জ্বলদর্চি

এই আমি যে তিমিরে / দি লী প ম হা ন্তী

কার্টুন - সুদেষ্ণা রায় চৌধুরী    


এই আমি যে তিমিরে
  
 দি লী প  ম হা ন্তী


'তারপর একদিন উজ্জ্বল মৃত্যুর দূত এসে
কহিবে: তোমারে চাই-তোমারেই ,...
মরণের হাত ধরে স্বপ্নছাড়া  কে বাঁচিতে
পারে ?'
      -  জীবনানন্দ দাশ

একটার পর একটা দিন বয়ে চলেছে বিষাদ নিয়ে। একটার পর একটা রাত্রি আছড়ে পড়ছে রক্তাক্ত তটভূমিতে। আমি অন্ধকার রাত্রির তারাভরা আকাশের দিকে চেয়ে দেখে যাচ্ছি পৃথিবীর ভয়ংকরতম অসুখকে। সারা পৃথিবীর বুকে নেমে আসা এক জ্যান্ত বিপদকে। অথচ কয়েক মাস আগেই যখন অন্যদেশগুলিতে মৃত্যুর মিছিল চলছিল তখন আমরা নির্বিকার ছিলাম। আমাদের স্পর্শ করেনি সেই ভয়াবহতা! কারণ , সেই তীব্র ছোবল তখনো আমাদের শরীরে বিষদাঁত বসাতে পারেনি। আক্রান্ত হয়নি আমার দেশের মানুষ। স্বার্থপরতার এমন নিদর্শন সত্যিই আরো বেশি ভয়ের! পৃথিবীর বুকে নেমে আসা পুরনো ক্ষত গুলি, যেমন প্লেগ , স্প্যানিশ ফ্লু, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমি প্রত্যক্ষ করিনি। শুনেছি তার করুণ পরিণাম। কিন্তু কোনো যুদ্ধ ই বোধহয় পৃথিবীর সর্বত্র এমন বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে দিতে পারেনি, যা পেয়েছে করোনা বা কোভিড-১৯ নামক এক অদৃশ্য দানব।

সারা পৃথিবীর অসংখ্য মানুষের মতো আমিও ঘরবন্দি। শুধু বাড়ির জানালা দিয়ে, ছাদ থেকে আমার পরিচিত পৃথিবীকে  দুচোখ ভরে দেখছি আর শুনছি ক্রমশ তার অপরিচিত হয়ে যাওয়ার মর্মান্তিক কাহিনী। আমাকে গ্রাস করছে আমাদের চারপাশের আতঙ্ক ঘেরা অনাগত ভবিতব্য। একটু একটু করে আমরা যেন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। মৃত্যুর পদধ্বনি শুনছি। মৃত্যু কড়া নাড়ছে একটার পর একটা বাড়িতে। ঢুকে ও পড়ছে। এমনকি আমার পাশের বাড়িতেও! একরাশ ভয় আর উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রতীক্ষা, এরপর কি আমার বাড়ি?কান পেতে থাকি দরজায় কড়া নাড়ার শব্দের আশঙ্কায়! আমি তো তারাশঙ্করের জীবন মশায় নই যে মৃত্যুর পথরোধ করে দাঁড়াবো।বলব,দেবী তোমার এখনো আসার সময় হয়নি। পথ ছাড়ো, সরে দাঁড়াও। অথবা পৃথিবীর নাড়ী ধরে গভীর ধ্যানে বুঝতে চাইব তার মৃত্যু হতে আর কত দিন কত ঘন্টা কত মিনিট বাকি!

এই ঘোর অমানিশার মাঝে প্রতিদিন নতুন নতুন খবর ভেসে আসছে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও অন্তর্জালে। প্রতিদিন রোগ সম্পর্কে  ভাইরাস সম্পর্কে চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে মত বদল করছে হু ও আই.সি.এম.আর। আর করোনা আক্রান্তের সংখ্যাও ক্রমশ বাড়ছে অতি দ্রুত। গতকাল যে রেকর্ড পরিমাণ সংক্রমণ ঘটেছে তা ছাপিয়ে যাচ্ছে আজ। এক ই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও।যদিও বহু মানুষ সুস্থ হয়ে উঠছেন তবু এই মৃত্যু যথেষ্টই ভয়ের। এরই মাঝে শুনছি পৃথিবীও নাকি ধ্বংস হয়ে যাবে খুব দ্রুত। কেউ বলছেন বাইবেলের কথা, কেউ মায়া সভ্যতার ক্যালেন্ডারের কথা, কেউ আবার নস্ত্রাদামুসের ভবিষ্যৎবাণীর কথা। এজন্যই কখনো নাকি পৃথিবীর কান ঘেঁসে ভয়ংকর গতিতে ছুটে যাচ্ছে উল্কা বা কোনো গ্রহাণু। কখনো পৃথিবীতে নেমে আসছে পঙ্গপালের সারি। আর ঘরবন্দি অবস্থায় আমার রক্তের অভ্যন্তরে খেলা করছে পৃথিবীরও মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার খবর।একটু একটু করে...

আমি দেখছি আমার দেশের শ্রমিকদের পথচলা। পৃথিবীর পথে হাঁটতে হাঁটতে তারা আদিম পৃথিবীতে পৌঁছে যাচ্ছে। একসঙ্গে রাজপথে হাঁটছে বাঘ ও মানুষ।পথেই প্রথম আলো দেখছে নতুন শিশু। কতজন পথেই মরে যাচ্ছে।
পথ চলতে চলতে তারা পথেই শুয়ে পড়ছে। তাদের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে যন্ত্র দানব। তারা পথের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। শুধু একমুঠো ভাতের জন্য তারা পাড়ি দিয়েছিল বহুদূর পথ।এ রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে! ফিরে আসছে নিজের জরাজীর্ণ ভিটেমাটিতে, মৃত্যুকে সঙ্গে নিয়ে। নিজের জন্মভূমিতে ফিরে এসেও তারা বাঁচতে পারছে না। বেঁচে থাকতে গেলে খাদ্য দরকার! খাবারের জন্য তাদের আবার পথে বেরোতে হচ্ছে।পথই হয়ে উঠছে তাদের ঘর।এই পথই তো তাদের মৃত্যু!

 আমি ঘরে বসেই দেখতে পাচ্ছি হাসপাতালের অসহায় ডাক্তার ও নার্সদের।অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা জয়ী হচ্ছেন , কিন্তু  পরাজিতও হচ্ছেন বারবার। আর দেখছি অসুখে আক্রান্ত মানুষের লাল লাল ঘোলাটে চোখ। পৃথিবীর সব রূপ রং গন্ধ কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের জীবন থেকে। তারা কোন স্বপ্নদেশের অন্ধকারে হাঁটার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে মনে মনে।

 এরই মাঝে পৃথিবীকে আরও সবুজ হয়ে উঠতে দেখছি। বসুন্ধরা  কত উর্বর হয়ে উঠছে। ধুলো, ধোঁয়া, কোলাহল, কল কারখানার আওয়াজ কমে যাওয়ার ফলে। মানুষ অনেকটা সময় ঘরে কাটাচ্ছে বলে পরিবারের প্রত‍্যেকে  প্রত‍্যেককে নিবিড় ভাবে কাছে পাচ্ছে। সেখানে অন্তরায় হচ্ছে কখনো কখনো তার প্রিয় মোবাইল ফোনটি। একই ঘরে বসে যে যার নিজের মতো ঘেঁটে যাচ্ছে ফোন। শারীরিক ভাবে কাছাকাছি থাকলেও মন ঘুরে বেড়াচ্ছে দূরে বহু দূরে...। এই সময়টুকুর হয়তো দরকার ছিল তপ্ত পৃথিবীর কাছে। কেউ আপনজনের সঙ্গে সম্পর্কের  মরীচিকা ধুয়ে নিচ্ছে, কেউ বা শুনছে সুরের ঝরনা, কেউ দেখছে পুরনো ছবি, কেউ বা নতুন সৃষ্টিতে মগ্ন। অনেকটা সময় পাওয়া গেছে তাই পৃথিবীর ও পরিবেশের শুশ্রূষা করা দরকার। কিন্তু, এভাবেও কি ভয় বা আতঙ্ক বা অন্ধকার কাটছে? না, বরং বাড়ছে। সারা পৃথিবী আজ ধরা আছে হাতের মুঠোয়। তাতে সভ‍্যতা কতটা এগোচ্ছে? গরীবের পাতে ভাত তো আসছে না। যাদের ঘরে এক মুঠো ভাত নেই, তাদের খাদ্যের সমস্যা কীভাবে মিটবে?

এই দুঃসময়ে আমি আমার ক্রোধ হতাশা অভিমান ভয়  অসহায়তাকে জড়িয়ে দিব‍্যি বেঁচে আছি। সারা দিনের উচ্ছিষ্ট আলো আমাকে ঠেলে দিচ্ছে রাতের আঁধারে। আবার রাত্রি ধোয়া মলিনতা কাটিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছি আরো একটি দিনের দিকে।এর মাঝেও কিন্তু ঘটে যাচ্ছে মহাজাগতিক ও প্রাকৃতিক সমস্ত  ঘটনাবলী। পূর্ণিমা, অমাবস্যা, চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ থেকে শুরু করে জন্ম বিবাহ মৃত্যু, রাজনীতি সমস্তই। শুধু কিছু মৃত্যু বড় মর্মান্তিক। এক অদৃশ্য শক্তির চুম্বনে যাঁরা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের অন্তিম কার্য  বড় অবহেলায় বড় অমানবিকতায় সম্পন্ন হচ্ছে। এতসব দেখেও চুপ করে বসে আছি ঘরের কোণে।

আজ থেকে প্রায় দেড়শো কোটি বছর আগে এক মহাবিস্ফোরণে যে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে, সে যে কত বড়! কত বিশাল তার আয়তন তা আমাদের ধারণার বাইরে। সেই রহস‍্যের মাঝে, সেই বিস্তারের মাঝে মানুষ বড় অসহায় । মানুষ তো সেদিনের জীব! মহাবিশ্বের নক্ষত্রগুলোও তো একটা সময়ে নিভে যায়। সূর্য ও তো একদিন নিভে যাবে তার জ্বালানি ফুরোলে। পৃথিবীও সেই নিয়মে একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে! অবশ্য কোনো আকস্মিক কারণে তার আগেও ধ্বংস হতে পারে। তাহলে এতো ভয় কেন? একদিন তো মরতে হবেই। এই চিরন্তন সত‍্যটি শরৎচন্দ্রের ইন্দ্রনাথ অতি অল্প বয়সেই অনুভব করেছিল, অথচ আমরা এখনো করিনি।

কেউ বাঁচতে চাইছেন ভগবানের কৃপায় ভর করে। ভাবছেন পৃথিবীর এই গভীর গভীরতর অসুখ ঈশ্বর নিরাময় করবেন। কেউ আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের উপর ভর করে গাছ গাছড়ার পাতা ছাল চিবোচ্ছেন। কেউ হোমিওপ্যাথির ভরসায় নিশ্চিতে বাঁচার স্বপ্নে বিভোর।আর অ্যালোপ্যাথি চালিয়ে যাচ্ছে তার গবেষণা (ভ্যাকসিন তৈরির) দিন,মাস, বছরের পর বছর ধরে।,হয়তো কোনোদিন তারা সফল হবে তখন হয়তো আমরা অনেকেই থাকবো না। পৃথিবী আধমরা হয়ে বেঁচে থাকবে। করোনা পৃথিবীর অনেকটা ধ্বংস করে তার উপর গভীর আঘাত করে তার মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়ে হাসতে হাসতে বিদায় নেবে। অবশিষ্ট আমরা স্তব্ধ হয়ে হেরে যাওয়া পৃথিবীকে দেখব। আর পৃথিবীর বুকে যে ক্ষত রয়ে যাবে তা সারতে বোধহয় কয়েকশ বছর সময় লাগবে। তবু কি পুরোপুরি সারবে? কারণ, প্রিয় কবির মতো আমরাও জানি,'ক্ষত সেরে গেলে পরে ত্বকে/ পুনরায় কেশোদ্গম হবে  না;'  তাই সেই দিনের কথা ভেবে বিনয় মজুমদারের ভাষায় আবারো বলবো:'প্রাচীন চিত্রের মতো চিরস্থায়ী হাসি নিয়ে তুমি/ চলে যাবে; ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় স্তব্ধ হবো আমি।'

Post a Comment

6 Comments