে তবে পথিক বা পাইলট হওয়া যাবে কি না, জানা নেই। তবে কবি হতে গেলে চোখের জলের উৎসটা জানা হয়তো প্রয়োজন। গোলপার্কের ফ্লাইওভারের মাঝে রেলিং ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখি উপরে আকাশ, নীচে রেলের চাকার পাশে বিছানা, থালা বাটির সংসার। কবিতা কিন্তু কোনো ফ্লাইওভার নয়, যে খুব সহজে যানজট বা বস্তি উপেক্ষা করে পার হয়ে গেলাম। বরং কবিতা একটা ফ্লাইওভারবিহীন যাত্রা, ঠিক যেমন দান্তে, ইনফার্নোকে বাইপাস করতে পারেন নি ফ্লাইওভার দিয়ে। কারণ,
“আমার হাতে প্রমাণ আছে নগরবাসী শোনো
ও পথে নয়, ও পথে নয়, এ পথ দিয়ে এসো
ও পথে গেছে কিরাত গেছে ধূর্ত বিধায়ক
ও পথে নয় আর্যাবর্ত ও পথে পড়বে না।” (অনার্যনগরঃ কলকাতা)
এভাবেই পথ চলা শুরু। কিন্তু শেষ নেই…….
সন্ধ্যা নেমে আসে – বাস থেকে কেউ দেখে আমায় ভিখিরি, কেউ বা যাযাবর, কেউ ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মাদ। ‘আমি আজ চূড়ান্ত চিনি না’ কোনো ভিড়ের কোলাহল। মানুষের ভাষার পথে আমি এক বধির শ্রমণ - যার শুধু মন আছে। তবু এই বিমূর্তায়ন একটা নিও-রিয়েল পৃথিবী- তাকে চিনতে হবেই প্রায় ৩০ বছর ধরে বিবর্তিত হযে়। আমার কবির সঙ্গে মোক্ষ কিংবা প্যারাডিসো কোনো জায়গায় যাওয়ার নেই। আমি শুধু এই শহরের মধ্যে একটা টুকরো ভারত দেখতে চাই। “সুতরাং ১৩ই নভেম্বর ১৯৮৮-র ১০-৫ মিনিট থেকে তোমার জন্মান্তর শুরু হয়। এই জন্মান্তর কোনো নক্ষত্রের যোগাযোগ থেকে নয়, এই জন্মান্তর বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের প্রকাশ্য ঘড়ির কাঁটা অনুসারে।” (মরুভূমির গোলাপ)
3 Comments
অসাধারণ হয়েছে।
ReplyDeleteভালো লেখা । মনের আনাচ কানাচ সব দেখা যায় ।ভালোবেসে যা কিছু সব এভাবে লেখা যায় ।
ReplyDeleteভালো লেখা । মনের আনাচ কানাচ সব দেখা যায় ।ভালোবেসে যা কিছু সব এভাবে লেখা যায় ।
ReplyDelete