জ্বলদর্চি

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত -২১/ সুদর্শন নন্দী

চিত্র - রবীন্দ্রনাথ কপাট 

পর্ব-২১

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত 

সু দ র্শ ন  ন ন্দী 

১৮৮৫, ৬ই নভেম্বর। আশ্বিনের অমাবস্যা। কালিপুজা। শ্রীরামকৃষ্ণ শ্যামপুকুরের বাড়িতে। মাস্টার ঠাকুরের আদেশে ৺সিদ্ধেশ্বরী কালীর প্রসাদ এনেছেন;  মাস্টার  রামপ্রসাদ আর কমলাকান্তের গানের বইও নিয়ে এসেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলিলেন, “এই গান সব (ডাক্তারের ভিতর) ঢুকিয়ে দেবে। 

 উপরের ঘরে ভক্তসঙ্গে বসে আছেন তিনি; বেলা ১০টা। আছেন বিছানার উপর বালিশে ঠেসান দিয়ে, ভক্তেরা চারদিকে বসে। রাম, রাখাল, নিরঞ্জন, কালীপদ, মাস্টার প্রভৃতি অনেকগুলি ভক্ত আছেন। ঠাকুরের ভাগিনেয় হৃদয় মুখুজ্জের কথা হচ্ছে।।
বেলা আন্দাজ ২টার সময় ডাক্তার ঠাকুরকে দেখতে আসলেন। সঙ্গে অধ্যাপক নীলমণি,গিরিশ, কালীপদ, নিরঞ্জন, রাখাল, খোকা (মণীন্দ্র), লাটু, মাস্টার অনেকে। ঠাকুর সহাস্যবদন, ডাক্তারের সঙ্গে অসুখের কথা ও ঔষধাদির কথা শেষ হলে বললেন, “তোমার জন্য এই বই এসেছে।” ডাক্তারের হাতে মাস্টার সেই দুখানি বই দিলেন।
ডাক্তার তখন গান শুনতে চাইলেন। ঠাকুরের আদেশক্রমে মাস্টার ও একটি ভক্ত রামপ্রসাদের গান গাইলেন।
 গিরিশ ও কালিপদ কয়েকটি গান গাইলেন। 
    গান - আমায় ধর নিতাই
আমার প্রাণ যেন আক করে রে কেমন ৷৷
 
(গানটি গিরিশ চন্দ্র ঘোষের চৈতন্যলীলার অন্তর্গত।)  

পরের গানের বিষয়ে আসি। রাত্রি ৭টা। উপরের ঘরে পূজার সমস্ত আয়োজন হয়েছে। শরৎ, শশী, রাম, গিরিশ, চুনিলাল, মাস্টার, রাখাল, নিরঞ্জন, ছোট নরেন, বিহারী প্রভৃতি অনেকগুলি ভক্ত। ঠাকুরের মধ্যে জগজ্জননীর আবেশ হয়েছে।  
গিরিশ স্তব করছেন:
কে রে নিবিড় নীল কাদম্বিনী সুরসমাজে।
কে রে রক্তোৎপল চরণ যুগল হর উরসে বিরাজে ...

আবার গাইছেন:
দীনতারিণী, দূরিতহারিনী, সত্ত্বরজস্তম ত্রিগুণধারিণী...( পূর্ব উল্লেখিত) 
কেহ কেহ কয় ব্রহ্ম জ্যোতির্ময়, সেও তুমি নগতনয়া জননী......
 
বিহারী স্তব করছেন:
নেরি বাসনা শ্যামা শবাসনা শোন মা বলি,
হৃদয় মাঝে উদয় হইও মা, যখন হবে অন্তর্জলি...
 
( গানটির রচয়িতা দাশরথি রায়ের)

মণি এবার গাইছেন ভক্তসঙ্গে:
১)সকলি তোমারি ইচ্ছা মা ইচ্ছাময়ী তারা তুমি... (পূর্বে উল্লেখিত)
২)তোমারি করুণায় মা সকলি হইতে পারে।
অলঙ্ঘ্য পর্বত সম বিঘ্ন বাধা যায় দূরে ৷৷
 
(ত্রৈলোক্যনাথ স্যান্যালের লেখা)

এছাড়াও সেদিন আরও কিছু গান গাওয়া হয়েছিল যার উল্লেখ পূর্বে দিয়েছি।  
ঠাকুর ভক্তবৃন্দের আনন্দের জন্য একটু পায়স মুখে দিলেন। একেবারে ভাবে বিভোর, বাহ্যশূন্য হইয়ে গেলেন! 
এবারের গানের উল্লেখ কাশীপুর বাগানে ঠাকুরের অবস্থান কালে। ১৮৮৬, ১১ই মার্চ। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কাশীপুরের বাগানে হলঘরে ভক্তসঙ্গে অবস্থান করছেন। রাত প্রায় আটটা। ঘরে নরেন্দ্র, শশী, মাস্টার, বুড়োগোপাল শরৎ। ঠাকুর অসুস্থ। শুয়ে আছেন। ভক্তেরা কাছে বসে। শরৎ পাখা করছেন। ঠাকুর অসুখের কথা বলছেন। 
হঠাৎ ঠাকুর উঠে নরেন্দ্রকে বললেন,  ব্রহ্ম অলেপ। তিন গুণ তাঁতে আছে, কিন্তু তিনি নির্লিপ্ত।...যেমন বায়ুতে সুগন্ধ-দুর্গন্ধ দুই-ই পাওয়া যায়, কিন্তু বায়ু নির্লিপ্ত। কাশীতে শঙ্করাচার্য পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন! চণ্ডাল মাংসের ভার নিয়ে যাচ্ছিল -- হঠাৎ ছুঁয়ে ফেললে। শঙ্কর বললেন -- ছুঁয়ে ফেললি! চণ্ডাল বললে,-- ঠাকুর, তুমিও আমায় ছোঁও নাই! আমিও তোমায় ছুঁই নাই! আত্মা নির্লিপ্ত। তুমি সেই শুদ্ধ আত্মা। ব্রহ্ম আর মায়া। জ্ঞানী মায়া ফেলে দেয়। মায়া আবরণস্বরূপ। এই দেখ,এই গামছা আড়াল করলাম -- আর প্রদীপের আলো দেখা যাচ্ছে না। ঠাকুর গামছাটি আপনার ও ভক্তদের মাঝখানে ধরলেন। বললেন, “এই দেখ, আমার মুখ আর দেখা যাচ্ছে না।
এবার রামপ্রসাদ গানের উল্লেখ করে বললেন রামপ্রসাদ যেমন বলে - ‘মশারি তুলিয়া দেখ --’ কথামৃতে গানটির শেষ লাইন উল্লেখ রয়েছে।
১৮৮৬, ১৫ই মার্চ । কাশীপুর উদ্যান বাড়িতে ঠাকুর আজ একটু ভাল আছেন। ভক্তদের সঙ্গে কথা বলছেন। নরেন্দ্র, রাখাল, মাস্টার, লাটু এদের কাছেই বসে আছেন। নরেন্দ্রকে তিনি ত্যাগ ও ব্রহ্মজ্ঞানের কথা বলছেন। ঠাকুর নরেন্দ্রকে কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা আমার কি ভাব? নরেন্দ্র বলল বীরভাব, সখীভাব সব ভাব। ঠাকুর ভাবে বললেন , দেখছি এর ভেতর থেকেই যা কিছু।      
এবার ঠাকুর নরেন্দ্রকে একটু গান গাইতে বললেন। নরেন্দ্র সুর করে গাইছেন:

“নলিনীদলগতজলমতিতরলম্‌ তদ্বজ্জীবনমতিশয়চপলম্‌
ক্ষণমিহ সজ্জনসঙ্গতিরেকা, ভবতি ভবার্ণবতরণে নৌকা।”
(ভগবান শঙ্করাচার্যের মোহমুদ্গর স্ত্রোতের অংশ) 
দুই-এক চরণ গানের পরই ঠাকুর নরেন্দ্রকে ইঙ্গিত করে বলছেন, “ও কি! ও-সব ভাব অতি সামান্য!”
নরেন্দ্র এবার সখীভাবের গান গাইছেন:
কাহে সই, জিয়ত মরত কি বিধান!
ব্রজকি কিশোর সই, কাঁহা গেল ভাগই, ব্রজজন টুটায়ল পরাণ......
 
(গানটির রচয়িতা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। মৃণালিনী উপন্যাসে রয়েছে।) 

গান শুনে ঠাকুর ও ভক্তেরা মুগ্ধ হয়েছেন। ঠাকুর ও রাখালের নয়ন দিয়ে প্রেমাশ্রু পড়ছে। নরেন্দ্র আবার ব্রজগোপীর ভাবে মাতোয়ারা হয়ে কীর্তনের সুরে গাইছেন:
তুমি আমার, আমার বঁধু, কি বলি 
(কি বলি তোমায় বলি নাথ)......
 
(গানটির রচয়িতা বিদ্যাপতি)
১৮৮৬, ১৩ই এপ্রিল। ঠাকুর কাশীপুর বাগান বাড়িতে। আজ নব বর্ষারম্ভ, মেয়ে ভক্তেরা অনেকে এসেছেন। তারা ঠাকুরকে ও শ্রীশ্রীমাকে প্রণাম করলেন ও তাঁদের আশীর্বাদ নিলেন। শ্রীযুক্ত বলরামের পরিবার, মণিমোহনের পরিবার, বাগবাজারের ব্রাহ্মণী ও অন্যান্য অনেক স্ত্রীলোক ভক্তেরাও এসেছেন।ভক্তদের দুটি ৯,১০ বছরের মেয়ে ঠাকুরকে কয়েকটি গান শোনালেন :
তাঁর মধ্যে অন্যতম 
“ওই আসছে কিশোরী, ওই দেখ এলো
তোর নয়ন বাঁকা বংশীধারী।“  
শ্রীরামকৃষ্ণদেব সঙ্কেতে বলছেন, “বেশ মা মা বলছে!”

এরপর ঠাকুর হেসে রাখালকে ইঙ্গিত করছেন, “ওকে গান গাইতে বল না।” ওকে মানে ব্রাহ্মণীকে। ভক্তেরা হাসছেন।
ব্রাহ্মণী গাইলেনঃ 
‘হরি খেলব আজ তোমার সনে,
 একলা পেয়েছি তোমায় নিধুবনে।’
গান শেষ হলে মেয়েরা উপরের ঘর থেকে নিচে চলে গেলেন। 

১৮ই এপ্রিল ১৮৮৬। কাশীপুর বাগান বাড়ি । ঠাকুর যে ঘরে আছেন, তার পশ্চিমদিকে একটি পুকুর আছে। ঘাটের চাতালে কয়েকটি ভক্ত খোল-করতাল নিয়ে গান গাইছেন। ঠাকুর লাটুকে দিয়ে বলে পাঠালেন -- “তোমরা একটু হরিনাম কর। 
মাস্টার, বাবুরাম প্রভৃতি এখনও ঠাকুরের কাছে বসে আছেন। তাঁরা শুনছেন, ভক্তেরা গাইছেন:
হরি বোলে আমার গৌর নাচে।
ঠাকুর গান শুনতে শুনতে বাবুরাম, মাস্টার প্রভৃতিকে ইঙ্গিত করে বলছেন – 
“তোমরা নিচে যাও। ওদের সঙ্গে গান কর, -- আর নাচবে।”
তাঁরা নিচে এসে কীর্তনে যোগদান করলেন।
খানিক পর ঠাকুর আবার লোক পাঠালেন। বলেছেন, এই আখরগুলি দেবে -- “গৌর নাচতেও জানে রে! গৌরের ভাবের বালাই যাই রে! গৌর আমার নাচে দুই বাহু তুলে!”

কীর্তন শেষ হল। সুরেন্দ্র ভাবাবিষ্টপ্রায় হয়ে এবার গাইছেন --
আমার পাগল বাবা, পাগলী আমার মা।
আমি তাদের পাগল ছেলে, আমার মায়ের নাম শ্যামা......
 
গানটি গিরিশ চন্দ্র ঘোষের লেখা। 
 
১৮৮৬, ২২শে এপ্রিল। কাশীপুরের বাগান। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ উপরের হলঘরে বসে আছেন। সামনে হীরানন্দ, মাস্টার, আরও দু-একটি ভক্ত, আর হীরানন্দের সঙ্গে দুজন বন্ধু এসেছেন। হীরানন্দ সিন্ধুদেশবাসী। কলকাতার কলেজে পড়াশুনা করে দেশে ফিরে সেখানে এতদিন ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের অসুখ হয়েছে শুনে তাঁকে দেখতে এসেছেন। হীরানন্দকে দেখবার জন্য ঠাকুর ব্যস্ত হয়েছিলেন।
 হীরানন্দের সাথে নরেন্দ্রের খানিক ইশ্বর কথা হল। তারপর নরেন্দ্রকে তিনি গান গাইতে বললেন। নরেন্দ্র একাধিক গান গাইলেন। তার মধ্যে অন্যতম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের  এই স্ত্রোতটি:

পরিপূর্ণমানন্দম্‌।
অঙ্গ বিহীনং স্মর জগন্নিধানম্‌......
 
শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রেকে বললেন- আর ওইটে “যো কুছ্‌ হ্যায় সব্‌ তুঁহি হ্যায়!”
নরেন্দ্র ওই গানটি গাইছেন:তুঝ্‌সে হাম্‌নে দিলকো লাগায়া, যো কুছ্‌ হ্যায় সব্‌ তুঁহি হ্যায়...। গানটি আগে উল্লেখ করেছি। 
 কথামৃত থেকে ঠাকুরের গাওয়া ও শোনা গান এখানেই শেষ হল। এ প্রসঙ্গে বলি কথামৃতকারের অপ্রাকশিত ডায়েরিকে ভিত্তি করে শ্রীরামকৃষ্ণের অন্ত্যলীলার এগারো মাস ব্যাপী (২৬শে সেপ্টেম্বর ১৮৮৫ থেকে  ১৬ই আগস্ট ১৮৮৬) ঘটনা পরপর সজিয়েছেন স্বামী প্রভানন্দ তাঁর “শ্রীরামকৃষ্ণ অন্ত্যলীলা” গ্রন্থে। এই গ্রন্থেও উল্লেখ রয়েছে ঠাকুরের গানের কথা।
প্রথম গানের উল্লেখ ৬ই ডিসেম্বর ১৮৮৫তে। ঠাকুর শ্যামপুকুর বাড়িতে এসেছেন। বেলা বারোটা। ডাক্তার সরকার দেখতে এসেছেন তাঁকে। ঠাকুরকে দেখার পর ডাক্তারবাবু গান শুনতে চাইলেন। তাঁর অনুরোধে বসল গানের আসর। রয়েছেন নরেন্দ্র, নবগোপাল, মাস্টার ও আরও কয়েকজন ভক্ত। নরেন্দ্র কীর্তন গাইতে শুরু করলেনঃ
নন্দনন্দন, বিলমাঈ বদরানে ঘেরি মাঈ 
ইতঘন লরজে উতঘন গরজে, চমকত বিজ্জু সবাই...
ঠাকুর বলছেন আখর দিতে হয়, “আর ঘরে রইতে নারি” । মাস্টারকেও গাইতে বললেন ঠাকুর।
মাস্টার অপ্রস্তুত। নরেনের গলায় গান শুনে ঠাকুর নিজের ঘরে গেলেন। 
পরের উল্লেখ পাই ৮ই জানুয়ারি ১৮৮৬। ঠাকুর কাশীপুর বাগানবাড়িতে। বিকেলে কালীর (স্বামী অভেদানন্দ)বাবা কালীকে ফিরিয়ে নিতে এসেছেন তাই ঠাকুর একটু বিরক্ত। খানিক পর নরেন্দ্র এসে ঠাকুরের ইঙ্গিতে তাঁর কাছে বসলেন। তাঁকে গান গাইতে বললেন ঠাকুর । নরেন্দ্র বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের মৃণালিনী উপন্যাসের 
“পরাণ না গেলো।
যো দিন পেখনু সই যমুনাকি তীরে,
গায়ত নাচত সুন্দর ধীরে ধীরে,...” গানটি গাইলেন। গান শুনে ঠাকুর বেশ খুশি হলেন। ঠাকুর আরেকটি গান গাইতে বললেন। নরেন্দ্র “রামনাম লেতে” গাইলেন। শ্রোতারা খুব আনন্দিত। ঠাকুর আরেকটি গান গাইতে বললে নরেন্দ্র এবার ত্রৈলোক্যনাথ স্যান্যালের লেখা
“ কবে তব দরশনে হে প্রেমময় হরি।
কবে উথলিবে হৃদিমাঝে চিদানন্দলহরী... “ গানটি গাইলেন।

Post a Comment

0 Comments