জ্বলদর্চি

দিল্লি দর্পণ - ১৫/ কালীপদ চক্রবর্ত্তী

দিল্লি দর্পণ   - ১৫

কালীপদ চক্রবর্ত্তী, নতুন দিল্লি

সারারাত ধরে অনুষ্ঠান

একসময় দিল্লিতে সারারাত ধরে অনুষ্ঠান চলতো। তবে তা অনেকদিন হলো বন্ধ হয়ে গেছে আতঙ্কবাদীদের তান্ডবে। এবছর দুর্গাপুজোতে দিল্লির বাঙালিরা অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন। অন্যান্য বছর দিল্লীতে দুর্গাপূজার আগে এবং দুর্গাপূজার দিনগুলোতে পুজোকমিটিগুলো বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। ষষ্ঠীর দিন হয় দেবীর বোধন এবং আনন্দমেলা (যেখানে মহিলারা বাড়ী থেকে বিভিন্ন ধরণের খাবার বানিয়ে এনে মণ্ডপে বিক্রি করেন এবং তার প্রতিযোগিতাও হয়) ও বিচিত্রানুষ্ঠান। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীর দিনগুলোতে সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় মায়ের পূজা, অঞ্জলি, প্রসাদ, ভোগ বিতরণ, আরতি, সন্ধ্যানুষ্ঠান। দিনের বেলায় থাকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা – কবিতা, গান, শঙ্খধ্বনি, বসে আঁক, হাঁড়ি ভাঙা, খেলাধুলা ইত্যাদি, সন্ধ্যায় থাকে আরতি প্রতিযোগিতা এবং রাতে – বিচিত্রানুষ্ঠান। এক কথায় বলা যায়, পুজোর দিনগুলোতে বিকেল চারটের আগে আপনি যাতে মণ্ডপ ছেড়ে বাড়িতে যাতে না যেতে চান তাই আয়োজন করা হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং ভোগ-প্রসাদের। বহু জায়গাতেই বিশেষ করে মন্দিরগুলোতে ভোগ-প্রসাদের জন্য খোলা থাকে অবারিত দ্বার। ধনী, গরীব, উচ্চ-নীচের কোনও ভেদাভেদ থাকেনা। বিশেষ করে মন্দিরগুলোতে। একসময় বসিয়ে রীতিমত পরিবেশন করে ভোগ খাওয়ানো হতো কিন্তু আজকাল সময়ের এবং জনবলের অভাবে বসিয়ে খাওয়ানো অনেক জায়গাতেই বন্ধ করে দিতে হয়েছে। মন্দিরগুলোতে পুজোর কদিন চার-পাঁচ হাজারের চেয়েও বেশি লোককে ভোগ খাওয়ানো হয়ে থাকে। 
 
দিল্লীতে দুর্গাপূজা, রবীন্দ্র জয়ন্তী, বিভিন্ন পূজা পার্বণ ইত্যাদির মাধ্যমেই নাটকের সূত্রপাত হয়। দিল্লীতে এক সময় ছিল যখন দুর্গাপূজাতে নাটক হবে না এরকম ভাবাই যেত না। সারারাত ধরে চলতো নাটক, যাত্রা, সিনেমা ইত্যাদি অনুষ্ঠান। আজকাল অবশ্য এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। দিল্লীতে এমন একটা সময় ছিল যখন দিল্লীর বাঙালিরা পুজোর  সময় যাত্রা, নাটক দেখার জন্য উৎসুক হয়ে থাকতো। দিল্লীতে এখনও যাত্রা, নাটক হয় বটে তবে কোথাও যেন দর্শকদের উৎসাহে ভাঁটা পড়েছে। 
দুর্গাপূজার প্রায় একমাস আগে থেকে দিল্লীতে প্রতি পাড়ায় পাড়ায় নাচ, গান, নাটক ইত্যাদির মহড়া শুরু হয়ে যায়। একসময় প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বাংলা সিনেমা দেখানোর খুব প্রচলন ছিল। এ বিষয়ে একটি মজার ঘটনা মনে পড়ল। দেখা গেছে একই সিনেমা বিভিন্ন পুজো প্যান্ডেলে দেখানো হতো, তাই এক প্যান্ডেলে এক রিল শেষ হলেই লোক থাকতো সেই রিলটা নিয়ে অন্য প্যান্ডেলে চলে যেত। আবার অন্য প্যান্ডেল থেকে এই প্যান্ডেলে ওই একই রীতিতে রিল এলে শুরু হতো পরের রিল। একবার কোথাও একটু ওলট পালট হয়ে যাওয়ায়, দেখা গেল সিনেমার নায়ক মারাগেল অর্থাৎ শেষ রিল চললো কিন্তু পরে যে রিল এলো তাতে দেখা গেল নায়ক বেঁচে আছে। বইটির নাম এখন মনে নেই, তবে সিনেমাটি ছিল মহানায়ক উত্তম কুমারের। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। তবে তা নিয়ে কখনও গন্ডগোল বা হৈ,চৈ করতে দেখিনি দর্শকদের। ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক যাত্রাপালা পরিবেশিত হত। 

দিল্লীতে আগে দুর্গাপূজার সময় সারারাত ধরে চলতো বিভিন্ন অনুষ্ঠান, বিশেষ করে নাটক, যাত্রা এবং সিনেমা দেখানো। সেই আনন্দ অনুভূতি ছিল আজকের আনন্দের থেকে একটু আলাদা। আজকাল সন্ত্রাসবাদীদের ভয়ে সারারাত ধরে অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়া হয় না। তাই আজকাল দিল্লীতে অনুষ্ঠানগুলো রাত্রি ১০টা থেকে ১২টার মধ্যেই শেষ করতে হয়। তবে লোকেরা সন্ত্রাসবাদীদের ভয় উপেক্ষা করেও ভিড় করে মণ্ডপে মণ্ডপে। যদিও এ দৃশ্য এবছর দেখা যাবেনা। দুর্গাপূজার দিনগুলোতে রাত্রে ঠাকুর দেখার ভিড়ের জন্য চিত্তরঞ্জন পার্কে ঢোকা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। এ থেকেই অনুমান করতে পারবেন ভিড়ের মাত্রা কেমন হয়। চিত্তরঞ্জন পার্কের মেলা গ্রাউন্ড, শিব মন্দির, কো-অপারেটিভ, ই- ব্লক, পকেট-৪০ এবং বি- ব্লকের পূজা খুবই জনপ্রিয়। এছাড়াও আছে কালকাজী ডি.ডি.এ. ফ্ল্যাটের পুজো । দিল্লীর নিবেদিতা এনক্লেভ, করোল বাগ, মাতৃমন্দির, নিউদিল্লী কালীবাড়ি, কাশ্মীরী গেট, সাউথ দিল্লী কালীবাড়ি, ময়ূর বিহার, সাকেত, মোতিবাগ, সরোজিনী নগর, বসন্ত কুঞ্জ, বসন্ত বিহার, চানক্যপুরী এবং নয়ডা কালীবাড়ির পূজাও খুব নাম করা।  দিল্লির আশে পাশের পূজা বলতে গেলে নয়ডা এবং গুরুগ্রামের দুর্গাপুজো। সেখানেও মহা ধূমধামে দুর্গাপূজা হয়। নয়ডা কালীবাড়ি, নয়ডা সেক্টর ৫০ এবং গুরুগ্রামের সেক্টর ১৪/১৫, ডি এল এফ ও ফরিদাবাদের পুজো আজকাল বেশ সুনাম অর্জন করেছে।  

দিল্লীতে অনুষ্ঠিত দুর্গাপূজার একটি বিশেষত্ব হচ্ছে যে বিজয়ার দিন দিল্লীর সব প্রতিমা এবং শোভাযাত্রা নিউদিল্লী কালীবাড়িতে গিয়ে একত্র হয় এবং সেখান থেকে সম্মিলিত শোভাযাত্রা শুরু হয়। এই শোভাযাত্রা যাতে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয় সেই কারণে  জয়েন্ট প্রশেসন কমিটি (J.P.C.) গঠন করা হয়। এই কমিটির উপর শোভাযাত্রা, সমারোহ ও নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকে। এরা দিল্লীর বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর থেকে পারমিশন জোগাড় করেন এবং দমকল ও পুলিশ বাহিনীর সাহায্যের বন্দোবস্ত করেন। অতগুলো ঠাকুর, অত ট্রাক, বাস, টেম্পো, গাড়ি, স্কুটার, সিকিউরিটি, এক কথায় ভাসানের সব দায়িত্ব সামলায় এই জয়েন্ট প্রশেসন কমিট। সাবধানতার জন্য বুলডোজার, ফর্ক লিফট ইত্যাদিরও ব্যবস্থা থাকে। এই বৃহৎ কাজ তাঁরা এত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। জ়ে. পি. সি.-র কর্মপরিধি ও পদ্ধতি পরিচালনার মূল দায়িত্বে থাকে নিউ দিল্লী কালীবাড়ি, মন্দির মার্গ। দিল্লীতে এই বিরাট শোভাযাত্রা ও সমারোহে প্রতিমা নিরঞ্জনের পালা শুরু হয়েছিল ১৯৫১ সালে। মন্দির মার্গ স্থিত রাইসিনা বঙ্গীয় বিদ্যালয়ের জনপ্রিয় মাস্টারমশাই, সুশীল রায় চৌধুরী মহাশয় এই মহৎ পরিকল্পনাটি দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। তিনি তৎকালীন কয়েকটি পূজা সমিতিকে এক জায়গায় জড়ো হয়ে বিকেলের দিকে একে একে প্রতিমা বিসর্জন দেবার অনুরোধ জানান। তখন থেকেই চলে আসছে দিল্লীতে প্রতিমা নিরঞ্জনের এই প্রথা। ১৯৫১ সালে এই শোভাযাত্রায় মোট ১৫টি পূজা সমিতি যোগদান করেছিলেন। ১৯৬১ সালে ২৯টি পূজা সমিতি অংশগ্রহণ করেন। দিল্লীর সব পূজা কমিটির প্রতিনিধিরা এর সদস্য হতে পারেন। রেওয়ারী, ফরিদাবাদ, গুরগাঁও, নয়ডা, গাজিয়াবাদ, মোদী নগর-এর মত দুরাঞ্চল থেকেও বিভিন্ন পূজা সমিতি দুর্গা প্রতিমার এই শোভাযাত্রা ও নিরঞ্জনে অংশগ্রহণ করতে আসে। প্রতি পূজা কমিটির প্রতিমার সাথে থাকে বহু ভক্তদের ভিড়, যারা বাসে করে প্রতিমার সাথে সাথে বিসর্জনের স্থান যমুনার গীতা ঘাট পর্যন্ত যায়। সব থেকে দেখার মত জিনিষ হল যে, এই শোভাযাত্রা বহুদূর পর্যন্ত চলে বলে রাস্তায় রাস্তায় জল, পানীয়, ফল ইত্যাদি বিতরণ করতে সাধারণ জনতা এগিয়ে আসেন। এই শোভাযাত্রা দুপর ১২টা/১টায় শুরু হয়ে গীতা ঘাটে পৌছাতে সন্ধে হয়ে আসে। গীতা ঘাটে গিয়ে নির্ধারিত জায়গায় প্রতিমাগুলি রাখা হয় এবং বিসর্জনের পূর্বে শেষবারের মত আরতি করে মা দুর্গা-কে বিদায় জানানো হয়। এই সময় প্রতিমাগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় এবং বিভিন্ন পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়। প্রতিমা বিজয়ার ঘাটে যাবার আগে কাশ্মীরী গেটের কর্মকর্তারা প্রতিমা-সহ অপেক্ষা করেন সকলকে স্বাগত জানাতে। কারণ এটিই দিল্লীর প্রাচীনতম পূজা। 

আজকাল অবশ্য পূজার সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে গীতা ঘাটে জায়গার অভাব দেখা দিচ্ছে তাই অনেক পূজা কমিটি তাদের প্রতিমা ওখলার ঘাটে বিসর্জন দিচ্ছেন। ১৯৯৩ সালে চিত্তরঞ্জন পার্ক কালী মন্দির সোসাইটির নেতৃত্বে ওখলার কাছে কালিন্দী কুঞ্জ-এ আরও একটি বিসর্জন স্থলের ব্যবস্থা করা হয়। প্রতিবছর সেখানেও পৃথক ব্যবস্থা করতে হয়। ১৯৯৩ সালে সেখানে মাত্র বারোটি পূজা সমিতি তাদের প্রতিমা নিরঞ্জন করে। বর্তমানে সে সংখ্যা প্রচুর বেড়ে গেছে। যতটুকু জেনেছি তাতে বলা যেতে পারে গত বছর পর্যন্ত শুধু মাত্র বাঙালিদের দুর্গাপূজার সংখ্যা ছিল প্রায় ৩২০ টি (সঠিক তথ্য জানা নেই)। তবে এবছর বহু পুজোই হবেনা। এখানে অবাঙালিরা বিশেষতঃ বিহারের লোকেরাও কিছু দুর্গাপূজা করে থাকেন তবে তার সংখ্যা জানা নেই। 

দিল্লীতে দুর্গাপূজার মান এবং সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে বলা যায় একদিন দেশ বিদেশ থেকেও হয়তো বহু লোকেরা কলকাতার মত দিল্লীর দুর্গাপূজা দেখতে আসবেন। দিল্লীর দুর্গাপূজার বিশেষত্ব হল দিল্লীর দুর্গাপূজায় বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির ঝলক দেখা যায়। দিল্লীর দৈনন্দিন জীবন খুব ব্যস্ততামুখর। কারও পেছন ফিরে দেখার সময় নেই। সকলেই ছুটছে কাজের তাগিদে। দেখে মনে হয় “কর্মই জীবন” এটা প্রমাণ করতে। তাই দুর্গাপূজার সময় সকলে সেই লুকিয়ে থাকা প্রাণের স্পন্দন খুঁজে পায়। প্রতিবছরই দিল্লীর বাঙালিরা এই দিনগুলোর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। কবে আসবে সেই মায়ের বোধনের দিন, মর্ত্যে মায়ের আগমনের দিন। বর্ষার জলে যেমন জমিগুলো প্রাণ ফিরে পায়, ঠিক তেমনি দিল্লীর বাঙালিরাও প্রাণের স্পন্দন অনুভব করে। সব গ্লানি ভুলে স্বপ্ন দেখে নতুন দিনের। সারা বছরের কর্মব্যস্ততার টেনশন থেকে মুক্তি পায়। দুর্গাপুজো আমাদের প্রাণের পুজো। এ এক ঐক্যতার অঙ্গীকার।  (চলবে) 

সূত্র -  বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা।

Post a Comment

2 Comments