Modern Art History
আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -১৬
শ্যা ম ল জা না
এক্সপ্রেশনিজম-এর অপমৃত্যু
সেই ১৮৭৪ সাল থেকে ইম্প্রেশনিজম-এর হাত ধরে চিত্রশিল্পে যে আধুনিকতার সূত্রপাত হয়েছিল, তারপর থেকে কিছুদিন পর পরই বহু ইজম্-এর জন্ম হয়েছে পরিস্থিতি বা কন্ডিশন অনুযায়ী৷ কিন্তু যে সামাজিক পরিস্থিতি ও পটভূমিকায় এক্সপ্রেশনিজম্-এর জন্ম হল, তা আগের কোনো ইজম্-এর ক্ষেত্রে ছিল না! আমি আগে বলেছি, আবার বলছি— ঠিক যখন বিশ শতক শুরু হচ্ছে, সারা পৃথিবীতে তখন আধুনিকতার পাশাপাশি শোষণেরও পাকাপাকি ব্যবস্থা শুরু হচ্ছে৷ আর, বিশৃংঙ্খলায় ভরে গেছিল বিশ্ব! সারা পৃথিবী জুড়ে মানবতার সংকট দেখা দিয়েছিল৷ দেশে দেশে মানুষে মানুষে বিভিন্ন ধরনের বিবাদ ক্রমশ বাড়ছিল৷ সেই সঙ্গে দ্রুত বিস্তার লাভ করছিল সততা ও মনের বিশুদ্ধতার(Spirituality) সংকট৷ তৈরি হচ্ছিল যুদ্ধ পরিস্থিতি৷ ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা ভীষণভাবে বেড়ে যাচ্ছিল! ঠিক এই সময়েই ঐতিহাসিক কারণেই পরিস্থিতি (Condition) বাধ্য হল এক্সপ্রেশনিজম-এর জন্ম দিতে৷
অর্থাৎ, শোষণের বন্দোবস্ত মানেই পুঁজি৷ দেশে দেশে হানাহানি ও যুদ্ধ পরিস্থিতি মানেই রাষ্ট্রের ভূমিকা৷ আর, এ দুটির কারণে অবশ্যম্ভাবী সাধারণ মানুষের মনে জন্ম নেয় উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা! দেখা দেয় মানবতার সংকট৷ আর, এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হওয়া মানেই সমাজের উচ্চ চিন্তা-চেতনার মানুষজনদের মনের ভেতরে জন্ম নেবে প্রতিবাদ৷ বিশেষ করে লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে৷ এবং সেই প্রতিবাদ প্রকাশ্যে আসবে৷ একত্রিত হবে৷ আর হলও তাই৷ চিত্রশিল্পীদের হাত ধরে এক্সপ্রেশনিজম-এর সূত্রপাত হলেও, তা দ্রুত ছড়িয়ে গেল সারা ইয়োরোপে তো বটেই, এবং তা ছড়িয়ে গেল অন্য শিল্প মাধ্যমেও— কবিতায়, সাহিত্যে, নাটকে, সিনেমায়, সংগীতে... ...! এ রকমটা আগের কোনো ইজম্-এর ক্ষেত্রে ঘটেনি! আগের ইজমগুলো জন্ম নিয়েছিল মূলত ঐতিহ্যের নামে বছরের পর বছর ধরে শিল্পক্ষেত্রে নানান বিধি-নিষেধ, গোঁড়ামি, ইত্যাদি প্রাচীনপন্থার বিরুদ্ধে ও মুক্ত চিন্তার পক্ষে প্রতিবাদস্বরূপ৷ যার সঙ্গে সরাসরি সমাজ-অর্থনীতির কোনো সম্পর্ক ছিল না৷ এক্সপ্রেশনিজমই প্রথম সময়-সমাজ-অর্থনীতির প্রেক্ষিতে সরাসরি তাঁদের প্রতিবাদ চিহ্নিত করেছিল (ছবি-১)৷
এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের সঙ্গে তাঁদের শিল্পের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল এই রকম— এক হাতে তাঁদের সৃষ্টি ও অন্য হাতে সমাজ ও রাজনীতি! সময়টা তখন হিটলারের নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ত নাৎসিবাহিনীর দ্রুত উত্থানের কাল৷ ফলে, ওই ফ্যাসিস্তদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর চিরতরে বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে এটাই স্বাভাবিক৷১৯০৬ সালে “দ্য ব্রিজ”-এর হাত ধরে, যুদ্ধের আঁচ গায়ে মেখেই, এক্সপ্রেশনিজম-এর যাত্রাপথ শুরু হয়েছিল৷ এর মাত্র আট বছরের মাথায় শুরু হয়ে গেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ৷ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছিল তাঁদের আন্দোলন৷ তাঁরা প্রায় কেউই ঠিকমতো সংগঠিত হতে পারতেন না৷ ঠিকমতো ছবি আঁকতে পারতেন না৷ তাঁদের অধিকাংশকে বাধ্য করা হয়েছিল যুদ্ধে যেতে৷
ফলে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অধিকাংশ এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকেই নষ্ট করে দিয়েছিল৷ তাঁদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে গেছিল৷ তাঁরা মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন৷ অধিকাংশই বাকি জীবন ট্রমায় আচ্ছন্ন হয়ে কাটিয়েছিলেন৷ শুধু তাইই নয়, ব্যক্তিগতভাবে এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পীদেরকে আলাদা করে ধরে নিয়ে গিয়ে আক্রমণ করা হত৷ নৃশংসভাবে অত্যাচার করা হত৷ “ব্লু রাইডার”-এর অন্যতম দুজন প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের অন্যতম ফ্রাঞ্জ মার্ক ও আগস্ট ম্যাকে-কে তৎকলীন নাৎসি মিলিটারিরা তুলে নিয়ে গিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে এমন নজীরবিহীন নৃশংস অত্যাচার করেছিল, যে তাঁরা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন৷ এবং তাঁদের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল৷ পরে তাঁদের মৃত অবস্থায় শনাক্ত করা হয়েছিল৷
শেষমেশ ১৯৩৩ সালে হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবার পরেই, এক্সপ্রেশনিজম নামের যে প্রদীপটি তার তেলহীন সলতের মুখে কোনোরকমে সামান্য একটুখানি আলোর অস্তিত্ব নিয়ে টিকে ছিল, তাকেও তারা জোর করে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল! সেই সময়ে বিশ্ববন্দিত থেকে ছোটোখাটো যত শিল্পী ছিল(অগুনতি বলাই ঠিক হবে), তাঁদেরকে অফিশিয়ালি রাষ্ট্রদ্রোহী “অধঃপতিত শিল্পী”(“Degenerate artists”) হিসেবে ঘোষণা করা হল৷ এঁদের মধ্যে ছিলেন— পাবলো পিকাসো, পল ক্লে, ফ্রাঞ্জ মার্ক, এর্নস্ট লুডউইগ কির্চনার, এডভার্ড মুঙ্খ, আঁরি মাতিস, ভিনসেন্ট ভ্যান গখ্, পল গগ্যাঁ, প্রমুখ পৃথিবীর সর্বকালের সেরা শিল্পীরা৷ শুধু তাইই নয়, এতেও তারা থেমে থাকেনি৷ এইসব শিল্পীদের সমস্ত আর্ট ওয়ার্ক তারা বাজেয়াপ্ত করেছিল৷ মিউজিয়াম থেকে সরিয়ে দিয়েছিল৷
আর, ইতিহাস যে সব সময় সত্যের পক্ষে থাকে, তারও একটা জ্বলন্ত উদাহরণ এই এক্সপ্রেশনিজম৷ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জন্ম নিয়ে, এই স্বল্প পরিসরে, তাঁরা এই আন্দোলনকে অঙ্কুর থেকে চারাগাছ, চারাগাছ থেকে বৃক্ষ, বৃক্ষ থেকে মহীরূহতে পরিণত করেছিল৷ শুধু ফুল ফোটানো নয়, সেই ফুলকে তাঁরা বীজেও পরিণত করেছিল৷ ফলে, আপাতভাবে এই মহীরূহের বিনাশ মনে হলেও, সেই বীজ যথার্থভাবে সংরক্ষিত হয়েছিল(ছবি-২)৷
পরবর্তীকালে, “আঁভা গার্দ” আন্দোলনের শরীক হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময়ে ১৯৪০ ও ১৯৫০ সালে “অ্যাবসট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম” মাথা চাড়া দেয়৷ তার পরে, ১৯৭০-এর শেষে ও ১৯৮০-র প্রথম দিকে এক্সপ্রেশনিজম-এর উত্তরসূরি হিসেবে সুত্রপাত ঘটে “নিও এক্সপ্রেশনিজম-এর৷ আমরা বুঝতে পারলাম— আন্দোলন সঠিক হলে ইতিহাস তার পক্ষে থাকে৷ (ক্রমশ)
1 Comments
ইমপ্রেশনিজম থেকে যাত্রা করে
ReplyDeleteবিবর্তিত হয়ে এক্সপ্রেশনিজম পর্যন্ত
আসতে বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাত পার
হয়ে যেভাবে শিল্প চর্চা সমাজ,সময়,
মানুষের সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল।
তা লক্ষনীয়।
এরপর হিটলারের সময়ে ফ্যাসিষ্ট
আক্রমন কি বিভৎসতা নামিয়ে এনেছিল তা বোঝা যায়, শিল্পী, সাহিত্যিক,বুদ্ধিজীবিদের উপর
নামিয়ে আনা অত্যাচারে।
লেখক এটা দেখিয়েছেন সুন্দর ভাবে
যে ইতিহাস সর্বদা সত্যনিষ্ঠ আন্দোলনের পক্ষেই থাকে।ফলতঃ
বিবর্তিত বীজটি এবারে জন্ম দিতে
সক্ষম হয়েছে-"নিও-এক্সপ্রেশনিজম
বেশ লাগছে। আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে।