জ্বলদর্চি

কবিতার তৃতীয় ভুবনে, কণ্ঠে – উচ্চারণে

কবিতার তৃতীয় ভুবনে, কণ্ঠে – উচ্চারণে

আ র ণ্য ক  ব সু  

পর্ব – ৬

কণ্ঠ যখন কবিকে ছাপিয়ে যায়


কবিতা যেখানে ভ্রুণ হয়ে থাকে কবির খাতায়,
সুকণ্ঠ কখনো জানে, তার তীব্র মর্ম বেদনাকে?
সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে কবির নামটি ভুলে যায়....
কিন্তু কবির বুকে তৃণ থেকে বনস্পতি সকলেই থাকে।


প্রিয় কবিতা বন্ধুরা, আসুন এই পর্বে কবিতা আবৃত্তি করে বিখ্যাত ও স্বনামধ্য হওয়া কিছু বাচিক শিল্পীর দাম্ভিক অবস্থানের কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আপনারা অনেকেই জানেন, আমার বেয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ বছরের কবিতা, নাটক আঁকড়ে থাকা জীবনের অনেকটাই আবৃত্তি শিল্পকে ঘিরে। নিজের কবিতাও আমি আবৃত্তি করি, পাঠ করি না। কেননা, আবৃত্তি শব্দটার সঙ্গে স্মৃতিশক্তি ভীষণ ভাবে মিলেমিশে আছে। বছর দুয়েক আগের একটা ঘটনা বলি। লেকটাউন অঞ্চলের একজন বাচিক শিল্পী তাঁর জন্মদিনে এই অধম কবিকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন, সঙ্গে সেই ভদ্রমহিলার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবও ছিলেন। সকলেই সম্ভ্রান্ত এবং মনস্ক শ্রোতা। আমার কবিতা শোনার আগে, তিনি তাঁর কবিতার ডায়রি খুলে একজন কবির কবিতা পাঠ করলেন। সমবেত সকলের কেকের গন্ধ ছড়ানো মুখ থেকে স্বাভাবিকভাবেই প্রশংসার ফোয়ারা উঠলো। কবিতাটা আমারও ভালো লেগেছিলো। আমি খুব বিনীতভাবে জানতে চাইলাম, এই সুন্দর কবিতাটা কে লিখেছেন এবং আপনি কতদিন ধরে বলছেন? তিনি একটু অস্বস্তি নিয়ে বললেন - কবির নামটা আমার জানা নেই, তবে প্রায় পাঁচ-ছ’ ধরে বলছি। রান্নাঘর থেকে আসা বিরিয়ানির গন্ধ ছাপিয়ে কোথাও যেন একরাশ বিষণ্নতা আমাকে গ্রাস করে নিল। আমার অবুঝ মন বুকে মৃদু করাঘাত করে যেন আমার কাছেই জানতে চাইল - মাঝারি সাইজের এই কবিতাটি পাঁচ-ছ’ বছরে যাঁর মুখস্থ হয়না, সে কেমন আবৃত্তি শিল্পী। এবার আমি মুখ ফস্কে বলে বসলাম – আচ্ছা, এই ছ’ বছরে আপনি কবিকে খুঁজে বার করতে পারলেন না? ভদ্রমহিলা স্মার্টলি জবাব দিলেন - আসলে কবিতাটাই তো ছড়িয়ে দেওয়া আমার লক্ষ্য, আমি তাই করে চলেছি। আমি এবার একটু সুর চড়ালাম – দেখুন, এই সোশ্যাল মিডিয়ার রমরমার যুগে ফেসবুকে জানতে চাইলেই তো কেউ না কেউ আপনাকে কবির নামটা জানিয়ে দিত। কবি তো তাঁর এই স্বীকৃতিটুকু আশা করতেই পারেন আবৃত্তিকারদের থেকে। স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্নের জবাব তিনি এড়িয়ে গেলেন। কিন্তু আমার এই প্রতিবাদের জন্যে তাঁর সাধের জন্মদিনের পার্টিটা কিছুটা ম্লান হয়ে গেল। আমি সেই সন্ধ্যায় - খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে লেখার টেবিলে বসতে হবে - এই ছুতো দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই পালিয়ে বেঁচেছিলাম; নয়তো কবি আরণ্যক বসুকে তাঁরা হয়তো তাঁদের পছন্দের তলিকা থেকে সরাসরি বাদ দিয়ে দিতেন।
কিন্তু, প্রতিবাদটা থেকেই গেল। প্রতিবাদটা থাকবেও। কোনো কোনো কবি যেমন মনে করেন এবং ঘোষণা করেন - আবৃত্তি আদৌ কোনো শিল্প নয়, কবিরাই তাঁদের কবিতা খুব ভালো করে বলতে পারেন। এই অপরিণত ধারনা ও মন্তব্যের বিরুদ্ধে যেমন আমার প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়; ঠিক তেমনি, কোনো প্রখ্যাত আবৃত্তি শিল্পী যখন কবির নাম বলতে ভুলে যান (ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে), তখনও বুকের ভেতরের সমস্ত ক্ষোভ আমার কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে আসতে চায়। সৃষ্টিকর্তার ঋণ স্বীকার না করা আমি অপরাধ বলে মনে করি। ইদানিং আমার হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এই ধরণের কয়েকটি প্রতিবাদ উঠে এসেছে। সেই বন্ধুদের সমর্থনে আজকে আমি কলম ধরতে বাধ্য হলাম। বাচিক শিল্পী ও কবি বন্ধুরা আমাকে ক্ষমা করবেন।
পরের সপ্তাহে আবার কণ্ঠচর্চাতে ফিরে যাবো। কথা দিলাম।

Post a Comment

1 Comments

  1. সত্য সে তো সত্যই থাকে।অসাধারণ লেখ।

    ReplyDelete